ফেলুদার গল্পে মার্ডার ওয়েপন
হিরে মানিক জ্বলে : নবম পর্ব‘কী ব্যাপার মশাই?’‘খুন।’‘সে কী!’— আমরা তিনজনে প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলাম। খ-য়ে হ্রস্বউ আর ন— এই দুটো পর পর জুড়লে আপনা থেকেই যেন শিউরে উঠতে হয়।
‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’-তে বম্বে শহরে পা দেওয়ার পর একটা খুনের খবর পেয়ে তোপসের এই প্রতিক্রিয়াই হয়েছিল। কিন্তু ফেলুদার যে অ্যাডভেঞ্চারগুলোর কথা তোপসে লিখেছিল, দেখা যাচ্ছে সেই পঁয়ত্রিশটি গল্পের মধ্যে কুড়িটির সঙ্গেই জুড়ে আছে কোনও খুনের ঘটনা। ছোটোদের জন্য লেখার দরুন বিষয়ের বাধ্যবাধকতা থাকলেও ক্রাইম কাহিনি থেকে খুনকে তো আর পুরোপুরি বাদ দেওয়া চলে না। রোনাল্ড নক্স, যিনি গোয়েন্দা কাহিনি লেখার রীতিমতো নিয়ম নির্দেশিকা বানিয়ে ফেলেছিলেন, তাঁর মতে খুন না থাকলে গোয়েন্দা গল্পের ষোলো আনাই মাটি। কিন্তু সাদামাটা খুন হলে আর ফেলুদার মগজাস্ত্রকে কাজে লাগানো যায় কী করে! তাই ফেলুর অধিকাংশ খুনের মামলাতেই খুনের পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে হত্যার অস্ত্র সম্পর্কেও মাথা ঘামাতে হয়েছিল সত্যজিৎ রায়কে।
‘হত্যাপুরী’ উপন্যাসে খুনের অস্ত্রশস্ত্র বিষয়ে একটা সাধারণ ধারণা পেশ করেছিলেন লেখক। তাতে জানা গিয়েছিল অস্ত্র দিয়ে খুন সাধারণত তিন ধরনের হয়। এক, আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে; দুই, শার্প ইন্সট্রুমেন্ট, আর তিন, ব্লান্ট ইন্সট্রুমেন্ট বা ভোঁতা হাতিয়ার দিয়ে। যদিও এই তিনরকম অস্ত্রের কোনোটিই ব্যবহার না করে বিভিন্ন বিচিত্র পদ্ধতিতে যে হত্যা ঘটানো যায়, ফেলুর তা অজানা ছিল না।
ফেলুদা সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘বাদশাহী আংটি’-র কথাই ধরা যাক। লখনউয়ের ধনী ব্যবসায়ী পিয়ারিলাল শেঠের মৃত্যুর কারণ ছিল হার্ট অ্যাটাক, এমনটাই সবাই জানত। কিন্তু সেই হার্ট অ্যাটাকের আসল কারণ ছিল বনবিহারীবাবুর পোষা আফ্রিকার বিষাক্ত মাকড়সা, ব্ল্যাক উইডো স্পাইডার। ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’-এ শিবকুমার শেলভাঙ্কারকে খুন করা হয়েছিল গাড়ি সমেত খাদে ফেলে, তারপর পাহাড়ের ওপর থেকে পাথরের চাঁই ফেলে ঘটনাটাকে অ্যাক্সিডেন্টের চেহারা দেওয়া হয়। ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’ উপন্যাসে হেলিকপ্টার পাইলট হিমাদ্রি চক্রবর্তী মারা যান জাল ইঞ্জেকশনের প্রভাবে। তাঁকে দেওয়া অ্যান্টিটিটেনাস ইঞ্জেকশনের মধ্যে আদতে ছিল স্ট্রিকনিন নামের তীব্র বিষ। আরেকটি মৃত্যু অবশ্য প্রথমে খুন বলে মনে হলেও পরে ঘটনার অভিমুখ পালটে যায়। ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ উপন্যাসে শেষমেশ তড়িৎ সেনগুপ্তের মৃত্যুর কারণ হিসেবে সাব্যস্ত হয় বজ্রপাত।
অস্ত্র ছাড়া শ্বাসরোধ করে খুনের ঘটনাও ঘটেছে ফেলুদা কাহিনিতে। তার মধ্যে নজর কাড়ে ‘ডাক্তার মুনসীর ডায়রি’-তে উল্লিখিত একটি হত্যাকাণ্ড। খুনি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, জর্জ হিগিনস। টেলিভিশনের জন্য বিদেশে জানোয়ার চালান দেওয়ার ব্যবসা ছিল এঁর। ঘটনাচক্রে এক সুইডিশ চলচ্চিত্র পরিচালককে টুঁটি টিপে খুন করে ফেলেন ইনি। তারপর পরিচালকের দেহ ছুরি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে নিজের সংগ্রহের একটা হিংস্র বনবিড়ালকে গুলি করে মারেন, যার ফলে পরিচালক হত্যার দায় গিয়ে বর্তায় পশুটির ওপর।
