দুঃখ ভোলানোর ম্যাজিক জানতেন লীলা মজুমদার
আগে কখনও বড়োদের জন্য কিছু লেখেনি মেয়েটি। পড়াশোনা করেছে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে, এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। কিন্তু এ কথা বহুদিন আগেই মনে মনে স্থির হয়ে গেছে যে তাকে লিখতে হবে বাংলা ভাষাতেই, আর সে লিখবে ছোটোদের জন্য। যাঁর কথায় প্রথম সচেতন ভাবে লেখার চেষ্টা, সেই মানুষটি ততদিনে হারিয়ে গেছেন। হঠাৎ করেই। কিন্তু যাবার আগে নিজের প্রথম বই, যার নাম ‘আবোল তাবোল’, তার ছবিতে তুলি বোলাতে বোলাতে বলে দিয়েছেন, “তুইও এসব করবি, কেমন?” পনেরো বছরের লীলা তখন থেকেই জানে, বড়দা যে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, তা-ই তার আগামী জীবনের গন্তব্য। আসলে ছোট্টবেলায় বড়দার বাড়িতে এসেই সেই যে তার মনে হয়েছিল, “নিচে প্রেস চলত, তার একটানা ঝমঝম শব্দ কানে আসত, মনে হত বাড়িটা বুঝি দুলছে, যে কোন সময় পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে যাবে।” সেই ডানার ঝাপটা যার গায়ে লাগে, সে কি আর তিষ্ঠুতে পারে?
কেবল লেখায় নয়, সারা জীবন জুড়েই লীলার বুকে বাসা বেঁধে থাকবে সেই অদৃশ্য ডানা। প্রথমবার বড়োদের জন্য লেখা, ‘শ্রীমতী’। উপন্যাস। এক মেয়ের বারবার ঠাঁইনাড়া হওয়ার গল্প? কিন্তু সে তো হাঁপিয়ে পড়ে না। আবার ঘরের প্রতি বিশ্বাসও হারায় না। দায়িত্ব এড়ায় না, কেবল অবাঞ্ছিত সীমায়তিকে অনায়াসে সামলে নিয়ে বলে, “আমার অন্তর যে শিকল মানে না, কেমন করে থাকি?” নিজেকে এমন স্পষ্ট করে চিনতে পারতেন বলেই তেইশ বছরের লীলা রায় একদিন কলকাতা শহর ছাড়তে পেরেছিলেন। তেইশ বছরের হৃদয়ের ক্ষণিক দুর্বলতা যে আদৌ তাঁর কাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক গড়ে তুলবে না, তা বুঝতে ভুল হয়নি তাঁর। তাই ডায়রির পাতায় দ্বিধাহীন স্বীকারোক্তি, “চলে না গিয়ে উপায় ছিল না।... ট্রেন ছেড়ে দিল, আমি আমার পুরনো জীবন থেকে শিকড়গুলো উপড়ে নিলাম।” আবার, দু-বছর পরে, যখন মনে হল খুঁজে পেয়েছেন যথার্থ সঙ্গীকে, গোঁড়া ব্রাহ্ম বাবার আপত্তি কানে তোলেননি। ব্রাহ্ম মতে বিয়ের বদলে নাম-সই-করা বিয়ে বাবা-মেয়ের মধ্যে যে দূরত্বের দেয়াল গড়ে দিয়েছিল, তা আর কখনও ভাঙেনি। ভাঙেনি লীলার নিজের বিশ্বাসের দুর্গও। শিকড় ছেঁড়ার কষ্টকে বহুদিন আগেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে শিখে গেছেন তিনি। প্রথম ছেড়ে আসতে হয়েছিল শিলং পাহাড়ের কোলে ফুলে ঘেরা ছোট্ট বাড়িটি। বাবার কর্মসূত্রে থাকা সেখানে, কিন্তু লীলার কাছে তা মায়ের বাড়ি, পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আস্তানা। সে ছেড়ে আসায় মনের সায় ছিল না। কলকাতায় এসে মাকে ছেড়ে, ভাইবোনদের ছেড়ে ডায়োসেশান স্কুলের হোস্টেলে থাকতে বাধ্য হওয়া। এইসব বাধ্যত ছেড়ে যাওয়া আসলে লীলাকে গড়ে নিচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। গড়ে নিচ্ছিল এমন এক মন, শিকড় উপড়ে নেওয়ার খেলায় জীবন যাকে কোনোদিন হারাতে পারবে না।
