গোটা একটা নক্ষত্র সম্প্রদায় আবিষ্কার করেও নোবেল-উপেক্ষিতা জোসেলিন বার্নেল
১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসের ৬ তারিখের কথা। কেমব্রিজের এক গবেষক-বিজ্ঞানী অ্যান্টনি হিউইশ তাঁর সহকারীদের নিয়ে এক বড় আকারের টেলিস্কোপ বানিয়ে ‘কোয়াসার’ নামে এক ধরনের তারা থেকে আসা বেতার তরঙ্গ (বা রেডিও ওয়েভ) পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কোয়াসার হল যে কোনও গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা ভারী এক ধরনের বস্তু যারা এই অদৃশ্য বেতার তরঙ্গ বিকিরণ করে। তখনও অব্দি এই ধরনের বিশেষ নক্ষত্রের খোঁজ মিলেছিল খান-কুড়িটি মতো, তবে এগুলো সম্বন্ধে বিশেষ কারোরই কিছু জানা ছিল না। অনেক পরে জানা যায় এগুলো আসলে বিশেষ ধরনের ব্ল্যাক হোল, যা বসে আছে প্রায় সব গ্যালাক্সির কেন্দ্রেই।
আসল কাজটা, অর্থাৎ টেলিস্কোপের অন্দরমহল থেকে ধরা দেওয়া তথ্যসমূহ; যা সাজানো ছিল প্রায় ৫০০ মিটার লম্বা কাগজের গায়ে, সেটা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন হিউইশের চব্বিশ বছর বয়সী এক সহকারী। ওই কাগজের স্তুপ ভালোভাবে দেখতে গিয়ে সেই সহকারীর চোখে ধরা পড়ল এক অদ্ভুত বিষয়। একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর বিশেষ এক দিক থেকে আসছে নির্দিষ্ট সময়সীমা জুড়ে চলা এক বেতার তরঙ্গের ইঙ্গিত। অল্প সময় ধরে কোথাও কোনও রকম আলো পাঠানো হলে সেটাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘পালস’। আমরা বলতে পারি টুকরো আলো। তবে এই আলো দৃশ্যমান নয়, এ হল অদৃশ্য আলো। বেতার তরঙ্গ।
সেই সহকারীটি প্রথমে ভাবলেন এ মহাকাশের কোনও অভূতপূর্ব রহস্য। জানালেন তাঁর গাইড হিউইশকে। কিন্তু হিউইশের মনে হল এ কোনও অপার্থিব বিষয় নয়, পৃথিবীর বুকে মনুষ্যসৃষ্ট কোনও কারণে তৈরি হচ্ছে এই ধরনের তরঙ্গ। কিন্তু পরের দিন তিনি যখন ওই সহকারীর কাছে এসে নিজের চোখে দেখলেন কাগজের গায়ের তথ্যগুলো, তখন তিনি মত বদলালেন। হ্যাঁ এ তরঙ্গ দূর নক্ষত্রের কাছ থেকেই আসছে বটে।
এর পরের কয়েকটা সপ্তাহ কাটল ওই তরঙ্গকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতেই। কাজটা এবার তাঁরা দু’জনে একইসঙ্গে মিলে করতে লাগলেন। ইতিমধ্যে ওই সহকারী আকাশের আরও তিন দিকে তিনটি ওইরকম তরঙ্গ বিকিরণ অরছে এমন উৎসের সন্ধান পেয়ে গিয়েছেন। তাঁরা মজা করেই এই ধরনের রহস্যময় উৎসের নাম দিলেন ‘এলজিএম’। লিটল গ্রিন ম্যান-এর প্রথম অক্ষর তিনটি একত্র করে। সত্যিই কি তখন তাঁরা ভিন গ্রহের প্রাণীদের থেকে আসছে ওই তরঙ্গ, এমনটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন?
