চিকিৎসাবিজ্ঞানের গল্পঃ আধুনিক ভারতের প্রথম শবব্যবচ্ছেদ
‘ম্লেচ্ছ, ম্লেচ্ছ, ম্লেচ্ছ’- সারা শহর জুড়ে রব উঠল। “সনাতন হিন্দু ধর্মের আর কিছু বাকি রইল না”! কলকেতায় একটা হাসপাতাল তৈরি হয়েছে ঠিকই। সাহেবরা বানিয়েছে। বড়সড় রোগশোক হলে সেখানে যাও; সাহেব ডাক্তার দেখিয়ে এস বাপু। তা নয়, নিজেরাই ডাক্তারি করবে! কেন, আমাদের সনাতন আয়ুর্বেদ কি দোষ করল? শুধুই কী তাই! ডাক্তারি না হয় শিখল, তাই বলে হিঁদুর ঘরের ছেলে হয়ে মড়া কাটা! সংস্কৃত কলেজের মধু কোবরেজ হয়েছে এ দলের নেতা। এ নির্ঘাত ডিরোজিও নামে ফিরিঙ্গি ছোঁড়াটার উস্কানি! দোর্দন্ডপ্রতাপ রাজা রাধাকান্ত দেব তাঁর পারিষদদের নিয়ে নেমে পড়লেন মাঠে।
১৮৩৫ সাল। কোম্পানীর আমল। রামমোহন রায় গত হয়েছেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তখনও দিগন্তে উদিত হন নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার ঠিক করল কলকাতায় একটা মেডিক্যাল কলেজ তৈরি করবে। বিলেত থেকে ডাক্তার আনতে অনেক বেশি টাকা মাইনে দিতে হয়। তারা বেশিদিন থাকেও না। কলকাতা শহর বড় হচ্ছে, অথচ, ইউরোপীয় এবং দেশীয় ধনীদের চিকিৎসার ভালো ব্যবস্থা নেই। স্থানীয় ভারতীয়দের আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি চিকিৎসাশাস্ত্রে দীক্ষিত করার জন্য যথাক্রমে সংস্কৃত কলেজ ও কলকাতা মাদ্রাসায় দেশীয় চিকিৎসকদের ট্রেনিং স্কুল তৈরি করা হল ১৮২২ সালে।
বেশ চলছিল আয়ুর্বেদিক শিক্ষা। ইতিমধ্যে সংস্কৃত কলেজে বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন মধুসূদন গুপ্ত নামে এক সংস্কৃত পণ্ডিত। মধূসূদন আদতে বৈদ্যবাটীর বিখ্যাত বৈদ্য পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতামহ ছিলেন হুগলীর নবাবের পারিবারিক চিকিৎসক। সুতরাং, চিকিৎসা মধুসূদনের রক্তে। তাই শুধুমাত্র টুলো পন্ডিত হওয়া তাঁর সইল না; বাড়ির অমতে ১৮২৬ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজে আয়ুর্বেদ ক্লাসে ভর্তি হলেন। তারপরে উল্কার গতিতে উত্থান। ওখানেই ছাত্র থেকে শিক্ষক হলেন, পন্ডিত উপাধি পেলেন। কলকাতার সায়েবসুবো মহলে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল।
সফল মানুষের যা হয়, সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত একদল লোকের ঈর্ষার শিকারও হয়ে পড়লেন। সংস্কৃত কলেজ থেকে বিদায় আসন্ন হয়ে উঠল। কিন্তু মধুসূদনের উপর ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন ছিলেন চিরকাল। বড়লাট লর্ড বেন্টিঙ্কের উৎসাহে এবং গ্র্যান্ট, সাদারল্যান্ড ও ব্র্যামলে সাহেবের নেতৃত্বে কলকাতার বুকে স্থাপিত হল এশিয়ার প্রথম মেডিক্যাল কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ বেঙ্গল। সঙ্গে ছিল বাবু রামকমল সেনের প্রত্যক্ষ এবং রাজা রাধাকান্ত দেবের পরোক্ষ উদ্যোগ। সেটা ১৮৩৫ সাল। কলেজ শুরু হল ৪৯ জন ছাত্র নিয়ে। পরে তা সরে এলো বাবু মতিলাল শীলের দান করা জমিতে। সাগর পেরিয়ে বিলেতেও কলেজের নাম ছড়িয়ে পড়ল। এইসময় পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব পেলেন। তিনি ইউরোপীয় চিকিৎসা পদ্ধতিতে শিক্ষিত না হলেও তাঁর ছিল প্রখর বুদ্ধি ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে গভীর জ্ঞান। শারীরবিদ্যা পড়াতে গিয়ে দেখলেন কিসের যেন অভাব! শুধু পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে শারীরবিদ্যার সঠিক জ্ঞান আহরণ অসম্ভব। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও শিরা-ধমনী-স্নায়ুর সঠিক অবস্থান না জানলে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তাহলে উপায়?
