জিন নিয়ে কারিকুরি, খোদার উপর খোদকারি?
হি জিয়ানকুই নামটা চেনা চেনা ঠেকে? গত বছরের শুরুর দিকে যেমন করোনা ভাইরাস সম্পর্কে প্রথম বিপদঘন্টি বাজিয়ে আলোচনায় উঠে আসেন এক চীনা চক্ষুবিশারদ, তেমনই ২০১৮-এর শেষ দিকের আলোচ্য নাম ছিলেন চীনা জিন-বিশেষজ্ঞ হি জিয়ানকুই। আলোচ্য এবং ধিক্কৃত, কারণ তিনি বিজ্ঞানের যাবতীয় নীতিবোধকে কাঁচকলা দেখিয়ে মানবভ্রূণের জিন নিয়ে কাটাছেঁড়া করে তাকে সফলভাবে গর্ভে প্রতিস্থাপন করান। জিন এডিটিং যদিও এখন খুবই নিয়মিত এবং অপরিহার্য প্রযুক্তি, তবু মানবভ্রূণের উপর এই জাতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিশ্ব জুড়েই নিষিদ্ধ। কারণটাও খুব সহজেই অনুমেয়; খোদার উপর খোদকারি করার এমন সুযোগ ঢালাও পাওয়া গেলে ভবিষ্যতে অনেক বাবা-মায়েরাই চাইবেন মেধা-স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য্য সব দিক থেকে উন্নততম একটি ‘সিন্থেটিক শিশু’র জন্ম দিতে। যেহেতু পকেট ভারী না হলে এমন চাহিদা পাত্তা পাবে না তাই মানবদেহের যে স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বা সদ্গুণের উপর কারও হাত থাকে না, সেইগুলির প্রকাশেও একটা অসাম্য সৃষ্টি হবে আর্থিক ক্ষমতার ভিত্তিতে।
মজার বিষয়টা হল, বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ যেমন খোলাখুলি বলছেন, এই ঘটনা বিজ্ঞানের জগতে এক দায়িত্বজ্ঞানহীন যথেচ্ছাচারের নজির; তেমনই কিছু সংখ্যক বিজ্ঞানী মনে করেন মানুষের সার্বিক উন্নতির জন্য এইটিই সঠিক রাস্তা, এবং এর সপক্ষে তাঁরা বেছে নিয়েছেন একটি মোক্ষম অস্ত্রকে – বিবর্তন। শব্দটা যদিও এখন বহুব্যবহার দোষে দুষ্ট, তবু এক্ষেত্রে মূল ব্যবহারেই ফিরে যাওয়া যাক। অর্থাৎ জীবের বিবর্তন। এঁরা মনে করেন যে বাঁদর থেকে গুহামানব হয়ে আধুনিক মানুষে এসে বিবর্তন আটকে পড়েছে। যে পরিবেশে বা পরিস্থিতিতে একজন মানবশিশু আজ জন্ম নিচ্ছে, তাতে তার উন্নত গুণাবলীর কোনও অভিযোজন হচ্ছে না, স্বাভাবিক বিবর্তন তাই স্থবির অথবা ধীর। জিনগত ভাবে উন্নত মানুষের জন্ম দেওয়াটা তাই বিবর্তনকে সচল রাখার একটা কৃত্রিম প্রচেষ্টা। সাধু প্রস্তাব। কিন্তু প্রকৃতির প্যান্ডোরার বাক্স নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার কিছু বিপদ আছে। প্রথমত, বিবর্তন কোন গতিতে হবে সেটা নির্ধারণ করার ভার প্রকৃতির বদলে আমাদের হাতে তুলে নিলে তার অপব্যবহার হতেও বেশি দেরি হবে না। দ্বিতীয়ত, বিবর্তনের প্রমাণ কয়েক বছরে মেলেনা, কয়েক হাজার বছর লাগে। তবু যে এই প্রশ্ন উঠছে তার কারণ প্রাণসৃষ্টির শুরু থেকে আজ অবধি বিবর্তনের গতিপ্রকৃতি আমাদের অনেকটাই অজানা। