বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

ভারতের প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী-সংগঠন : নেপথ্যে গবেষক কমল রণদিভে

সায়নদীপ গুপ্ত Mar 22, 2022 at 8:57 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

স্বাধীনতা আসতে তখনও বছর দশেক বাকি, বাড়ির অমতে জীববিজ্ঞান নিয়ে স্নাতকস্তরে পড়তে ঢুকলেন এক মরাঠি কন্যা। স্কুলের পড়াশোনায় তিনি অনেকের থেকে এগিয়ে থাকতেন, তবু মেয়ে বলে কথা! তায় আবার বিজ্ঞানচর্চা। অমত হওয়াই স্বাভাবিক, তাই না?

আদপেই তা নয়। পুনের ফার্গুসন কলেজের জীববিদ্যার অধ্যাপক দিনকর সামারথের আসলে প্রবল ইচ্ছা, তাঁর আদরের মেয়ে কমল ডাক্তারি পড়ুক। সেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েই মেয়ে বেছে নিতে চায় বাবার মতো বিজ্ঞানচর্চার পথ। দিনকর পড়েছেন মহা মুশকিলে! ছোট থেকেই লেখাপড়ার ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে ভেদাভেদ করেননি তিনি, মেয়েও বরাবর বাবার পরিশ্রমের মান রেখেছেন। এখন তার উচ্চশিক্ষার স্বপ্নে লাগাম পরানোও অনুচিত। মেয়ের মতেই মত দিলেন শেষে, তবে মনে মনে ভাবলেন, ডাক্তারের সঙ্গে বিয়েটা অন্তত ...! 

নাহ্‌, তাঁর সে ইচ্ছাও পূর্ণ হয়নি। কমল ফার্গুসন কলেজ থেকেই বিএসসি পাশ করে এগ্রিকালচারাল কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পড়েছেন এবং তার মাঝেই জয়সিং রণদিভে নামের এক গণিতবিদের গলায় মালা দিয়েছেন। ভাগ্যিস! এই বিয়ের খাতিরেই তাঁকে পুনে ছেড়ে মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বে) চলে আসতে হয় আর সেখানেই তিনি বিখ্যাত প্যাথোলজি গবেষক বসন্ত রামজি খানোলকরের সান্নিধ্যে আসেন। রক্তের শ্রেণিবিন্যাস, ক্যানসার, কুষ্ঠ ইত্যাদি গবেষণায় ভি. আর. খানোলকরের অবদান এতই সুদূরপ্রসারী যে তাঁকে “Father of Indian Pathological Research” আখ্যা দেওয়া হয়। এহেন বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে আসায় কমল রণদিভের সামনে পিএইচডি করার এক সুবর্ণ সুযোগ এসে গেল। এমএসসি করার সময়ে তাঁর স্পেশ্যাল পেপার ছিল উদ্ভিদের সাইটোজেনেটিক্স বা কোশীয় জিনতত্ত্ব নিয়ে, এইবার ডক্টরাল গবেষণার সময়ে দারুণ ভাবে কাজে লেগে গেল সেই অভিজ্ঞতা। ১৯৪৯ সালে তিনি যখন ডক্টরেট ডিগ্রিতে সম্মানিত হলেন, তখন অধ্যাপক খানোলকর তাঁকে বললেন, ভবিষ্যতে পাকাপাকি বিজ্ঞানচর্চা করতে চাইলে বিদেশ থেকে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করাটা একান্তই জরুরি। 

বললেন তো বটে, কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশে পতি-পুত্র-সংসার ছেড়ে বিদেশবিভুঁইয়ে পাড়ি জমানো কি মুখের কথা! আশ্বাস দিলেন জয়সিং; বরাবরই তিনি বউয়ের শিক্ষাচর্চায় উৎসাহ দিয়ে চলেন, এবারেও তার অন্যথা হল না। কমল হাজির হলেন সোজা আমেরিকার জনস্‌ হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে, ডঃ জর্জ অটো গাই-এর গবেষণাগারে। কোশের বিভাজন, বৃদ্ধি এবং গবেষণার স্বার্থে সংরক্ষণ – এই বিষয়ে ডঃ গাই একজন পথিকৃৎ বললেও কম বলা হবে। বিশেষত, ক্যানসার গবেষণায় যুগান্তকারী হেলা (HeLa) কোশের কার্যকারিতা আবিষ্কৃত হয় ওঁর হাত ধরেই। এমন মানুষের কাছে কাজ করার সৌভাগ্য সবার জোটে না! কমলের অভিজ্ঞতার ঝুলি তখন স্বভাবতই উপচানো। ভারতে তখন শিক্ষাক্ষেত্রে গবেষণার তুলনায় প্রশাসন ও অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর তোড়জোড় বেশি। এমতাবস্থায় আমেরিকায় থেকে গেলে গবেষণার পথ বহুলাংশে মসৃণ হয়, গবেষক জীবনের খ্যাতি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত থাকে। 