নজরে থাকুক
উপায় আছে। অ্যানাটমি টেবিলে মৃত মানুষের শরীর ব্যবচ্ছেদ করে শিখতে হবে শারীরবিদ্যা। উপযুক্ত সংখ্যক শবের অভাবে যা শিখতে ব্রিটেনের ডাক্তাররা পর্যন্ত পাড়ি দেন ফ্রান্সে! কিন্তু এদেশে তো বেওয়ারিশ শবের অভাব নেই, অভাব সমাজ চেতনার। যা ভাবা তাই কাজ, কয়েকজন ছাত্র ও সহকর্মীদের নিয়ে মধুসূদন উদ্যোগ নিলেন শবব্যবচ্ছেদের।
ওদিকে, রাজা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে রুখে দাঁড়ালেন বঙ্গ সমাজপতিরা। বন্ধ করতেই হবে এ অনাচার। মধু গুপ্তের নেতৃত্বে মেডিকেলের ছাত্ররাও এককাট্টা। ডেভিড হেয়ার দু-দলের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে রাজি হলেন এ বিষয়ে। হেয়ার সাহেব এবং রাধাকান্ত দেবের একান্ত আলোচনায় রাধাকান্ত দেব বললেন যে, তাঁরা ছাত্রদের শব ব্যবচ্ছেদে অনুমতি দেবেন এক শর্তে- সনাতন ভারতীয় শাস্ত্রে শবব্যবচ্ছেদের সমর্থনে সূত্র খুঁজে দেখাতে হবে। কে খুঁজবে এসব? কে একইসঙ্গে সংস্কৃতশাস্ত্র ও শারীরবিদ্যায় পন্ডিত? বিপদে পড়লে মানুষ বলে, ‘ত্রাহি মধুসূদন!’। এক্ষেত্রেও অন্যথা হল না। রাতের পর রাত জেগে পণ্ডিত মধু গুপ্ত খুঁজে চলেছেন সেই সংস্কৃত শ্লোক ও সূত্র- যা সমর্থন করে শবব্যবচ্ছেদকে।
একদিন ডেভিড হেয়ার ঠেকে পাঠালেন মধুসূদনকে।
“তোমার অনুসন্ধান কতদূর?”