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। জীবকোষে কিছু এমন প্রোটিন থাকে যাদের কাজই হল গুছিয়ে কোষের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটানো। এই ঘটনাকে বলা হয় অ্যাপপ্টোসিস (Apoptosis or Programed Cell Death)। বিশেষ বিশেষ সময়ে, যেমন ভাইরাস আক্রমণ বা রাসায়নিক বিক্রিয়াজনিত ক্ষতিতে কোষের সেরে ওঠার সম্ভাবনা না থাকলে, এই প্রোটিনগুলি কার্যকর হয়ে ওঠে এবং কোষকে পুরোপুরি বিনষ্ট করে দেয়। যে কোন বহুকোষী প্রাণীর মধ্যেই এই পদ্ধতিতে কাজ হয়। এখন বিবর্তনকে যদি আপনি সহজ করে দেখতে চান, একটা প্রাণী বা উদ্ভিদের সার্বিক বিবর্তন মানে আসলে তার বহু লক্ষ বছর আগে থেকে একটু একটু করে হয়ে আসা এক একটি কোষের বিবর্তন। আর এই বিবর্তনের পথে কে টিকে থাকবে আর কে থাকবে না, সেইটি বেছে নেবে প্রকৃতি নিজেই (Natural Selection)। এহেন প্রাকৃতিক বাছাইদের নিয়ে তৈরি আমাদের জীবজগত, অর্থাৎ আশেপাশে যাদের আমরা দেখছি তারা কোনও না কোনও পরিস্থিতির বিচারে সেরা বলে নির্বাচিত। এমতবস্থায়, একবার ভাবুন তো সেইসব কোষদের কথা, যারা প্রতিকূল অবস্থায় পড়ে নিজেদের অ্যাপপ্টোসিস পদ্ধতি চালু করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে! আপাতদৃষ্টিতে তারা সেই মুহূর্তেই প্রাকৃতিক নির্বাচন থেকে ছিটকে গেল; অথচ এই পদ্ধতি আজও প্রতিটি কোষের মধ্যে স্বমহিমায় বিদ্যমান! বিবর্তনের সবচাইতে কম প্রভাব বোধ করি এই জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়াতে। এইরকম আরও একটি উদাহরণ হল সমকামিতা। না, ৩৭৭ ধারা নিয়ে চর্চা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, সমকামিতার ভাল-খারাপ নিয়ে বিতর্কের মধ্যেও আমরা যাব না। কিন্তু যে কারণে আমরা সমকামিতাকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলি, সেই কারণটিই সমকামিতার থেকে যাওয়ার পক্ষে বেশ আশ্চর্যের। এই সম্পর্কে পরবর্তী প্রজন্মের কোন সম্ভাবনা থাকে না আর তাই প্রকৃতির বাছাই প্রক্রিয়ায় এর বাদ পড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। অথচ মানুষ এবং মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যে এইরকম বিকল্প যৌনাচার খুব স্বাভাবিকভাবেই থেকে গেছে। বিবর্তনের ধারাতে এও এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম। সত্যি বলতে কি, সমকামিতা যে কোন মানসিক অসুস্থতা নয় বরং মানুষের জিনগত বৈশিষ্ট্য, সেই তথ্য যত পরিষ্কার হয়েছে বিবর্তনের জটিল ও আকর্ষক দিকগুলো ততই সামনে এসেছে। ১৯৯৩ সালে Science জার্নালের এক প্রবন্ধে ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউটের এক বিজ্ঞানী, ডিন হ্যামার, দাবি করেন যে পুরুষ সমকামিতা মূলত মায়ের বংশধারাতেই প্রবহমান এবং পরবর্তীকালে X ক্রোমোজোমের একটি জিনকেও তাঁরা চিহ্নিত করেন – xq28 । প্রাকৃতিক নির্বাচনের ঝড়ঝাপটা সামলে জিনটি কিন্তু দিব্যি টিকে গেছে। এর কারণ হিসেবে মনে করা হয় এই জিনটির বিশেষ ভূমিকা আছে X ও Y ক্রোমোজোমের নিরন্তর টানাপোড়েনে। টানাপোড়েন? তাও আবার এমন দুইজনের মধ্যে যারা একসঙ্গে না থাকলে ছেলেদের অস্তিত্বই বিপন্ন? আজ্ঞে হ্যাঁ। মোটামুটি এটুকু আমরা জানি যে নারীমাত্রে XX এবং পুরুষমাত্রে XY, কিন্তু বর্তমান গবেষণা বলে যে যৌনতার জন্মের সময় থেকেই এই দুই ক্রোমোজোমের মধ্যে এক অদৃশ্য দড়ি টানাটানি চলে আসছে। একজন চেষ্টা করে অপরকে দমিয়ে রাখতে আর এই নিরন্তর প্রতিযোগিতার ফলে জন্ম নেয় আরও উন্নত সেক্স ক্রোমোজোম। এমন কড়া প্রতিযোগিতার বাজারে X ক্রোমোজোমের অন্যতম হাতিয়ার পুরুষ সমকামিতা। এর ফলে স্বাভাবিক পুরুষের জন্মে কোনও প্রতিবন্ধকতা আসেনা, অথচ সেই সন্তানের থেকে পরবর্তী প্রজন্মের সম্ভাবনা অনেকটাই হ্রাস পায়। X ক্রোমোজোম এখানে প্রতিপক্ষকে এক আজব ফাঁদে ফেলে। অদ্ভুতভাবে দেখা যায়, একাধিক ভাই-বোনের মধ্যে ছোট ভাইদের মধ্যে মায়ের দিক থেকে এই ধরণের জিনগত প্রবণতা সবচেয়ে বেশি প্রবাহিত হয়, অর্থাৎ প্রথম সন্তানের মারফৎ নিজের বংশধারা অব্যাহত রইল! বিবর্তন দুই ক্রোমোজোমের লড়াইকে মেনে নিয়েছে, তবে নিজের শর্তগুলি লঘু করেনি।
এই যে বারবার করে একটা বক্তব্য ঘুরে ফিরে আসছে, ‘পরবর্তী প্রজন্ম’, এইটি প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতির প্রায় সবটুকু একচোখামি একে ঘিরেই। সাধারণ ধারণা বলে, প্রকৃতিতে যদি অধিকতর সক্ষম চারিত্রিক গুণাবলী বেশি সুবিধা পায়, তাহলে সমস্ত জিনগত ত্রুটিজনিত রোগও ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাওয়া উচিত। প্রকৃতপক্ষে তাই হয় বটে, তবে লোকচক্ষুর কিঞ্চিৎ আড়ালে। জিনের নানারকম দোষত্রুটি হয় প্রাকৃতিক নির্বাচনকে পাশ কাটিয়েছে অথবা সেই নির্বাচনেই সামিল হয়েছে খুব নির্মমভাবে। দু’টো উদাহরণ দেওয়া যাক – অ্যালজাইমার্স এবং সিস্টিক ফাইব্রোসিস। প্রথমটার সঙ্গে আমাদের তবু অল্পবিস্তর পরিচয় আছে, কিন্তু সিস্টিক ফাইব্রোসিস সম্পর্কে আমরা কমই জানি। এটি ফুসফুসের একটি বিরল রোগ; মানবকোষের ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে ৭ নং জোড়াতে জিনগত ত্রুটির কারণে এই রোগ হয়। এই জোড়ার একটি যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় এবং অপরটি স্বাভাবিক, তবে সেই মানুষটি রোগের বাহকমাত্র, রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ত্রুটিযুক্ত ক্রোমোজোমের তুলনায় মিশ্রিত ক্রোমোজোম বেশি প্রশ্রয় পাবে। সেটাই হয়, তবে একটু ঘুরপথে। দেখা গেছে, এই মিশ্র ক্রোমোজোমের বাহকরা সাধারণের তুলনায় টাইফয়েডের বিরুদ্ধে অনেক বেশি প্রতিরোধক্ষমতা সম্পন্ন। বিবর্তন শুধুমাত্র ত্রুটিমুক্ত ৭ নং ক্রোমোজমকেই বাছাই করেনি, একইসঙ্গে মিশ্রিত ৭ নং জোড়াটিকে অন্য মারণরোগের প্রতিরোধী