কলকাতার কমলালয় হগ মার্কেট
অতিমারির অপরিচিত ভয় কাটিয়ে ওঠার পর মানুষ আবার ফিরছে তার পরিচিত স্বাভাবিক ছন্দে। এমন ঘটনাবহুল ২০২০-র পর নতুন পয়লা জানুয়ারি তাই বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। যেন একটা নতুন পথ চলার শুরু একুশের এক থেকে। এবারের পয়লা তাই অনেকটাই অন্যরকম। তবে প্রত্যেক বছরই মানুষের এই অবিরাম শুভেচ্ছা বিনিময় দেখে নিভৃতে হাসে এই শহর কলকাতার প্রবীণতম বা নবীনতম অধিবাসী। অবশ্য সাম্প্রতিককালের আন্তরিকতাবিহীন আন্তর্জালিক শুভেচ্ছাবার্তা চালাচালির বিশেষ দিনটায় তার জন্ম হলেও অনেকেই সেটা সম্পর্কে অবহিত নন। যদিও বর্তমানে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্মে জন্মদিনের নোটিফিকেশন দেখিয়ে বলপূর্বক শুভেচ্ছা আদায়ের যে নতুন ট্রেন্ড দেখা দিয়েছে, সেখানে এমন বিস্মৃতিও মঙ্গলের! তবে ফেলে আসা বছরটা যেহেতু আত্মমুখীনতা পরিত্যাগ করে পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে কিছুটা দায়বদ্ধ হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে তাই নতুন বছরের প্রথম দিনের উদযাপনেও ১৪৭ বছরে পা দেওয়া এই বাসিন্দাকে সামিল করে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। আজ আসলে আমাদের সকলের অতিপ্রিয় ‘হগ মার্কেট’ এর হ্যাপি বার্থডে। যাদের নামটা সামান্য অচেনা ঠেকছে তাদের বলি এটা আমাদের অতিপরিচিত “নিউ মার্কেট”-এরই আরেকটা নাম, সরকারি নথি অনুযায়ী। কলকাতার সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মনিরপেক্ষ, লোকায়ত সমৃদ্ধ পরম্পরার সমার্থক বা প্রতীক এই সর্বজনবিদিত জায়গাটি। কাজেই শুধুমাত্র বাজারের তকমা দিলে কলকাতার ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের অন্যায় উপেক্ষা হবে।
লিন্ডসে স্ট্রিটের এই স্থানটিতে সাতরকম রঙ আর পাঁচমিশালি বিস্ময়ের পসরা বসে প্রতিদিন। এখানে বারোমাস মানুষের জমজমাট ভিড়ে কান পাতলে অতীতের ফিসফাস শোনা যায়। সরু সরু গলিতে ঢালাও পণ্যের অবাক বহরে, প্রায় দুহাজার দোকানের সমাহারে, এই সুবিন্যস্ত এবং শশব্যস্ত বিপণিকেন্দ্র কলকাতার বুকে এক মজার ভুলভুলাইয়া। মানুষ আর ইয়েতি ছাড়া এখানে সবকিছুই সুলভ মূল্যে পকেটস্থ করা যায়। চিনে জুতো চাই? পাবেন। তিব্বতি থাঙ্কা চাই? পাবেন। মাথায় টাক বলে ভালো বিয়ের সম্বন্ধ আসছে না? কুছ পরোয়া নেহি! পরচুলাও পাবেন। টার্কির মাংস থেকে টিকটিকির ডিম, একটু ভালো করে খুঁজলে সত্যজিতের ‘মহাপুরুষ’ ছবির ‘জলহস্তির রোস্ট’-ও পেয়ে যেতে পারেন! কথা যখন উঠলই তখন বিশেষ কয়েকটি দোকানের কথাও না বললেই নয়। যেমন কলকাতার একমাত্র এবং শেষ ইহুদি কনফেকশনারি শপ ‘নাহুম এ্যান্ড সন্স’ সেই ১৯০২ থেকে মানুষের রসনা তৃপ্ত করে আসছে। বা প্রখ্যাত কিউরিও শপ ‘চাম্বা লামা’, যেখানে পুরনো পুরনো রং আর গন্ধ এতটাই পাগল করে দেয়, কেনাকাটা তো পরে! তারপর ‘কুণ্ডু’ বা ‘বোস প্রাইভেট লিমিটেড’-এর ফুল ও অর্কিডের কালেকশন নিউ মার্কেটের সেই জন্মলগ্ন থেকে মানুষকে মোহিত করে