মিঃ রাইট : অস্তিত্বের অন্ধকার মর্মমূল থেকে বেরিয়ে আসা একটি ডান হাত
রবীন্দ্রনাথের 'রাজা' নাটকটিকে শম্ভু মিত্র বলেছিলেন "অন্ধকারের নাটক"। এ অন্ধকার, বলা বাহুল্য, আলোর বিপরীতার্থক নয় - আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতোই। ভারতীয় নাট্যের শিকড় খুঁজতে খুঁজতে শম্ভু মিত্র এই অন্ধকারকেও উল্টেপাল্টে খুঁজেছেন তাঁর নাট্যে। এমনকি নিজে যখন কলম ধরেছেন তখনও। 'চাঁদ বণিকের পালা'-য় বারবার ফিরিয়ে এনেছেন এই অন্ধকারেরই প্রসঙ্গ। কবিতা থেকে নাটকে চলে আসা মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের নাট্যভাবনা ঠিক এই ঘরানার নয়। অথচ 'মিঃ রাইট' নাটক বিষয়ে তিনিও এই অন্ধকারের কথাই উল্লেখ করেন। বলেন, "আমার অনেক নাটকের মতো এই নাটকও অন্ধকারের কথাই বলবে।"
মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের 'মিঃ রাইট' নাটকটিকে সম্প্রতি মঞ্চে ফিরিয়ে এনে সেই অন্ধকারের টীকাভাষ্য লিখতে চেয়েছে অশোকনগর নাট্যমুখ। মোহিতবাবুর নাটক মঞ্চের ভাষায় যথাযথভাবে ধরা খুব সহজসাধ্য নয়। পরিচালকের কাজ আরও কঠিন করে দেয় মোহিতবাবুর নাটকের নিহিত কাব্যময়তা। অভি চক্রবর্তী সেই কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। তাঁর ভাবনা ও নির্মাণে এই নাট্য হয়ে উঠেছে একটি সাহসী ও মরমী বিনির্মাণ। প্রায় দু দশক আগে নাট্যমুখই মঞ্চস্থ করেছিল এই নাটক। লোকপ্রিয়তা পেয়েছিল সেই প্রযোজনা। পরিচালক স্বয়ং সে প্রযোজনায় যুক্ত ছিলেন অভিনেতা হিসেবে। এত বছর পর বীক্ষণ বদলে গেছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে, জানিয়েছেন তিনি।
এক জটিল, বিরল স্নায়বিক অসুখে আক্রান্ত এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিতে রজত। অসুখের নাম 'এলিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোম'। এ অসুখে হাত মানুষের বশে থাকে না। রজতের ডান হাতই কি খুন করে বন্ধু রণেনকে? নাটকের শুরুতেই যে গাড়ির দুর্ঘটনার সাক্ষী হই আমরা, তা কি আদৌ দুর্ঘটনা? প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে রজত নির্দোষ। কিন্তু রজতের প্রাক্তন প্রেমিকা, রণেনের বাগদত্তা তন্দ্রা তা বিশ্বাস করে না। রজতই কি বিশ্বাস করে? স্বেচ্ছাচারী তার ডান হাত। আনসেন্সর্ড। একেবারে কাঁচা, আকরিক মনোবাঞ্ছারা শিরা-উপশিরা বেয়ে উঠে আসে হাতের মুদ্রায়, আঙুলের ইশারায়। অবদমন কাজ করে না তার ওপর। যখন তখন গলগলিয়ে বেরিয়ে আসে তরল নৈরাজ্য, নাশকতা। এ হাত কাঁধ থেকে নয়, যেন সটান বেরিয়ে এসেছে অস্তিত্বের মর্মমূল থেকে। অন্ধকার, সবুজ, ঠাণ্ডা সেই গর্ভগৃহে কোনও সুপার ইগোর নিয়ন্ত্রণ নেই। এ হচ্ছে অন্তরতম সত্তা, যাকে মানুষ বস্তুত কাপড় পরিয়ে রাখে লজ্জাবশত।
এই নাটকের মূল টেক্সটের যে সংকট, তার গায়ে সময়ের ধুলো লাগবে না। এ নাটক উত্তরাধুনিক মানব-ইতিহাসের যে কোনও পর্বেই সমান জ্যান্ত। মূল টেক্সটের 'বিটুইন দ্য লাইন'গুলো যথার্থভাবে ছেঁকে বের করে সমসময়ের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন পরিচালক। সময়ের বেশ কিছু চিহ্নকে পাল্টে, জায়গায় জায়গায় নতুনভাবে বিন্যস্ত করে নিয়েছেন। মূল নাটকে সমস্ত দৃশ্য চার দেওয়ালের মধ্যে। অভি কিন্তু রজতকে বাইরে নিয়ে যান। বাইরের দুনিয়াতেও ধ্বস্ত করেন তাকে। নগরীর মহৎ রাতের মোড়ক ছিঁড়ে লিবিয়ার জঙ্গলের মুখ বের করে আনেন। রজত হারতে থাকে, হারাতে থাকে। মূল নাটকে রজতের একজন গৃহ-সহায়ক ছিল। এই নির্মাণে রজত বাড়িতে একা। ব্যক্তিক সংকটই মোহিতের অন্বিষ্ট ছিল। অভি তাকে প্রকটতর করতে রজতকে একা সময় দেন বেশ কিছুটা।