ক্ষমতা দিয়ে দিব্যি সেই বাছাই-তালিকায় ঠাঁই দিয়েছে! কিন্তু তা বলে সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগটা থেকে গেল কেন? ত্রুটিপূর্ণ ক্রোমোজোম বিবর্তনের চক্করে মুছে গেল না কেন? তার কারণ, জিনগত ত্রুটি একটা দুর্ঘটনা মাত্র এবং এই থেকে যাওয়া রোগের সমষ্টি যাতে নিজের পথে কোনও বাধা না হতে পারে, বিবর্তন সেই দায়িত্বও পালন করেছে অতি নিষ্ঠুর ভাবে। সিস্টিক ফাইব্রোসিস একটি প্রাণঘাতী রোগ, অধিকাংশ রোগীই এর প্রকোপ কাটিয়ে সন্তান উৎপাদনের বয়স অবধি বাঁচতে পারেনা। তাই পরবর্তী প্রজন্মে এই রোগ বাহিত হওয়ার সম্ভাবনাও এক ঝটকায় অনেকটা নেমে আসে। ফলত, বিবর্তনের পথে এই রোগ এক অতি সামান্য মূল্য হয়ে থেকে যায়। অবাক লাগছে? ভাবছেন, প্রকৃতির এ কেমন পরিহাস? ভাববেন না, ব্যক্তির প্রতি নিষ্ঠুর না হলে বিবর্তন সমষ্টিগত ভাবে এগোতে পারত না কোনোদিনই। এর উল্টোপথের উদাহরণ, অ্যালজাইমার্স রোগ। মস্তিষ্কে বিটা-অ্যামাইলয়েড নামক প্রোটিনের জমাট বাঁধার ফলে এই রোগ হয়। আক্রান্তের সংখ্যা সিস্টিক ফাইব্রোসিসের তুলনায় অনেক বেশি। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচন হাত গুটিয়ে বসে রইল কেন? কারণ অ্যালজাইমার্স রোগ মূলত হয় প্রৌঢ় বয়সে, সন্তান উৎপাদনের যথেষ্ট পরে; সুস্থ সন্তানের মাধ্যমে জিনগত বৈশিষ্ট্য একবার বাহিত হয়ে যাওয়ার পর প্রকৃতির আর কোনও দায় থাকে না আমাদের দিকে ফিরে তাকানোর। খুবই ভয়াবহ চিন্তা, সন্দেহ নেই! এই ভয়টুকু আছে বলেই এখনও বিজ্ঞানীরা ভ্রূণের জিনগত বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে ঈশ্বর-ঈশ্বর খেলতে পছন্দ করেন না। মানবকোষের জিন মানচিত্র তৈরি থাকা সত্ত্বেও তাঁরা এহেন দুঃসাহস দেখাতে চান না। তাঁরা জানেন, এই মানচিত্র যতটুকু জিনগত প্রকারভেদকে জায়গা করে দিয়েছে, তার চাইতে অনেক অনেক বেশি প্রকারভেদ প্রকৃতিতে আছে। এই মানচিত্র আমাদের যতটুকু বুঝতে সাহায্য করেছে, তার চাইতে অনেক অনেক বেশি বোঝার বাকি রয়ে গেছে। এই না-জানা, না-বোঝাটুকুই আশ্বাস - আমাদের উন্নতিও হয়ত আমাদের অজান্তে প্রকৃতির হাত ধরেই হবে। স্বাভাবিক ক্রমানুসারে।
.............................
প্রাসঙ্গিক তথ্যসূত্র :
১. Linkage between sexual orientation and chromosome Xq28 in males but not in females. Nature genetics
২. Study of gay brothers may confirm X chromosome link to homosexuality By Kelly Servick, sciencemag.org
৩. Cystic fibrosis and typhoid fever - A Faustian bargain, economists.com
৪. Genome, Matt Rifley
#Gene #Genome editing #genome engineering #Chromosome #DNA #Apoptosis #Programed Cell Death #জিন #বিজ্ঞান #প্রযুক্তি #ক্রোমোজোম #সায়নদীপ গুপ্ত #সিলি পয়েন্ট