কেনোপনিষদ
ভারতবর্ষে তপোবনশিক্ষার যুগে মনে করা হতো জ্ঞানই সেই পরমাশ্চর্য সম্পদ যা গুরু ও শিষ্য, আচার্য ও ছাত্রের মধ্যে রচনা করে এক অসেতুসম্ভব সংযোগ। দিন বদলেছে। এগিয়েছে সময়। শিক্ষার এই পণ্যায়নের কালে আচার্য বা গুরুর কনসেপ্ট বেশ ব্যাকডেটেড। তবে শিক্ষা-সংক্রান্ত ঝাঁ-চকচকে আধুনিক থিওরিসমূহও তো বলে, শিক্ষকের কাজ নিছক তথ্য সরবরাহ নয়। তিনি হবেন ‘অ্যাংকর’, সেই নোঙর যিনি উথালপাতাল ঝড়ের মুখেও ছাত্রকে চিনিয়ে দেন সঠিক স্থানাঙ্ক। তিনি উদ্দীপনার বাতিটুকু জ্বেলে দেবেন শুধু। ছাত্রকে টেনে আনবেন না-জানা থেকে জানার সরণীতে।
আপাত অনিঃশেষ এই সরণীর পরমবিন্দুকেই স্পর্শ করতে চেয়েছিল কেনোপনিষদ্, অবাঙ্মানসগোচর ব্রহ্মকে জানার প্রয়াসে। এটি দশটি মুখ্য উপনিষদের অন্যতম, সামবেদের শেষ অংশে সন্নিবিষ্ট। মোট চারটি খণ্ডে বিভক্ত এই উপনিষদের প্রথম খণ্ডে পদ্যে লেখা আটটি ছত্রে ব্রহ্ম ও ব্রহ্মজ্ঞানের প্রকৃতি উদ্ঘাটিত হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডের পাঁচটি ছত্রে মূলত রয়েছে ব্রহ্মজ্ঞানের জাগরণের মাধ্যমে অমরত্ব অর্জনের কথা। তৃতীয় খণ্ডে গদ্যাকারে রচিত পনেরটি ছত্রের মধ্যে স্থান পেয়েছে অগ্নি বায়ু ও ইন্দ্র-কর্তৃক জ্যোতির্ময় ব্যক্তিরূপী ব্রহ্মের স্বরূপ জানতে চাওয়ার কাহিনি। চতুর্থ খণ্ডটি প্রথম তিন খণ্ডের উপসংহার। আজকের এই লেখাটি কেনোপনিষদের কোনও অনুবাদ নয়। নয় স্বতন্ত্র কবিতাও। এটি কেনোপনিষদের প্রথম দুই খণ্ডের পাঠ-অনুষঙ্গে কবিতাকে ছুঁয়ে থাকার প্রয়াসমাত্র।
পূর্বপাঠ
গুরু শিষ্য স্পর্শ করে একই ভেলা আর
পাড়ি দেয় তারা সেই যে সাধ্যের দিকে
সে সাধ্য তো শিক্ষা আর সে সাধ্য তো জ্ঞান
তাঁর পায়ে দুজনেই প্রণতি জানান -
একইভাবে রক্ষা করো আমাদের তুমি
একইভাবে যেন পাই শিক্ষা আর স্বর
সে শিক্ষার অধিকারও একইসঙ্গে পাই
বিদ্বেষ সে যেন আজ বিচ্ছেদ না আনে
এ কেমন তত্ত্বকথা এ কেমন জ্ঞান!
