ফিরে দেখা: কলকাতার হাড়গিলে
“হাড়গিলে?”“সাড়ে চার ফুট লম্বা পাখি। রাস্তায় ময়লা খুঁটে খুঁটে খেত। এখন যেমন দেখছেন কাক চড়ুই, তখন ছিল হাড়গিলে। গঙ্গার জলে মড়া ভেসে যেত, তার উপর চেপে দিব্যি নৌসফর করত।” - ফেলুদা উবাচ (গোরস্থানে সাবধান, সত্যজিৎ রায়)
কভারের ছবিটা দেখেছেন অবশ্যই? এবার চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করুন তো, কলেজ মোড়ের সিগন্যালে গাড়িটা দাঁড়িয়ে, আপনি হয় চালকের নয়তো সওয়ারির সিটে বসে দেখছেন, পাশের ডিভাইডারে একটা হাড়গিলে একমনে একটা মরা কাক ঠুকরে খাচ্ছে। কিংবা, মেহতা বিল্ডিংয়ের উল্টোদিকের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছেন এক কাপ চা হাতে, হঠাৎ হুউশ্ করে ডানা ঝাপটিয়ে এক হাড়গিলে এসে ল্যান্ড করলেন আপনার সামনে, হাইটে এই আপনার কাঁধের সমান। অস্বস্তি হচ্ছে তো? অথচ কলকাতার পুরাতনী কথা উঠলেই এই পাখির কথা আসাটা প্রায় রিচুয়াল। স্বয়ং সত্যজিৎ ‘গোরস্থানে সাবধান’ ছাড়া ‘স্পটলাইট’ গল্পেও পুরোনো কলকাতা প্রসঙ্গে এই একই দৃশ্যকল্পের আশ্রয় নিয়েছেন। মানে, জোব চার্নক আর কলকাতা পরপর বললে তৃতীয় যে নামটা চলে আসে সেটা সম্ভবত হাড়গিলে।
ব্যস্ত গড়িয়াহাটের ভিড়ের পাশে কতিপয় হাড়গিলের দৃপ্ত পদচারণা নিয়ে আপনি যতই সন্ত্রস্ত হন না কেন, আদপে এই পাখিটি অত্যন্ত নিরীহ। অমন ভয়াল চঞ্চুধারী হলে কী হবে, আপনি হ্যাট হ্যাট করলে সে তাড়াতাড়ি পালাতে পারলে বাঁচে। প্রত্যাঘাত হাড়গিলের ডিকশনারিতে নেই। নেই বলেই হয়তো তারা আজ অবলুপ্তপ্রায়। উনিশ শতকের শহরেও এদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো, কিন্তু নগরায়ণের হাত ধরে আরও অনেক কিছুর মতোই হাড়গিলে বিদায় নিয়েছে। এ এক আশ্চর্য জাঁতাকল, উন্নতি আর প্রকৃতি যেন দুই সৎ বোন! জনজীবন যত সভ্য হয়েছে, জনপদের বর্জ্য নিষ্কাশন যত উন্নত হয়েছে, শকুন, হাড়গিলে ইত্যাদি ময়লাখেকো পাখিরা ধীরে ধীরে পাততাড়ি গুটিয়েছে। সারভাইভ্যাল অফ দি ফিটেস্টের তালিকায় থাকতে পারলে শিশুপাঠ্যের বইতে ঝাড়ুদার পাখির পাশে কাক নয়, হাড়গিলের ছবিই স্থান পেত। উইলিয়াম ও থমাস ড্যানিয়েলের বিখ্যাত নিসর্গচিত্রে আঠারো শতকের শেষভাগের কলকাতার যে ছবি উঠে এসেছে, সেখানে হাড়গিলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিদ্যমান। ব্রিটিশরা এই পাখিটির দক্ষতাকে বরাবর একজন সাফাইকর্মীর তুলনায় বেশি নম্বর দিয়েছে। কলকাতা শহরে তখন যে পরিমাণ জঞ্জাল যত্রতত্র জমে থাকত, তা সাফ করার জন্য একঝাঁক হাড়গিলের তৎপরতা শাসকদের কাছে শুধু প্রয়োজনীয়ই মনে হয়নি, প্রশংসিতও হয়েছে! লক্ষণীয় এই যে, নোংরা, গরম এবং ম্যালেরিয়ার ভয়ে ত্রস্ত ব্রিটিশকুল হাড়গিলের ওই বদখত উপস্থিতিকে সাদরে গ্রহণ করেছিল, ‘নেটিভ বার্ড’ বলে ঝাড়েবংশে উচ্ছন্ন করতে ছোটেনি। এমনকি ড্যানিয়েলদের কলকাতা ভ্রমণেরও একশো বছর পরে, ১৮৯৬ সালে, যখন কলকাতা পুরসভার প্রতীক বা এমব্লেম বানানো হয়, তাতেও হাড়গিলের ছবি ঠাঁই পেয়েছে। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত College of Arms-এর তৈরি সেই নকশায় দুটি হাড়গিলে পাখি দুইদিক থেকে মূল লোগোটিকে তুলে ধরে রেখেছে। এখন যদিও এই প্রতীক ব্যবহৃত হয় না, তবে উৎসাহী মাত্রেই পুরোনো হগ মার্কেটের মাথায় এই হাড়গিলেদের দেখা পাবেন। দুটো ব্যাপার এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়– সাফাইয়ের একাধিক দৃষ্টিনন্দন উপকরণ থাকলেও বাস্তব গুরুত্বকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, এবং একশো বছর পেরিয়েও হাড়গিলের প্রতিপত্তি সমান ভাবে বজায় আছে।
আরও পড়ুন
তাহলে পরবর্তী একশো বছরে এদের সুখী সংসারে এমন যবনিকা পতন হল কীভাবে? নগরায়ণ এই প্রশ্নের একটা দিকনির্দেশ মাত্র, মূল উত্তর নয়। শহরে-গ্রামে জঞ্জাল সামলানোর কাজ সুচারু ভাবে হওয়াতে তাদের খাবারে টান পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু ধাপার মতো বিভিন্ন জঞ্জালের আড়তকে কেন্দ্র করে এই পরিবেশচক্রের নতুন শুরুয়াত হতে কোনও বাধা থাকার কথা নয়। বাধা এসেছিল আমাদের অপরিণামদর্শিতার হাত ধরেই। কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক এবং গবাদিখাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার একটা সময় শকুন ও হাড়গিলের মতো শবভোজী পাখিদের পাচনতন্ত্রে মিশে তাদের শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ায় মারাত্মক প্রভাব ফেলতে থাকে। ধীরে ধীরে তাদের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হতে থাকে এবং আজ কেবলমাত্র আসাম ও কম্বোডিয়ায় হাড়গিলের স্বাভাবিক প্রজননের খবর পাওয়া যায়। পুরোনো কলকাতার নস্টালজিয়া চুলকাতে বসলে এই একটি ট্র্যাডিশন ফিরিয়ে আনার কথা কেউ ভুলেও তুলবেন না, কিন্তু এদের না থাকা যে পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক, অন্য আরও অনেক কিছুর মতোই, সেটা বোঝার জায়গায় আমরা এখনও আসতে পারিনি। নাহ্, কবির ভাষায় “দাও ফিরে সে অরণ্য...” বলে সাউথ সিটির মাথায় হাড়গিলে দেখার জন্য হাহাকার অবশ্যই করব না। কিন্তু তাদের উপস্থিতি হয়তো জৈব বর্জ্যের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গবাদি পশুর ভ্যাটে, ধাপার মাঠে, এমনকি সুন্দরবনের অগম্য অঞ্চলে কম খরচে পরিবেশবান্ধব প্রয়োগের এক পরিবর্ত ধারার জন্ম দিতে পারত।
[পোস্টার : অর্পণ দাস।]
#কলকাতা #পুরনো কলকাতা #হাড়গিলে #সায়নদীপ গুপ্ত #ফিচার #পাখি