লক্ষ্মণ আছেন, সীতাও আছেন, কিন্তু লক্ষ্মণরেখা নেই রামায়ণে
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটবেলার কথা লিখতে গিয়ে বলেছিলেন, তাঁর খাস চাকর তাঁকে একটা গণ্ডি কেটে তার মধ্যে বসিয়ে রাখত, আর ভয় দেখাত যে গণ্ডি ছেড়ে বেরোলে তাঁর অবস্থা হবে ঠিক সীতার মতো। ততদিনে রামায়ণের গল্প শোনা হয়ে গেছে তার মুখেই। সুতরাং লক্ষ্মণের কথা না শুনে গণ্ডি ছেড়ে বেরোনোর ফলে সীতার যা পরিণতি হয়েছিল, সে কথাও জানা। তাই এই ভয় দেখালেই আড়ষ্ট হয়ে যেত রবীন্দ্রনাথের শিশুমন।
বাস্তবিক, রামায়ণের যে ঘটনাগুলো মনে দাগ কেটে যায়, তার মধ্যে একটা অবশ্যই লক্ষ্মণরেখার গল্প। রাম গেলেন বনে, সঙ্গে গেলেন সীতা আর লক্ষ্মণ। বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা এসে পৌঁছলেন পঞ্চবটী বনে। এখানে থাকার সময়েই মারীচ রাক্ষস একদিন সোনার হরিণ সেজে হাজির হল সীতার সামনে, আর সীতাও পা দিলেন সেই লোভের ফাঁদে। প্রথমে রাম ছুটলেন হরিণের পিছু পিছু। তারপরে হরিণের মায়াকান্নায় ভুলে লক্ষ্মণকেও রামের খোঁজে পাঠাতে চাইলেন সীতা। লক্ষ্মণের তো উভয় সংকট! এদিকে রাম তাঁর দায়িত্বে সীতাকে রেখে গেছেন, এদিকে সীতার কথাও ফেলা যায় না। যুক্তিতর্কের ধার না মেনে সীতা রীতিমতো রাগারাগি জুড়ে দিলেন। কটু কথা বলতে শুরু করলেন লক্ষ্মণের উদ্দেশে, এমনকি লক্ষ্মণ সীতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছেন এমন সন্দেহও বাদ গেল না। অতএব, লক্ষ্মণ নিজের ধনুকের অগ্রভাগ দিয়ে একখানা গণ্ডি টানলেন তাঁদের পর্ণকুটিরের সামনে। সীতাকে পইপই করে বলে গেলেন, যেন কোনও কারণেই তিনি এই গণ্ডির বাইরে পা না রাখেন। কিন্তু ভিখারির বেশে রাবণ ছলচাতুরি করে সীতাকে ঠিক বাধ্য করলেন গণ্ডির বাইরে বেরোতে, আর তারপর কী হল সে তো সবাই জানে।
সীতাকে নিরাপদে রাখতে গণ্ডি টেনেছিলেন লক্ষ্মণ। যার নাম লক্ষ্মণরেখা। কিন্তু বাল্মীকির লেখা মূল রামায়ণে কি লক্ষ্মণরেখার কাহিনি আদৌ ছিল? এবারই কাহানি মে টুইস্ট! যে গণ্ডি পেরোনোর জন্য এত কিছু হয়ে গেল, আদতে নাকি সেই গণ্ডিটাই ছিল না! এ কি পি সি সরকারের ম্যাজিক, যে, একটা আস্ত গণ্ডি ভ্যানিশ হয়ে গেল? আজ্ঞে না। ভ্যানিশ হবে কেন, গণ্ডিটা যে ছিলই না কোনও দিন! পুরাণ-বিশেষজ্ঞ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বলছেন, বাল্মীকি এমন কোনও গণ্ডির গল্প বলেননি মোটেই। তাঁর লক্ষ্মণ কেবল সীতাকে রেখে গেছেন বনদেবতাদের ভরসায়। প্রার্থনা করেছেন, যাতে বনদেবতাই সীতাকে রক্ষা করেন। কিন্তু গণ্ডি কাটেননি।
বাল্মীকি রামায়ণে নেই। কম্বু রামায়ণেও নেই। এমনকি শিক্ষিত বাঙালির কাছে রামায়ণের যে দুটি অনুবাদ অত্যন্ত পরিচিত, রাজশেখর বসুর রামায়ণ এবং উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘ছেলেদের রামায়ণ’, সেখানেও গণ্ডির কথা নেই। লক্ষ্মণ সীতাকে বনদেবতার ভরসায় রেখে যাচ্ছেন এবং যেতে যেতে উদ্বেগ নিয়ে ফিরে তাকাচ্ছেন, এটুকুই। রাবণকেও কোনও গণ্ডি সেখানে আটকে রাখেনি, তিনি প্রথমে লোভ দেখিয়ে, তারপর স্বরূপ ধারণ করে সীতাকে বলপূর্বক অপহরণ করেছেন।
তাহলে গণ্ডি এল কোথা থেকে? গণ্ডি আনলেন বাঙালি কৃত্তিবাস। অনেকে বলেন, বাঙালি যে নাটকীয়তা পছন্দ করে, তা তিনি ভালোই বুঝেছিলেন। আর তিনি যখন রামায়ণ অনুবাদ করছেন, তখন সমাজের পরিস্থিতিও বাল্মীকির চেয়ে বদলে গেছে। শ-দুয়েক বছর আগে বিদেশি শাসকের হাতে চলে গেছে বাংলা। যবন শাসকের ভয়ে এমনিই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে বাঙালি। আর মেয়েদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে আঁটসাঁট ঘেরাটোপ। সংস্কৃত কাব্যে নাটকে মেয়েরা নির্জন রাতে অভিসারে গেলেও নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত হত না। কিন্তু কৃত্তিবাসের সময়ে একদিকে মেয়েদের নিরাপত্তার চিন্তা, আর-একদিকে শাসকের অনুকরণে পর্দাপ্রথার কড়াকড়ি। অতএব কৃত্তিবাসে চলে এল গণ্ডি। আর তাঁর সীতা দেবীর উদাহরণ সামনে রেখে ক্রমশ আঁট হয়ে বসল মেয়েদের আটকে রাখার গণ্ডিগুলোও।