তাই, নিজের যখন ছেড়ে দেওয়ার প্রয়োজন হল, পিছুটান তাঁকে আপস করাতে পারেনি। ১৯৩১ সালে সম্পন্ন বাঙালি পরিবারের কুমারী যুবতি মেয়ের দার্জিলিংয়ে চাকরি করতে যাওয়া সহজ ছিল না। সহজ ছিল না ব্রাহ্ম স্কুলের রক্ষণশীলতার মধ্যে বাস করে উপাসনায় যোগ না দেওয়া। সেখান থেকে চলে এলেন শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে। রবীন্দ্রনাথ এবং শান্তিনিকেতনের লালিত্য ঘোর অপছন্দ ছিল প্রমদারঞ্জনের। বাবার অপছন্দের দায়িত্ব নেননি লীলা। বরং সাহেবি আদবকায়দায় অভ্যস্ত লীলা নিজেকে অনায়াসে মানিয়ে নিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের অনাড়ম্বর যাপনে। কিন্তু যখনই আহত হচ্ছিল নিজের মূল্যবোধ, সে জায়গা ছেড়ে আসতেও দুবার ভাবেননি। এমনকি রবীন্দ্রনাথ যে সহজে প্রভাবিত হতেন অন্যদের কথায়, এ অভিযোগও করেছেন নিঃসংকোচে। এমনকি, পরবর্তী কালে আকাশবাণীর দীর্ঘ কর্মজীবনে এক কথায় দাঁড়ি টেনে দিয়েছেন, এক ঊর্ধ্বতন কর্তার কোনও কথায়। দিল্লির মূল দপ্তর থেকে অনুরোধেও আর ফেরেননি ফেলে আসা জায়গায়।
আরও পড়ুন : আলোকশিল্পী তাপস সেনের স্ত্রী গীতা সেন : বাংলা নাট্যগানের প্রথম গবেষক
ব্যক্তিজীবনে কিন্তু ফিরতে চেয়েছিলেন লীলা। সকল রাগ-ক্ষোভ-অভিমানের হাত থেকে নিজের মনের ভালোবাসার প্রদীপটি বাঁচিয়ে রাখার ব্রত ছিল তাঁর। বিয়ের পরদিন সকালে বাবাকে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন সব কথা ভুলে। কিন্তু তাঁদের দেখেই ঘর থেকে উঠে চলে গিয়েছিলেন প্রমদারঞ্জন। শুধু সেদিনই নয়, তাঁর বাকি আঠেরো বছরের জীবদ্দশায় আর কখনও কথা পর্যন্ত বলেননি মেয়ের সঙ্গে। লীলা লিখছেন, “আঠেরো বছর পরে যখন তিনি চোখ বুজলেন, আমি এতটুকু ব্যক্তিগত অভাব বোধ করিনি। যে অভাব, যে বেদনা ছিল, ঐ সময়ের মধ্যে তার মৃত্যু হয়েছে, টের পেলাম।”
লীলা মজুমদার এখানেই অন্যরকম, যে, এইসব দুঃখেরা তাঁর পায়ের বেড়ি হয়ে উঠতে পারেনি। তিনি খোঁজ পেয়েছিলেন সেই গুণমণি গাছের, ছাইগাদায় না পুঁতলে যার ফুল ধরে না। “ও গাছ হল গিয়ে মানুষের মনের গুণের মতো। কষ্ট না পেলে ফুটে ওঠে না।” সেই খোঁজটাই আজীবন লেখার মধ্যে দিয়ে চারিয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি। চার দেওয়ালে মুখ গুঁজে থাকা ভূতের বোঝা-বওয়া মানুষেরা তাঁর লেখা পড়লে ঠিক পৌঁছে যেতে পারে সেই পেরিস্তানে। যেখানে বসে লীলা মজুমদার মিটিমিটি হেসে বলেন, “আসলে সারা জীবন ধরে এত ভালো ভালো জিনিস দিয়ে পৃথিবীটাকে ঠাসা থাকতে দেখেছি যে ভেবেছি ওরই মধ্যে দুঃখকষ্ট দূর করার ওষুধ রাখা আছে।”
.....................
#লীলা মজুমদার #জন্মদিন #শ্রদ্ধা #Leela Majumdar #Writer #সাহিত্যিক #রণিতা চট্টোপাধ্যায় #সিলি পয়েন্ট