মঁসিয়ে ভের্দু : অ-চ্যাপলিনোচিত চ্যাপলিন
ছবি: মঁসিয়ে ভের্দুচিত্রনাট্য ও পরিচালনা: চার্লি চ্যাপলিনশ্রেষ্ঠাংশে: চার্লি চ্যাপলিন, মেরিলিন ন্যাশ, মার্থা রে, ম্যাডি কোরেল প্রমুখ
চার্লি চ্যাপলিন— নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভাগ্যের হাতে বারংবার ঠোক্কর খেয়ে চলা অসহায় সেই ভবঘুরে চরিত্রটি। সেই কমিক চরিত্র চ্যাপলিনের সঙ্গে এমন একাকার হয়ে গেছে যে সিনে-প্রেমীদের খেয়ালই থাকে না, বা অনেকে ভাবতেই পারেন না চার্লি অন্য কোনওরকম চরিত্রেও অভিনয় করে থাকতে পারেন। সেই কারণেই চার্লির অন্যতর ছবিগুলি সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি। যেমন 'মঁসিয়ে ভের্দু'। চার্লির ফিল্মোগ্রাফিতে এটি একেবারে অন্য ধারার একটি ছবি। এখানে তিনি একজন কেতাদুরস্ত ধূর্ত ব্যবসায়ী, অর্থের লোভে নরহত্যায় যাঁর বিন্দুমাত্র কুন্ঠা নেই।
প্রথমে 'লেডি কিলার' নামটি ঠিক করা হলেও পরে সেটা বদলে ছবির নাম রাখা হয় 'মঁসিয়ে ভের্দু'। অরসন অরওয়েলসের একটি লেখাকে অবলম্বন করে চ্যাপলিন এই কাহিনিচিত্রটি রচনা করেন। প্রায় দুবছর ধরে তিনি 'মঁসিয়ে ভের্দু'-র চিত্রনাট্য প্রস্তুত করেছিলেন। ১৯৪৬ সালের গ্রীষ্মকালে এর শুটিং শুরু হয় এবং ১৯৪৭ সালের ১১ এপ্রিলে ছবিটি মুক্তি পায়।
কাহিনির মূল চরিত্রটির নাম অঁরি ভের্দু, ওরফে মঁসিয়ে ভের্দু। সিনেমাটির প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় একটি সমাধিফলক, যাতে লেখা রয়েছে 'অঁরি ভের্দু' : ১৮৮০-১৯৩৭। নেপথ্যকন্ঠ মারফত জানা যায়, ১৯৩০-এর বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা-র আগে অঁরি ভের্দু একটি ব্যাঙ্কে কেরানির কাজ করতেন। মহামন্দার প্রভাবে আর্থিক সংকট দেখা দিলে স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তিনি অর্থোপার্জনের একটি নতুন পন্থা খুঁজে বের করেন। তিনি বেছে বেছে ধনী মহিলাদের বিবাহ করতেন এবং তারপর তাঁদের হত্যা করে সমস্ত টাকাপয়সা নিয়ে তিনি চম্পট দিতেন।
বলাই বাহুল্য, মঁসিয়ে ভের্দু হওয়ার জন্য চ্যাপলিন নিজেকে প্রচুর ভাঙচুর করেছিলেন। কমেডি যে ট্রাজেডিরই লংশট - এই বিখ্যাত উক্তি তো তাঁরই। ফলে চলচ্চিত্রটির নামভূমিকাতেই বলা হয়েছে—"A Comedy of Murders"। চার্লি নিজে বলেছেন যে বর্তমান লোভী জঙ্গি বিকলাঙ্গ সভ্যতাকে বিদ্রুপ করার জন্যই তিনি এই চলচ্চিত্রটি বানিয়েছেন। এই বিকলাঙ্গ সমাজের প্রতীক হলেন মঁসিয়ে ভের্দু। তাঁর কথায়, মঁসিয়ে ভের্দু বিশ্বাস করেন, ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির অনিবার্য ফল হলো নরহত্যা। একসময় ভের্দুর মনে অনেক স্বপ্ন থাকলেও, আজ সেসব মৃত। ভের্দু তাই নৈরাশ্যবাদী। আর সেখান থেকেই তাঁর মনোবিকলন।
অর্থের জন্য নিরবচ্ছিন্ন নারীহত্যা— তৎকালীন সময়ে চ্যাপলিন-প্রেমীদের কাছে এরকম স্ক্রিপ্ট ছিল একটি অভাবনীয় ঘটনা। যে ছবিগুলির জন্য তাঁর ‘চার্লি চ্যাপলিন’ হয়ে ওঠা, তাদের মেজাজের সঙ্গে একেবারে বিপ্রতীপ এই ছবির মেজাজ। ১৯৩১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'সিটি লাইটস্'-এ এক অন্ধ নারীর প্রতি চ্যাপলিনের যে মায়া, মমতা, স্নেহ ও ভালোবাসা ফুটে উঠেছে, তার বিপরীতে মঁসিয়ে ভের্দুর এই নিরবচ্ছিন্ন নারীহত্যা নিঃসন্দেহে চ্যাপলিন-প্রেমীদের আবেগে জোর ধাক্কা দিয়েছিল। নিন্দা ও প্রশংসা— দুই-ই জুটেছে 'মঁসিয়ে ভের্দু'-র কপালে। অনেক সমালোচক বলেছিলেন, চলচ্চিত্রটিতে সরাসরি মনুষ্যত্বকেই আক্রমণের নিশানা করা হয়েছে। আবার অন্যান্য সমালোচকেরা বলেন, 'মঁসিয়ে ভের্দু'-ই চার্লি চ্যাপলিনের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র। কয়েকটি জায়গায় 'মঁসিয়ে ভের্দু'র মুক্তিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে এ ছবির ব্যবসায়িক সাফল্যও আশানুরূপ ছিল না।
তবে চার্লি চ্যাপলিন যে কত মহৎ একজন চলচ্চিত্র-নির্মাতা ছিলেন, এমন একটি ছবির পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তই তার প্রমাণ। নিজের পাকাপোক্ত সেলেব্রিটি ইমেজকে কেউ সাধ করে এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে না, যদি না জাত-শিল্পীর খিদে থাকে তাঁর মধ্যে।
#Monsieur Verdoux # Charlie Chaplin #serial killer #Martha Raye #William Frawley #Marilyn Nash #মঁসিয়ে ভের্দু #চার্লি চ্যাপলিন #ফিল্ম রিভিউ #Film Review