ছুরির মতো শার্প ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে খুন করা হয়েছিল অন্তত দশটি ফেলুদা কাহিনিতে। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ পটুয়া শশীবাবু, ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’-এ সুকিয়াস, ‘ইন্দ্রজাল রহস্য’-এ বেয়ারা অবিনাশ, ‘নয়ন রহস্য’-এ হিঙ্গোয়ানি, এমন অনেকগুলো কেসেই খুনের অস্ত্র ছিল ছুরি। ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’ হিমাদ্রি চক্রবর্তীর বন্ধু অনীকেন্দ্র সোম এবং ‘দার্জিলিং জমজমাট’-এর বিরূপাক্ষ মজুমদার দুজনেই খুন হন ভোজালির আঘাতে। বিরূপাক্ষবাবুর বেয়ারা লোকনাথকে খুন করা হয়েছিল পেপার কাটার দিয়ে। তবে আগ্নেয়াস্ত্র বা শার্প ইন্সট্রুমেন্টের চেয়ে বেশি অভিনবত্ব দেখা গেছে ব্লান্ট ইন্সট্রুমেন্টগুলির ক্ষেত্রেই।
‘নেপোলিয়নের চিঠি’-তে খুন হয়েছিলেন কিউরিও সংগ্রাহক পার্বতীচরণ হালদার। তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল তাঁরই সংগ্রহে থাকা ভিক্টোরিয়ার আমলের একটি পেপারওয়েট। ‘টিনটোরেটোর যীশু’-তে নিয়োগীবাড়ির সেক্রেটারি বঙ্কিমবাবুকে খুন করা হয় ব্রোঞ্জের ঘোড়সওয়ার মূর্তির আঘাতে। পিতলের বুদ্ধমূর্তি দিয়ে খুনের একটি ঘটনা অবশ্য এরও আগে ফেলুদার গোচরে এসেছিল। ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ মহেশ চৌধুরীর বিগতযৌবনের এই অপরাধের কথা জানাজানি হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পরে। ‘হত্যাপুরী’ উপন্যাসের অস্ত্রটি অবশ্য অন্যান্য সব ফেলুদা কাহিনিকেই টেক্কা দিয়ে গেছে। এ উপন্যাসে দুর্গাগতি সেনের সেক্রেটারি নিশীথ বোসকে হত্যার অস্ত্র ছিল দ্বাদশ শতাব্দীর সংস্কৃত পুথি অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা, থুড়ি, পুথির কাঠের পাটা।
লন্ডনে যে ছেলেটির খোঁজ করতে গিয়েছিল ফেলুদা, সেই পিটার ডেক্সটর মারা গিয়েছিল মাথায় বইঠার আঘাত পাওয়ার পর অজ্ঞান অবস্থায় জলে ডুবে। আঘাত করেছিলেন ফেলুদার মক্কেল, রঞ্জন মজুমদার। ডাক্তার মুনসী খুন হয়েছিলেন হামানদিস্তার ডান্ডার বাড়িতে, একইভাবে খুন হন ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’-তে ইন্দ্রনারায়ণ আচার্য। এই একই অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে গেছিলেন জটায়ু, ‘নেপোলিয়নের চিঠি’-র রহস্য উদ্ধারের জন্য যখন এক রাতে আততায়ীর মোকাবিলা করার প্রয়োজন পড়েছিল। অবশ্য নেপালের ভোজালি, অস্ট্রেলিয়ার ব্যুমেরাং থেকে মিলিটারি স্মোক বম্ব, এমনকি মন্দার বোসের নকল পিস্তল, কী ছিল না তাঁর অস্ত্রের সংগ্রহে! কিন্তু বলাই বাহুল্য, তার মধ্যে কোনোটিরই ‘মারণাস্ত্র’ হয়ে ওঠবার সৌভাগ্য হয়নি।
গোলকধাম রহস্য’-এ অন্ধ বিজ্ঞানী নীহার দত্ত খুন করেছিলেন বাড়ির ভাড়াটে দস্তুর ওরফে সুপ্রকাশ চৌধুরীকে। খুনের পদ্ধতি রাজা দশরথের শব্দভেদী বাণের কথা মনে করালেও এখানে বাণের জায়গা নিয়েছিল তাঁর হাতের রুপো বাঁধানো লাঠি। এককালের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, যার চক্রান্ত নীহারবাবুর দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যবনিকা টেনে দিয়েছিল তাঁর গবেষণাতেও, তার অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়াই ছিল নীহারবাবুর অসমাপ্ত কাজ। দস্তুরের হত্যাকারীকে চিহ্নিত করার সঙ্গে সঙ্গে হত্যার অস্ত্র চিনতেও ভুল হয়নি গোয়েন্দা প্রদোষচন্দ্র মিত্রের। নীহারবাবুর পিতামহের সূত্রে পাওয়া লাঠির আঘাত যত জোরালোই হোক, জিঘাংসার চেয়ে শক্তিশালী কোনও মারণাস্ত্র আছে কি?
[কভারে সত্যজিত রায়ের বিভিন্ন সময়ে আঁকা ছবি ও অলংকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। কভার ডিজাইন : অর্পণ দাস]