কিন্তু সেরকমটা না হলে আসল ব্যাপারটা কী? পালসের স্থায়িত্ব মাত্রই ১.৩ সেকেন্ড, আর অতি দূর থেকে আসা (প্রায় ২০০ আলোকবর্ষ) আরও অন্য কিছু ধরন দেখে ততদিনে তাঁরা আন্দাজ করেছেন যে যে উৎস থেকে আসছে এই তরঙ্গ, সেই নক্ষত্রের আকার নির্ঘাত বেশ ছোট, অথচ বেশ ভারী। হতে পারে এগুলো কোনও নিউট্রন তারা বা সাদা বামন (হোয়াইট ডোয়ার্ফ)।
তাঁদের ওই গবেষণার ফলাফল পেপারের আকারে প্রকাশিত হল ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, নেচার পত্রিকায়। সেখানে মূল লেখক অ্যান্টনি হিউইশের পরেই নাম ছিল ওই সহকারীর। আসলে তিনি এক তরুণী, তাঁর নাম সুসান জোসেলিন বেল। যিনি বছর খানেকের মধ্যে বিয়ের পর হবেন জোসেলিন বেল বার্নেল। বিশ শতকের জ্যোতির্বিদ্যার জগতে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার ‘পালসার’ নামের নক্ষত্রের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে তাঁর নাম।
১৯৬৮-র ডিসেম্বরে আরও এক দল গবেষক খুঁজে পেলেন একটু অন্য ধরনের এরকমই পালস নির্গমনকারী মহাজাগতিক বস্তুকে। কয়েক বছরের মধ্যেই পালসার নক্ষত্রের নাম সবার কাছে পরিচিত হয়ে পড়ল। দ্রুত আবর্তনশীল নিউট্রন নক্ষত্র হিসেবে পরিচিতি পেল এই তারা।
গবেষণা চলাকালীন ওই ১৯৬৮ সালেই বিয়ে করে নেন সুসান, এখন তিনি জোসেলিন বেল বার্নেল। স্বামী সরকারি কর্মচারী, সেই সুবাদে তাঁদের ঘুরে বেড়াতে হয় সারা ইংল্যান্ড জুড়ে। বিয়ের কিছু পরেই তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। বার্নেল নিজেও সেই সেই সময়ে স্বামীর কর্মক্ষেত্রের কাছাকাছি কোথাও খুঁজে নিয়েছেন নানা ধরনের আংশিক সময়ের নানা কাজ, মূলত আর্থিক সুরাহার কারণেই। তবে তরঙ্গ-জ্যোতির্বিদ্যা বা ওয়েভ-অ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে পড়াশুনো বা চর্চা তিনি চালিয়ে যেতেন সবসময়েই। প্রায় কুড়ি বছর তাঁরা জীবনযাপন করেছিলেন যাযাবরের মতো। এসবের মধ্যেও জ্যোতির্বিদ্যাকে আঁকড়ে থাকা, এ দৃষ্টান্ত খুব একটা মেলে না।
যুগান্তকারী কাজ করেও নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হওয়া, এ দৃষ্টান্ত বড় কম নেই। পদার্থবিজ্ঞানের জগতেও এমন উদাহরণ রয়েছে ভুরি ভুরি। আমাদের মনে আসবে রোজালিন ফ্রাঙ্কলিন, লিজে মেইটনার-এর নাম। এই তালিকায় উজ্জ্বল সংযোজন ঘটল ১৯৭৪ সালে, যখন পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাপকদের নাম ঘোষিত হল। হ্যাঁ, বাদ গেল জোসেলিন বেল বার্নেল-এর নাম। অ্যান্টনি হিউইশ আর মার্টিন রাইল পেলেন পালসার আবিষ্কারের স্বীকৃতি। বার্নেলকে বঞ্চিত করা হল, যার কারণ এখনও জানা যায় না। হতে পারে তখন তিনি ছিলেন এক সাধারণ গবেষণা-সহায়ক, নাকি মহিলা বলেই...