কৌতূহলের জন্ম দেয় দেবাশিস দত্তের মঞ্চভাবনা। নীল আলোর পথ পাক খেয়ে খেয়ে উঠে গেছে উপরে। মনোগহনের পাকদণ্ডি প্রকট হয়ে থাকে। ডান হাতের সঙ্গে মাঝেমাঝেই নগ্ন, নির্জন স্বগত সংলাপে লিপ্ত হয় রজত। কখনও সে হাতের দখলে চলে যেতে থাকে, কখনও ফিরে আসে চেতনায়। প্রাণপণে নিজের হাতের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে সে। রজত চরিত্রের জন্য অসম্ভব শক্তিশালী একজন অভিনেতা দরকার ছিল পরিচালকের। সুমিত কুমার রায় সেখানে অনবদ্য। শরীর, কণ্ঠ ও অভিব্যক্তিকে তিনি যেভাবে ব্যবহার করেছেন, কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। বিশেষত এই নির্মাণে অত্যন্ত জরুরি ছিল রজতের শরীরী ভাষা। সুমিত সেখানে মুগ্ধ করেছেন। রজতের অবাধ্য হাত যেখানে তার অজান্তেই লাফিয়ে উঠে ডাক্তার বন্ধু সিধুর চোয়াল চেপে ধরে, সেই দৃশ্যটি নিখুঁত, নিটোল একটি নাট্যমুহূর্ত। অসামান্য টাইমিং, অসামান্য অভিব্যক্তি।
নাচের কোরিওগ্রাফি প্রশংসনীয়। আইটেম গানকে আরেকটু কম মঞ্চসময় দিলেও বোধহয় চলত। জ্যোতিষির ক্ষেত্রে স্ক্রিপ্ট কিছুটা চড়া অভিনয় দাবি করলেও প্রয়োজনের বেশি মেলোড্রামাটিক হয়ে নাটকের মেজাজকে সাময়িকভাবে একটু লঘু করে দিয়েছে বলে মনে হল। আবহসংগীত কোথাও কোথাও ফেড ইন বা ফেড আউট হতে পারত কিন্তু সেই জায়গায় আচমকা শুরু বা বন্ধ হয়েছে। সেটা কারিগরি সমস্যার কারণেও হতে পারে। তন্দ্রার চরিত্রে সংগীতা চক্রবর্তী, মিলির স্বামী বাবির চরিত্রে জয় চক্রবর্তী এবং সিধুর চরিত্রে অভি চক্রবর্তী যথাযথ। মৃত রণেনের দাদার চরিত্রে অসাধারণ পরিমিতি দেখিয়েছেন অসীম দাস। পরিচালকের সূত্রে জেনেছি, অনেকেরই প্রথম মঞ্চাবতরণ এটি। তাঁদের মধ্যে কাউকে কাউকে দেখে কিন্তু সেটা বোঝা যায়নি। বিশেষত প্রশংসা করতেই হয় মিলি চরিত্রে শাশ্বতী দেবের অভিনয়ের। তিনি একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ নৃত্যশিল্পী। অভিনয়েও লম্বা দৌড়ের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেল তাঁর থেকে।
এই নির্মাণের সবচেয়ে বড় কথা, রজতের স্বেচ্ছাচারী ডান হাত, যার উদ্ধত তর্জনি নাইন এম এম পিস্তলের মতো তাক করা আমাদের দিকেও, সে মনে করায় এই ডুবে যাওয়া আর ভেসে থাকার অবিরাম লীলা আমাদেরও নিয়তি। এ আমাদের স্বোপার্জিত নিয়তি।
চারপাশে আগ্রাসী হাতের ভিড়ে যখন স্বগত কথনে লিপ্ত হচ্ছে রজত, সেই দৃশ্যায়ন আলগোছে টোবি ম্যাগুয়ার অভিনীত স্পাইডারম্যান-২ ছবির ডক্টর অক্টোপাসের কথা মনে করায়। রজত কি ফিরে পাবে নিজেকে? নিজের হাতের হাত থেকে কেড়ে নিতে পারবে প্রকৃত নিজেকে? মানুষকে সবসময়ই নিজের সত্যের শিকার হতেই হয়, বলেছিলেন আলবেয়ার কাম্যু। সত্য কী? সত্য তো এই আনসেন্সর্ড সত্তা, যা একাধারে কদর্য এবং বিশুদ্ধ। সমস্ত কিছুর থেকে আচমকা লম্বা, আদিগন্ত দেখায় মানুষের অবাধ্য হাতকে। সত্যের অন্ধকার, ঠাণ্ডা, সবুজ গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে এসেছে যে।
........................
.................................
#অশোকনগর নাট্যমুখ #মিঃ রাইট #মোহিত চট্টোপাধ্যায় #সিলি পয়েন্ট