“আমি তৈরি। ডাকুন সমাজপতিদের”।
সমাজপতিদের আর ডাকতে হল না। মধুসূদনের শাস্ত্রজ্ঞানের খবর পেয়ে তাঁরা বাধা দেওয়া সমীচীন বোধ করলেন না।
শারীরবিদ্যার ছাত্ররা তৈরী হল শবব্যবচ্ছেদের জন্য। কিন্তু কে প্রথম স্ক্যালপেল চালাবে শবদেহের উপরে? এবারও সেই মধুসূদন গুপ্ত। তারিখটা ছিল ১০ই জানুয়ারি, ১৮৩৬। অ্যানাটমি বিভাগে সেদিন সাজো সাজো রব; কথিত আছে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর নিজে উপস্থিত ছিলেন শবব্যবচ্ছেদের সময়। ডাঃ হেনরি গুডিভ ছুরি তুলে দিলেন ডাঃ মধুসূদন গুপ্তের হাতে; শ্বেতাঙ্গ শাসিত দেশে এক ভারতীয়র জন্য এ এক অবিশ্বাস্য সম্মান! তিনি আরও চারজন দেশীয় ছাত্রের সহায়তায় আত্মবিশ্বাস ও সাফল্যের সঙ্গে একাজ সম্পন্ন করলেন। তাঁর হাতেই তৈরি হল ইতিহাস – আধুনিক ভারতবর্ষের প্রথম শবব্যবচ্ছেদ হল মেডিক্যাল কলেজে। মহাঋষি সুশ্রুত-এর তিন হাজার বছর পরে আবার ভারতবর্ষে শারীরবিদ্যার গবেষণা শুরু হল।
কিন্তু সন্দেহ ও সংস্কারের মাথাচাড়া দেওয়ার প্রবণতা বরাবরের; কানাঘুষো, গুজব, বিরোধিতা – সবই চলছিল। শেষ পর্যন্ত বেথুন সাহেবের অনুরোধে এবং নবদ্বীপের মহারাজার সভাপতিত্বে বাংলার গভর্নর এক বিতর্কসভার আয়োজন করলেন। সেখানে সমাজপতি ও সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের সামনে ডাঃ মধূসুদন গুপ্ত শবব্যবচ্ছেদের সমর্থনে ভারতীয় শাস্ত্রীয় নথি তুলে ধরে টিকিধারী অপপ্রচারকদের মুখ বন্ধ করলেন। মধূসুদনের সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন রামতনু লাহিড়ী ও রামগোপাল ঘোষের নেতৃত্বে গোটা ‘ইয়ং বেঙ্গল গ্রুপ’। বেথুন সাহেবের অনুরোধে পণ্ডিত ডাঃ মধূসুদন গুপ্তের একটি অসামান্য তৈলচিত্র আঁকেন শিল্পী এস. সি. বেলনোস, যেটি এখনও মেডিক্যাল কলেজে সংরক্ষিত আছে। কথিত আছে, শবব্যবচ্ছেদের এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে সেদিন উপর্যুপরি তোপধ্বনি হয়েছিল। শিবনাথ শাস্ত্রী, ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ এই ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গেছেন। প্রথম বছর ষাটটি শবব্যবচ্ছেদ হয়। তার পরের বছর এর দ্বিগুণ এবং ১৮৪৮ সাল অবধি প্রায় ৫০০ শবব্যবচ্ছেদ সংগঠিত হয়েছিল বলে লিখেছেন ডাঃ হেনরি গুডিভ। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের যেটুকু সুফল আজ আমরা আঁজলা ভরে পান করছি, তা বহুলাংশে এই বাঙালির উদ্যোগ আর উদ্দীপনার কলসধারা। একজন মানুষ, যিনি প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য এবং বিজ্ঞানের আশ্চর্য, দুইয়ের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল – এমন মহীরূহের বড় অভাব এই দেশে, এই সময়ে।
তথ্যসূত্রঃ
1. Debasis Bose. Madhusudan Gupta: Indian journal of history of science; 29(1), 1994
2. Jayanta Bhattacharya. The hospital transcends into hospital medicine: A brief journey through ancient, medieval and colonial India. Indian journal of history of science; 52.1(2017). 28-53
3. Ranjit Panja, Arati Ghosh. Calcutta Medical College; National Medical Journal of India, Vol 2, No 5, 244.
4. Wikipedia : Madhusudan Gupta
কভার ছবিসূত্রঃ উইকিমিডিয়া কমন্স