কিন্তু তিনি, কমল রণদিভে, এবড়োখেবড়ো পথকেই মসৃণ বানাতে আগ্রহী। নিরাপদ জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করে তিনি ফিরে এলেন দেশে। এখানে ততদিনে খানোলকর প্রতিষ্ঠা করেছেন ইন্ডিয়ান ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার (ICRC), সেখানেই সিনিয়র রিসার্চ অফিসার হিসেবে যোগ দিলেন তিনি। তাঁর পরবর্তী কর্মজীবনের নিরলস পরিশ্রম দেশীয় স্তরে কোশবিদ্যা গবেষণার ক্রমোন্নতির পথে এক অনস্বীকার্য অবদান। তাঁর চেষ্টাতেই ICRC-তে গড়ে তোলা হয় সেল বায়োলজি, ইমিউনোলজি, কার্সিনোজেনেসিস শাখা। তিনি ও তাঁর সহযোগীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় হাতেকলমে বানানো হয় টিস্যু কালচার বা কোশকলা সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ সম্পন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ক। তার ফলে গবেষণায় পরমুখাপেক্ষী হওয়ার প্রবণতা হ্রাস পায়, কৃষিক্ষেত্রে ও ঔষধশিল্পে টিস্যু কালচার গবেষণার গুরুত্ব বাড়ে। ১৯৬৬-১৯৭০ সাল অবধি সময়কাল জুড়ে তিনি ICRC-এর অধিকর্তার পদ অলংকৃত করেন। তাঁর হাত ধরেই একে একে জন্ম নেয় ভারতের প্রথম টিস্যু কালচার এবং পরীক্ষামূলক জীববিদ্যার গবেষণাগার। ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি ছিলেন আদরের ‘বাই’, কিন্তু কাজের ব্যাপারে একেবারে কড়া নিয়মানুবর্তী। লোকমুখে শোনা যেত, তাঁর নিজস্ব গবেষণাগারে নাকি কখনও আলো নিভত না! গবেষক হিসেবে তাঁর সাফল্যও তেমনই নজরকাড়া। স্তন ক্যানসার, লিউকেমিয়া ও খাদ্যনালীর ক্যানসার সংক্রান্ত গবেষণায় প্রাণী মডেল ব্যবহার করে তিনি একের পর এক সাড়া জাগানো কাজ করে গেছেন। ক্যানসারের প্রবণতার সঙ্গে হরমোন এবং টিউমর ভাইরাসের সম্পর্ক বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল কমলের কাজ। এমনকি স্তন ক্যানসার যে বংশগত হতে পারে, এই ধারণার আভাসও দিয়ে গেছিলেন তিনি। পাশাপাশি মাইকোব্যাক্টেরিয়াম জীবাণু নিয়ে তাঁর গবেষণা কুষ্ঠ প্রতিরোধী ভ্যাক্সিনের উন্নতিতে দারুণ সহায়ক হয়েছিল। 