নানা দিক থেকে এসেছিল প্রতিবাদ। তবে বার্নেলকে নোবেল থেকে বঞ্চিত করবার জন্য সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন যিনি, তাঁর লেখা বই পড়েই ছোটবেলায় জ্যোতির্বিদ্যার জগতে আসবার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন বার্নেল। তিনি বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ফ্রেড হয়েল। যিনি নিজেও নোবেল থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন ১৯৮৩ সালে, যখন তাঁর কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা তাঁরই সহকর্মী উইলিয়াম ফাউলার-কে দেওয়া হয় এই পুরস্কার, মহাজাগতিক বস্তুদের মধ্যেকার রাসায়নিক বিক্রিয়ার রহস্য উদ্ঘাটনের স্বীকৃতি হিসেবে।
উত্তর আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে ১৯৪৩ সালে জন্ম নেওয়া বার্নেল ছোট থেকেই বাড়িতে পেয়েছিলেন পড়াশুনোর পরিবেশ। তাঁর যখন চোদ্দ বছর বয়স, তাঁকে তাঁর বাবা এনে দেন একটি জ্যোতির্বিদ্যার বই, ফ্রেড হয়েল-এর লেখা ফ্রন্টিয়ার্স অব অ্যাস্ট্রোনমি। চোদ্দ বছরের কিশোরীর পক্ষে সেই বইয়ের বক্তব্য বোঝা একটু কঠিনই বটে, তবে বার্নেল হাল ছাড়েননি, নিজের ঘরে গিয়ে সেই বইয়ের প্রথম থেকে শেষ পাতা অব্দি পড়ে শেষ করে তবে শান্তি। সব কথা হয়তো বুঝলেন না, কিন্তু ওই যে হাল না ছাড়বার মানসিকতা, এইটাই তখন থেকে তাঁর মধ্যে জন্মে গিয়েছিল। আর তিনি যে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়েই পরবর্তীকালে লেগে থাকবেন, সেটাও হয়তো স্থির হয়ে গিয়েছিল ওই স্কুলে পড়বার কালেই। স্কুল থেকে ফিরবার পথে তিনি প্রায় রোজই বেলফাস্টের আরমাঘ মানমন্দির দেখতে যেতেন। তাঁর স্থপতি বাবাই এই মানমন্দিরের ডিজাইন করে দিয়েছিলেন। মহাকাশের বুকে জমে থাকা রহস্যময় পরিবেশ তাঁকে তখন থেকেই হাতছানি দিতে শুরু করে। যেজন্য গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে পদার্থবিদ্যায় বিএসসি পাশ করেই সুসান বেল স্থির করে ফেলেন তিনি রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি নিয়েই কাজ করবেন। দৃশ্যমান আলো নিয়ে কাজ চলে যে সব টেলিস্কোপের (এই ধরনের টেলিস্কোপের সাহায্যে মহাজাগতিক বস্তুদের পর্যবেক্ষণ করে পাওয়া তথ্যাদি নিয়ে কাজ চলে ‘অপটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি’ নামে বিভাগটির, আর অদৃশ্য রেডিও তরঙ্গ নিয়ে কাজ চললে সেটা হয়ে যায় ‘রেডিও-অ্যাস্ট্রোনমি’র বিষয়) সেগুলো খুব একটা টানত না সুসান বেলকে, কারণ তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে ওই ধরনের টেলিস্কোপ নিয়ে কাজ করতে গেলে জেগে থাকতে হবে রাতের পর রাত, যেটা তাঁর পক্ষে একেবারেই সম্ভব না কারণ তিনি রাতের ঘুম মোটেই নষ্ট করতে চান না।
গ্লাসগো থেকে পাশ করে সুসান বেল চলে এলেন কেমব্রিজে, যেখানে গাইড হিসেবে পেলেন অ্যান্টনি হিউইশকে। আর এই কেমব্রিজেই গবেষণা চলাকালীন তিনি হিউইশের সহকারী হিসেবে আবিষ্কার করেন ‘পালসার’ নামের বিশেষ নক্ষত্রকে, যে ঘটনার কথা শুরুতেই বলেছি।
অবশ্য বার্নেল যে অন্য কোনোভাবেই স্বীকৃতি পাননি, এমনটা বলা ঠিক হবে না। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন তিনি, এডিনবরার রয়্যাল অবজারভেটরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, অক্সফোর্ডেও ছিলেন ভিজিটিং অধ্যাপক। ১৯৯৯ সালে ব্রিটিশ সরকার থেকে পান কম্যান্ডার অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ার (সিবিই) উপাধি, ২০০৩ সালে রয়্যাল সোসাইটির সদস্য মনোনীত হন। রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিন বছর। এইসময়ের উজ্জ্বল জীবিত জ্যোতির্বিদদের মধ্যে তিনি একজন, এতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে যেহেতু নোবেল পুরস্কারের মতো খ্যাতি বা গ্ল্যামার এসবের কোনোটাতেই নেই তাই ওই পুরস্কার থেকে কারও বঞ্চিত হওয়াটা একটু বেশিই চোখে লাগে। আর এমনিতেই ওই পুরস্কারের প্রাপকদের মধ্যে মহিলাদের অংশগ্রহণ বেশ কমই, সেখানে এইভাবে একজন যোগ্য দাবীদারের অস্বীকৃতি আমাদের হতাশ করে বই কি।