আসছে। ১৯০৮ এ প্রতিষ্ঠিত ‘দয়ারাম’ বা ‘বম্বে সিল্ক হাউস’ এর বিবিধ শাড়ির সম্ভার দেখলে যে-কোনও বিবাহিত পুরুষের কপালে দুঃস্বপ্নের কালো ছায়া ঘনিয়ে আসতে পারে! তবে এসব ছাড়াও মধ্যবিত্তের নিত্য ব্যবহার্য আলু-পটল, মুদির জিনিস, মাছ-মাংস, স্টেশনারি দ্রব্যও এখানে দেদার বিকোয়। শুধু তাই নয়, যারা সংগ্রাহক তাদের কাছেও এই জায়গা একরকম স্বর্গরাজ্য। ডাকটিকিট থেকে বিদেশি কয়েন সব মেলে এখানে। আগে গ্রামোফোন রেকর্ডও বিক্রি হত। একসময় যে এখানে পোষ্যও পাওয়া যেত প্রচুর তার নমুনা পাওয়া যায় সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা কাহিনি ‘নেপোলিয়নের চিঠি’তে। তোপসের জবানিতে সত্যজিৎ লিখছেন, “নিউ মার্কেটের পাখির বাজারের জবাব নেই।” সেইদিনই লালমোহনবাবু আধঘন্টায় এখান থেকে “একটা নখ কাটার ক্লিপ, আধ ডজন দেশবন্ধু মিলসের গেঞ্জি আর একটা সিগন্যাল টুথপেস্ট কিনলেন। যদিও তারপর ফেলুদার সাথে কামানের পাশে অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় হয়ে যাওয়ায় আর চীনে জুতোর দোকান থেকে ওনার মোকাসিন কেনা হয়ে ওঠেনি।”
তা এখন প্রশ্ন হচ্ছে শহরে এত বাজার থাকতে একেই হঠাৎ ‘নিউ মার্কেট’ নাম দিয়ে এমন তোল্লাই দেওয়া হল কেন? আর কেনই বা এমন কল্পতরু গাছের মতো জায়গাকে ‘হগ মার্কেট’ বলে অভিহিত করা হয়? জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে সেই উনিশের শতকের কলকাতায়। ১৮৫৯ সাল। স্টুয়ার্ট হগ নামক এক ব্রিটিশ ভারতে তথা বাংলায় আসেন বর্ধমানের কালেক্টর হয়ে। সেখানে প্রবল দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সুষ্ঠু ত্রাণের ব্যবস্থা করে তিনি মানুষের মধ্যে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন। এই হগ সাহেবই ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা পৌরসভার চেয়ারম্যান ও কমিশনার অফ পুলিশ পদে আসীন হয়ে আসেন। তাঁকেই ‘শহর কলকাতা’র প্রথম রূপকার বলা যেতে পারে। কলকাতার বুকে পানীয় জলের সুব্যবস্থা, ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালী ও রাস্তায় শহুরে আলোর রূপায়ণ তাঁর হাত ধরেই হয়। তাঁর উদ্যোগেই এই বাজার নির্মিত হয়। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে জানবাজার স্ট্রিট ও লিন্ডসে স্ট্রিটের মধ্যে প্রায় চব্বিশ বিঘা মাপের বিশাল বস্তি এই উদ্দেশ্যে অধিগৃহীত হয়। এই বিষয়ে প্রখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী হীরালাল শীলের সঙ্গে সাহেবের বিরোধ ইতিহাসপ্রসিদ্ধ, যদিও শেষপর্যন্ত তা মিটে যায় এবং ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির স্থপতি আর. আর. বায়ানের নক্সা বাজার-নির্মাণের জন্য মনোনীত হয় একহাজার টাকা পারিতোষিকের বিনিময়ে। তৎকালীন প্রায় ছ-লক্ষ টাকার বিনিময়ে বাজারের নির্মাণকার্য সম্পন্ন হয় ১৮৭২ সালে। এই বিরাটাকার পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হয় 'মেসার্স বার্ন এ্যান্ড কোং' কোম্পানির হাতে। ১৮৭৪ সালের পয়লা জানুয়ারি তা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। পৌরসভার নিয়ন্ত্রণে এটি এদেশের প্রথম মার্কেট বলে এর নামকরণ হয় ‘নিউ মার্কেট’। একই ছাদের তলায় এত রকমারি জিনিসের বিকিকিনি এখনকার দিনেই অভাবনীয়, আর সেই সময় তো ভাবাই যেত না! ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মার্কেট হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল এটি। সাহেব থেকে নেটিভ, দুর্গাপুজো থেকে ক্রিস্টমাস - সমস্ত উৎসবে, সকল মানুষের অবাধ পদচিহ্ন আঁকা হয়ে রয়েছে এখানকার প্রত্যেকটি বাইলেনে। দেশি বিদেশি সমস্ত পণ্য এখানে একাধারে মানুষের চাহিদা মিটিয়েছে। সব প্রভেদ মুছে দেওয়া এমন পরিকল্পনা যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত, সেই স্যার স্টুয়ার্ট হগকে সম্মাননা জ্ঞাপনার্থে ১৯০৩ সালে বাংলার বড়লাট লর্ড কার্জন নিউ মার্কেটের নাম দেন ‘হগ মার্কেট’। সাথে এই মার্কেটের মূল প্রবেশের মুখে সুউচ্চ Clock Tower বা ঘড়িঘরকে ভুললে চলবে না, যা ফেলে আসা সময়ের ভার নিঃশব্দে বুকে বহন করে চলেছে। তার বয়সও একশো অতিক্রান্ত। মার্কেটের শোভাবর্ধন করতে ১৯০৯ সালে এটি নির্মাণ করে ‘মেসার্স কুক এ্যান্ড কেলভিন’। তবে সময় সমান যায় না। দুর্বিপাকের করাল ছায়া থেকে মুক্তি পায়নি সদা মুখরিত নিউ মার্কেটও। ১৯৮৫ সালের বিধ্বংসী আগুনে প্রভূত ক্ষতিসাধন হয় এই বাজারের। কলকাতা পৌরসভার ঐকান্তিক তত্ত্বাবধানে সেই ক্ষয়ক্ষতি নিরাময় হতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ বছর। পুনরায় তা স্বমহিমায় ফিরে আসে, ক্রেতা-বিক্রেতা ও পথচলতি হাজারো মানুষের মুখের টুকরো হাসি হয়ে।
আরও পড়ুন : ব্রিটিশ জবানিতে কলকাতা / বিপ্রনারায়ণ বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য
কলকাতা এখন আর নিছক শহর নয়, মেট্রো সিটি। হাইরাইজ আর বহুজাতিক এন্টিটির ভিড়ে কলকাতা এখন গ্লোবাল। এই গ্লোবালাইজেশনের হাত ধরেই এসেছে বহুতল মল। কিন্তু ভারতের এই আদিমতম মল, ব্যতিক্রমী সম্ভারে, সুবিশাল আয়তনে এবং সুলভ মূল্যে যে কোনও বিপণিকে সগৌরবে পরাস্ত করার ক্ষমতা রাখে। কত ক্ষুদ্র অস্থায়ী ব্যবসায়ীকে এই মার্কেট তার পরিসীমায় ক্ষুণ্ণিবৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কত ভাষাভাষী ধর্মাবলম্বী মানুষ এখানে রোজ দোকান খোলেন, সন্তুষ্ট চিত্তে ঘরে ফেরে খরিদ্দারেরা, মুছে যায় উঁচু-নিচু, তুমি-আমি, ঈদ-ইস্টারের বিভেদ। এখানেই নিউ মার্কেট কালজয়ী। প্রায় সার্ধশতবর্ষের মুখে দাঁড়িয়েও সে চিরসবুজ, সে নতুন। কলকাতার অখণ্ড সংহতির ঐতিহ্য পুরোদস্তুর বহন করে চলেছে এই মার্কেট। বর্তমান রাজনৈতিক আবহাওয়ায় ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতে কতদিন এই নিরপেক্ষতা টিকবে বলা মুশকিল। তবে যতদিন কলকাতা থাকবে ততদিন মানুষের মুখে হাসি ফোটাবে এই বাজার, সগর্বে। লালরঙা নিউ মার্কেট এই তিলোত্তমার জয়টিকা, সে ন্যুব্জ হয় না। আজ শুভ জন্মদিন বলুন আর নাই বলুন, নিউ মার্কেটের বয়স হয় না।