কর্মক্ষেত্রে এতটা সফল হয়েছিলেন বলেই হয়তো কমল বুঝেছিলেন, এদেশে বিজ্ঞানচর্চায় সাফল্য পেতে হলে একজন পুরুষের তুলনায় এক মহিলাকে কতটা বেশি পরিশ্রম করতে হয়। পুরুষের সাফল্য তার কাজে, কিন্তু নারীর সাফল্য মাপার সময় আমাদের সমাজ দেখে পেশার পাশাপাশি সে সংসারে কতটা সময় দিল! নিজের রিসার্চ পেপারের সঙ্গে সন্তানের রিপোর্ট কার্ডেও লাল দাগ থাকলে চলে না। কমল রণদিভে ভাগ্যবান, তাই জয়সিং রণদিভের মতো বন্ধুকে পাশে পেয়েছেন, কতজন শুধুমাত্র পরিবারের অসহযোগিতায় বা সামান্য একটু সুবিধার অভাবে বিজ্ঞানচর্চার স্বপ্নকে ছুঁতে পারার কয়েক যোজন আগেই পথচলা থামিয়ে দেয়। তাদের কথা মাথায় রেখেই ১৯৭৩ সালে কমল ও তাঁর কিছু সহকর্মী মিলে ভারতের প্রথম মহিলা বিজ্ঞানীদের সংগঠন ‘Indian Women Scientists’ Association (IWSA)’ তৈরি করেন। সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল গবেষণায় উৎসাহী মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে আবশ্যিক সুযোগসুবিধাটুকু নিশ্চিত করা এবং বুনিয়াদি স্তরে মেয়েদের মধ্যে বিজ্ঞান গবেষণার প্রসার ঘটানো। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ১১টি শাখা এবং কয়েক হাজার সদস্য সমন্বিত IWSA দেশের প্রথম সারির বিজ্ঞান সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম। বিবাহিত মহিলা বিজ্ঞানীদের জন্য হস্টেল এবং তাদের সন্তানদের দেখভালের জন্য ডে-কেয়ারের সুবিধা প্রদান করে এই সংগঠন – পেশা ও পরিবারের মধ্যে টানাপোড়েন কমাতে তা অনেকটাই সাহায্য করে। 

কমল রণদিভের কাজ কিন্তু এখানেই থেমে যায়নি। অবসরের পরেও তিনি আদিবাসী মহিলা ও শিশুদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত সমস্যা নিয়ে কাজ করে গেছেন। ‘সত্য নিকেতন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার সঙ্গে মহারাষ্ট্রের আহমেদনগর জেলার আকোলা তালুকে আদিবাসী শিশুদের পুষ্টির ঘাটতি নিয়ে রীতিমতো সমীক্ষা চালিয়ে তিনি বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করেন, যা পরবর্তীকালের স্বাস্থ্য কর্মসূচি রূপায়নেও সাহায্য করেছে। IWSA-এর ছাতার তলায় বিভিন্ন সরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রকল্পের মাধ্যমে আহমেদনগর এবং রাজপুর অঞ্চলের আদিবাসী মহিলাদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, চিকিৎসা সংক্রান্ত সুবিধা প্রদান এমনকি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে ওই মহিলাদের ক্ষমতায়নের কাজেও নিরলস খেটে গেছেন তিনি। ২০০১ সালে তাঁর জীবনাবসানের পরেই এমন বর্ণময় কর্মজীবনের ইতি হয়। পেশাগত অজস্র সম্মান তাঁকে ঋদ্ধ করেছে নাকি ঋণী হয়েছে সেই সম্মাননাই, বলা মুশকিল। তবে ১৯৮২ সালে তাঁর পদ্মভূষণ প্রাপ্তি যে দেশেরই গৌরব বাড়িয়েছে, সেটুকু বোধহয় নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। আদ্যন্ত দেশপ্রেমিক মানুষটি এমন সাফল্যমণ্ডিত কর্মজীবনেও বারবার ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন বিদেশে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পরে দেশে ফিরে আসতে। চিরকাল দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, জ্ঞানের প্রকৃত সাফল্য দেশের মানুষের উন্নতিসাধনেই। 

গত বছর নভেম্বরে তাঁর ১০৪তম জন্মদিনে গুগল ডুডল তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। সম্প্রতি আরও একটি আন্তর্জাতিক নারী দিবসও পেরিয়ে এলাম আমরা। এখনও পাশের টেবিলে কাজ করা কোনও এক কমলা রণদিভের প্রতি বাঁকা মন্তব্য না করে শ্রদ্ধাশীল হতে পেরেছি কি? 

তথ্যসূত্র: 

১) Obsessed with excellence – Kamal Ranadive; Rajani Bhisey

২) Dr Kamal Ranadive, the cancer researcher who made science more inclusive in India; The CSR Journal


#সিলি পয়েন্ট #বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি #কমল রণদিভে #সায়নদীপ গুপ্ত #বাংলা পোর্টাল #বিজ্ঞান #মহিলা বিজ্ঞানী #kamal ranadive #science # scientist #silly point #IWSA

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

5

Unique Visitors

219107