শিক্ষকও তো বন্ধু হয়ে হাতে হাত দেন
তারপরে দুজনে আজ সহযাত্রী হয়ে
দাঁড়িয়েছে এক-আকাশ বিস্ময়ের নিচে
সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন শিহরিত হয়
সমস্ত কিছুতে তার পরিচয় পেয়ে
আমি যেন জ্ঞানকে না অস্বীকার করি
জ্ঞানও যেন আমাকে না ছেড়ে চলে যায়
শিক্ষক যে বন্ধু হয়ে আগে থেকে ছিল
এইবার বন্ধু হয়ে জ্ঞান হাত ধরে
আমাতেই জ্বলে ওঠে অদ্বিতীয় আলো
রঙ্গমঞ্চে নাট্যকার ভাষ্য পাঠ করেন
উত্তরপাঠ
১.
যুধিষ্ঠির-ধর্মবক সংবাদের কথা
সবাই জেনেছে পরে মোটের ওপর
সবথেকে দ্রুতগামী আলো নয়, মন
সময় পেরিয়ে সে-ই সারাক্ষণ ছোটে…
কোন স্পর্শে জেগেছিল সমুদ্রের ঢেউ?
জ্যোৎস্নার ভাষা ঠোঁটে নিয়েছিল কারা?
তাদের কাছেও মন চলে যেতে পারে
মুহূর্ত নিমেষমাত্র, তার বেশি নয়।
কিন্তু সেই মন কেন গতিময় হল?
কেনই বা বাক্যগুলি বিনির্গত হয়?
কার ইচ্ছেতে চোখ জুড়ে ফুটে ওঠে আলো!
কার ইচ্ছেয় কানে আসে শব্দময় রেখা!
কর্ণেরও কর্ণ তিনি মনের সে মন
বাক্পতির বাক্য তিনি তাঁতে সমর্পণ
প্রাণের সে প্রাণ আর চক্ষুরও সে চোখ
তাঁকে যে জেনেছে সেই ছেড়েছে রাজন্,
ছেড়েছে সে আত্ম আর ছেড়েছে অপর
সম্যক সরণ সেই সংসার ও ঘর।
অমৃত এলেই জ্ঞান খুলে যায়, চোখও
নিভে আসে বাতিদান মায়ার কাজল,
দেহে আর সে ফিরবে না সেই আলোরেখা
অস্তমিত শব্দ আর তাঁর কাছে শেখা।
চক্ষুদুটি যায় না সেই অগম্য লোকেতে
বাক্যের গণ্ডিও তার বেশি নয়
মনেরও সীমানা আছে তাই অকস্মাৎ
কীভাবে জানাব তাঁকে যাঁকে জানি না?
২.
জানার জিনিস যেটি জ্ঞান তাই নয়
অজানার সীমানায়ও জ্ঞান পড়ে না
আগের আচার্যেরাও এই বলে গেছেন
আমরা শুনেছি শুধু শিশিরের কণা
বাক্ দ্বারা যিনি শোনো উচ্চারিত নন
মন যাঁকে কখনোই ছুঁতেও পারে না
নয়নের জ্যোৎস্না যাঁকে স্পর্শে অপারগ ও
কর্ণের গোচরে তাঁকে আনা যাবে না।
ঘ্রাণের বাতাস থেকে বাহিরে সে থাকে
তাকে তুমি জ্ঞান বলে চিনে নিলে প্রিয়,
কিন্তু তিনি বাইরে নেই ভেতরে তোমার…
তিনি কর্তা প্রযোজক, তুমি প্রযোজিত
নিজেকেই ভিন্ন ভেবে যাঁকে উপাসনা
সে তো আর তিনি নন, ছিলেন কখনো?
আমি যে জানি না তাঁকে, কথা সত্য নয়।
আবার যে জানি সেও বলা তো যাবে না।
তাঁকে যে জানে না, সে-ই বস্তুত জানে,
এবং যে জানে সেই আসলে জানে না।
নিজেকে না জানলে আছে অমোঘ বিনাশ
নিজেকেই খুঁজে চলা, এর নাম জ্ঞান?
তাঁহার স্বরূপটি কী, কে তা বলতে পারে!
বলার যে রোদটুকু তার বাইরে তিনি
শিশিরে লুটিয়ে আছে আনত সকাল…