গল্পের স্বত্বের জন্য 'এক কাপ চা' দাম হেঁকেছিলেন মনোজ বসু
মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন লেখকই হবেন। কারণ তাঁরা ইহজগতের মায়া কাটালেও তাঁদের সাহিত্য থেকে যায় অমলিন। এই ভাবনা থেকেই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। প্রথমে কবিতা তারপর গল্প।অধিক আত্মবিশ্বাসে পাঠিয়েও দিলেন প্রথিতযশা পত্রিকার অফিসে। তিন-অক্ষরী জবাব এলো প্রতিবার! “ছাপানো যাইবে না।” ছেলেমানুষ লেখক ভেবেছিলেন হাতের লেখার অস্পষ্টতার জন্যেই বুঝি বা ছাপা হচ্ছে না,নয়তো গল্পগুলো খুবই উঁচু দরের। তাই সহপাঠী কালিকে আধসের জিলিপি খাইয়ে রাজি করানো গেল,পাকা হাতের লেখায় কপি করে দেওয়ার জন্য। জবাব এবারেও এল, তবে ভাষা পালটে - “লেখাটি বিবেচনাধীন রহিল।” পরে ফিরিয়ে দেওয়া সেই লেখার পাণ্ডুলিপি লেখক উদ্ধার করেছিলেন পোস্টমাস্টারের গৃহসংলগ্ন মুদির দোকানে। এভাবেই শুরু হয়েছিল বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মনোজ বসুর লেখালিখির জগৎ।
লেখকই হবেন এ বিষয়ে তিনি ছিলেন একশো শতাংশ নিশ্চিত। তবে জীবনের এক পর্যায়ে দারিদ্র তাঁর পড়াশোনা প্রায় অনিশ্চিত করে ফেলেছিল। অবশেষে ১৯২৪ সালে আশুতোষ কলেজ থেকে বি.এ পাশ করে কোলকাতার সাউথ সুবার্বন স্কুলে জুটিয়ে নিলেন শিক্ষকতা। কিন্তু লেখক হওয়ার ইচ্ছা তখনও মরেনি। টেক্সট বুক লিখেই শুরু হল হাত মক্সো করা। বইগুলো প্রকাশ করার জন্য খুলে ফেললেন 'বেঙ্গল পাবলিশার্স'। এরপর আবার গল্প প্রকাশের গল্প। এবার বিচিত্রা পত্রিকা। ইতিমধ্যেই ১৩৩৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'নতুন মানুষ'। এবার 'বাঘ' নামে আরেকটি গল্প। জানা গেল সেটিও ছাপা হবে শিগ্গির। পারিশ্রমিকও নাকি মিলবে। কত, তা থোড়াই কেয়ার মনোজবাবুর। ছাপা হবে এই ঢের। তাও এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে গেলেন পত্রিকার অফিসে। সাহিত্যিকদের আড্ডার মাঝে কথাখানা পাড়লেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত সেদিন। জানতে চাইলেন কোন লেখা? কারণ লেখক আসার আগে ইতিমধ্যেই তাঁর গল্পের গুণকীর্তন করছিলেন এঁরা সকলে মিলে। মুহূর্তে জায়গা মিলল ওই টেবিলে,কচুরি আর সাহিত্যিক তর্কে ভাগ বসানোর অধিকারও জুটল। দক্ষিণ কোলকাতার কালিদাস রায়ের বাড়িতে বসত এমন আড্ডা। নাম রসচক্র। একদিন আয়োজিত হয়েছে যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সংবর্ধনা সভা। ছিলেন নজরুল ইসলাম,অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত,হেমেন্দ্রকুমার রায় আরও অনেক দিগগজ সাহিত্যিক। আহারপর্ব মিটে যাওয়ার পর যখন সকলে বাগানে হাঁটতে বেরিয়েছেন, হঠাৎ কালিদাস রায় মনোজ বসুকে বললেন,
"হ্যাঁরে তুই তো বনজঙ্গল নিয়ে লিখিস। নিজেকে বলিস গাঁয়ের ছেলে। বাতাবি লেবু পাড়তে পারিস?"
