ভারতের প্রথম গাড়ি চলেছিল কলকাতায়
স্বাধীনতার পর রাজধানী দিল্লি ও বাণিজ্য-নগরী মুম্বাইয়ের কাছে ঐশ্বর্যের দাঁড়িপাল্লায় শহর কলকাতা বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে সন্দেহ নেই। তবে ব্রিটিশ শাসনকালে বিশেষত বঙ্গভঙ্গের আগে এই শহর ছিল গোটা ভারতের প্রাণকেন্দ্র। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, খেলাধূলা কিংবা ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন – সবকিছুতেই অগ্রগণ্য ছিল শহর কলকাতা। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কলকাতার রাস্তায় হঠাৎ করে একটা পোর্শে, ল্যাম্বরগিনি বা ফেরারি চোখে পড়লে যে কেউ অবাক হবেন। কারণ তাদের অবচেতন মনের ধারণা অনুযায়ী এহেন নামী-দামী গাড়ি দিল্লি বা মুম্বাইয়ের মতন ‘এক্সপেন্সিভ’ শহরের সঙ্গে খাপ খায়। তিন শতকের বুড়ো এই শহরটার সঙ্গে নয়!
আজকের দিনে ধারণা যাই হোক না কেন, ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যাবে, ভারতবর্ষের প্রথম যে চারচাকা গাড়িটি চলেছিল তা দিল্লি বা মুম্বাইয়ের বুকে নয় বরং ‘ক্যালকাটা’য়। কলকাতার বুকে ব্রিটিশ আমলে চলা এই গাড়িটি ছিল ‘ডেনিস’ নামের এক ফরাসি কোম্পানির। ‘দেদিওঁ’ মডেলের সেই গাড়িটি কলকাতায় প্রথম আনেন কলকাতারই এক বাসিন্দা। ১৮৯৭ সালে। সেইসময়ের সংবাদপত্র ঘাঁটলে জানা যায় যে গাড়িটির প্রথম দর্শন শহরবাসীর মনে বেশ ত্রাসের সঞ্চার করেছিল।
যদিও অনেকেই মনে করেন ভারতবর্ষে প্রথম গাড়ি এসেছিল বোম্বে-তে, প্রমাণস্বরূপ তারা জামসেদজি টাটা ও অন্য এক পার্সি ব্যবসায়ীর চারটে গাড়ির কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু জামসেদজী টাটার গাড়িটি যখন বোম্বেতে এসে পৌঁছায় তখন ১৮৯৮ সাল। ততদিনে কলকাতার রাস্তায় আধডজনের বেশি গাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তৎকালীন ভারতের আরেক শহর মাদ্রাজে প্রথম গাড়ির দেখা পাওয়া যায় ১৯০১ সালে। মাদ্রাজের সেই গাড়ির মালিক ছিলেন এ. ইয়র্কে নামের এক ইংরেজ সাহেব। তিনি রোজ গাড়িটি নিয়ে বেড়াতে বেরোতেন। তবে তাঁর গাড়ির কোনোরকম রেজিস্ট্রেশন ছিল না। মাদ্রাজের প্রথম রেজিস্ট্রার্ড গাড়ির মালিক ছিলেন ফ্রান্সিস স্প্রিং নামের এক ইংরেজ সরকারী কর্মচারী যিনি পরবর্তীতে মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
কলকাতার বুকে চলা প্রথম গাড়িটি ছিল ঘোড়াবিহীন। তার সম্মুখভাগে ঘোড়া ও হাঁসের নকল মাথার একটি ডেকরেশন ছিল । গাড়িটির নির্মাতা কোম্পানি ডেনিস সেইসময় শক্তপোক্ত ও টেকসই গাড়ি তৈরিতে বেশ নামডাক করে। শহরের রাস্তায় গাড়ি চলাচলের ছবি যখন অভ্যস্ত হতে শুরু করল তখনই আস্তে আস্তে বেশকিছু মোটর কোম্পানি ও ধনী ব্যক্তিরা এই গাড়িগুলিকে শহরতলি ছাড়িয়ে দূরে মফস্বলে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হলেন। গ্রামাঞ্চলে নানাবিধ কাজে শক্তি উৎপাদন ও সরবরাহের জন্য গাড়ির ইঞ্জিনের প্রয়োগ হতে লাগল। ১৯০৪-এ ‘বেঙ্গল কোল কোম্পানি’ রানিগঞ্জে খনি অঞ্চলে আনুষ্ঠানিকভাবে তৈরি করে তাদের ‘মোটর উইং’। বার্ন অ্যান্ড কো. ১৯০৭ সালে তাদের প্রযুক্তিগত কাজে সহায়তার জন্য ‘অ্যালেন বেরি’ নামের এক প্রখ্যাত কোম্পানির থেকে চার-আসনের একটি অ্যালবিয়ন গাড়ি কেনে।
গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি ও বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে বাংলার জমিদারদেরও গাড়ি কেনায় প্রবল ঝোঁক দেখা যায়। ল্যাঞ্চেস্টার, ফোর্ড প্রভৃতি গাড়ির চাহিদা তুঙ্গে ওঠে। তথ্য অনুযায়ী, ১৯১৫-১৬ সাল নাগাদ বাংলায় গাড়ির সংখ্যাটা এক হাজারের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছিল। গাড়ি-নির্মাতা কোম্পানি বিজ্ঞাপনের জন্য বিভিন্ন রোড-শো, হ্যান্ডবিল বিতরণ ইত্যাদি শুরু করেন। ধীরে ধীরে গাড়ির এই চাহিদা দেশের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
*এই ফিচারে ব্যবহৃত ছবিগুলি লেখকের সূত্রে প্রাপ্ত।
#ফিচার #ওয়েব পোর্টাল #কলকাতা #গাড়ি #ল্যাঞ্চেস্টার #ফোর্ড #বার্ন অ্যান্ড কো. #ডেনিস #বেঙ্গল কোল কোম্পানি #‘অ্যালেন বেরি #অ্যালবিয়ন # ‘দেদিওঁ’ #অলর্ক বড়াল