তৎক্ষণাৎ মনোজবাবু জামা খুলে, ধুতি গুটিয়ে অসংখ্য কাঁটাতারকে তোয়াক্কা না করে গাছে উঠে বাতাবিলেবু পেড়ে আনলেন। মুখের মতো জবাব হল। এমনই সরল,সাদাসিধে ছিলেন মনোজবাবু। বাংলাদেশের যশোর জেলার ডোঙ্গাঘাট গ্রামের জন্মভিটের পরশ ছিল তাঁর লেখার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই শহুরে আধুনিক লেখকরা তাঁর নাম অর্থাৎ মনোজ বোসকে,‘বনজ মোষ’ বলে খ্যাপালেও তিনি রাগ করতেন না। তবে এরকম বিদ্রূপ তাঁর জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হওয়া আটকাতে পারে নি। ১৯৪২ সালে তাঁর লেখা উপন্যাস 'ভুলি নাই' নিয়ে তৈরি হল সাড়া জাগানো দেশাত্মবোধক ছবি। ছবির বিজ্ঞাপনে লেখা হয় - "স্বাধীনতার বেদীমূলে আত্মাহুতি দিয়ে ঘুমন্ত দেশকে যারা জাগিয়ে তুলেছিল তাদের উদ্দেশে শ্রদ্ধাঞ্জলি।" মনোজ বসুর কাহিনি নিয়ে নিজের প্রযোজনায় ছবিটি পরিচালনা করেন হেমেন গুপ্ত। এরপর আরেক খ্যাতনামা পরিচালক তরুণ মজুমদার তাঁর 'আংটি চাটুজ্যের ভাই' গল্পটি নিয়ে বানালেন সুপারহিট বাংলা সিনেমা ‘পলাতক’। মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল মনোজ বসুর নাম।এর কয়েকদিন পর,তরুণবাবুর পছন্দ হয়েছে ওঁর আরেকটি গল্প,‘একটুকু বাসা'। স্বত্ব কেনার জন্য হাজির হয়েছেন মনোজবাবুর বাড়ি। মনোজবাবু অদ্ভুত গাম্ভীর্যে শুনলেন সবটা। তারপর অমনোজচিতভাবে বলে বসলেন এবার আর নামমাত্র মূল্যে গল্পস্বত্ব বিক্রি করবেন না তিনি। গতবার ক্ষতি হয়েছে তাঁর। শুনে মাথায় হাত পরিচালকের। ছবির বাজেট সীমিত।তাও একরকম মরিয়া হয়েই তরুণবাবু জিজ্ঞাসা করে ফেলেন কত আশা করেন লেখক। এতেও রহস্য উন্মোচিত হয় না,বরং রাইটিং প্যাড টেনে এনে মনোজবাবু বলেন “মুখে বলব না।কাগজে লিখে দিচ্ছি।একেবারে পাকাপাকি বন্দোবস্ত।” অবশেষে দুরুদুরু বক্ষে চিরকূটটি হাতে নিয়ে দেখা গেল তাতে লেখা তিনটি অক্ষর। না,কোনও অর্থমূল্য নয়। একটিমাত্র অনুরোধ। এক কাপ চা। 'আংটি চাটুজ্যের ভাই' গল্পটাকে যেভাবে তরুণবাবু জনসমাদৃত করে তুলেছেন,তাতেই নাকি কৃতজ্ঞ লেখক। তাই ‘একটুকু বাসা’ গল্পটি সামান্য উপহার। পরে ১৯৬৫ সালে সৌমিত্র ও সন্ধ্যার অভিনয়ে আমজনতা দেখবে সে ছবি। তরুণবাবু নিজের স্মৃতিচারণায় লিখেছেন - “কোথায় পাব এমন উদার হৃদয় মানুষদের? আজকাল এই বিষয়ী,হিসেবী লোকজনদের ভিড়ে তারা কি এখনো লুকিয়ে আছেন এখানে সেখানে,কোণঠাসা হয়ে?নাকি বহুলুপ্ত প্রজাতির মতো হারিয়ে গেছেন চিরদিনের মতো?”
.......................
কৃতজ্ঞতা -
১) মনোজ বসু : জীবনী ও সাহিত্য, দীপক চন্দ্র
২) গল্প লেখার গল্প, জ্যোতিপ্রকাশ বসু (সম্পাদিত)
৩) সিনেমাপাড়া দিয়ে, তরুণ মজুমদার
#মনোজ বসু #সাহিত্যিক #silly পয়েন্ট