নিবন্ধ

আগাথা ক্রিস্টির সন্ধানে

কৌশিক মজুমদার Jan 12, 2021 at 6:07 am নিবন্ধ

১৯২৬ সালের ৭ ডিসেম্বর, ডেইলি মিরর পত্রিকার পাতা খুলেই চমকে উঠলেন পাঠকরা। প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে খবর : Mystery of Woman Novelist’s Disappearance। সঙ্গে মেয়ে রোজালিন্ডকে কোলে নিয়ে আগাথা ক্রিস্টির ছবি। তিনিই নাকি রহস্যজনকভাবে হারিয়ে গেছেন।

তখন ইংল্যান্ড তো বটেই, প্রায় গোটা ইংরাজি বলা জগৎ সবে নড়েচড়ে বসেছে আগাথার লেখা নিয়ে। সদ্য প্রকাশ পেয়েছে “দি মার্ডার অফ রজার অ্যাক্রয়েড”, যা সেই বছরের তো বটেই, আজ অবধি পৃথিবীর সেরা গোয়েন্দা উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটা। আগাথা সানিংডেলে নতুন বাড়িতে উঠে এসেছেন। সঙ্গে স্বামী আর্চি আর মেয়ে। আপাতদৃষ্টিতে সবই তো স্বপ্নের মতো। তাহলে মহিলা গেলেন কোথায়? দাবানলের মতো গুজব ছড়িয়ে গেল চারিদিকে। কেউ বলল ওই বাড়িটাই অপয়া। আগেও কে একজন ওই বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়েছিল। কেউ বলল বরের সঙ্গে বনছে না মনে হয়। তবে বেশিরভাগ সন্দেহ করল, রহস্যের রানিকে হয়তো কেউ কিডন্যাপ করেছে।

পুলিশ তদন্তে নেমে অদ্ভুত কিছু তথ্য পেল। জানতে পারল গুজবের খানিকটা ঠিক। আর্চির সঙ্গে আগাথার সম্পর্ক স্বাভাবিক না। ন্যান্সি নিলি নামে এক মহিলার সঙ্গে তিনি পরকীয়ায় মত্ত। জেরায় আর্চি জানালেন কিছুদিন আগেই তিনি আগাথাকে জানিয়েছেন, দুজনের একত্রে বাস সম্ভব না। আগাথা যেন তাঁকে ডিভোর্স দেন। প্রায় একই সময়ে মারা গেলেন আগাথার সবচেয়ে কাছের মানুষ। তাঁর মা ক্লারা। পরপর এই দুই ঘটনায় আগাথা বিপর্যস্ত। 

৩ ডিসেম্বর, ১৯২৬।  রাত ৯.৪৫।  আগাথা হাতে কিছু পোশাক বোঝাই ব্যাগ নিয়ে তরতরিয়ে উঠে গেলেন বাড়ির দোতলায়। ফায়ারপ্লেসের ধারে পুতুল খেলছিল মেয়ে। তাঁর কপালে গালে চুমু খেয়ে আগাথা জানালেন তিনি একটু বেরোচ্ছেন। “কোথায় মা?” জিজ্ঞেস করতে উত্তর এল না।  কাজের মহিলাদের সেটুকুও জানাননি আগাথা। শুধু বিকেলে বলেছিলেন রাতে আর ফিরবেন না। বাড়িতে আর্চি নেই, হয়তো ন্যান্সির কাছে। প্রচণ্ড ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে নিজেই গাড়ি নিয়ে স্টাইলস থেকে বেরিয়ে গেলেন পোয়ারোর স্রষ্টা। আগাথার পাঠকদের মনে থাকবে, এই স্টাইলসেই প্রথমবার এক মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার হওয়াতে ডিমের মতো মাথার এক প্রৌঢ় গোয়েন্দা প্রথমবার মাঠে নেমেছিলেন। 

তারপরেই যেন হাওয়ায় ভ্যানিশ হয়ে গেলেন আগাথা। তাঁর মরিস কাউলি গাড়িটা পাওয়া গেল পরের দিন গিল্ডফোর্ডের নিউল্যান্ডস কর্নারে। গাড়ির মধ্যে আগাথার লম্বা ফারের কোট, কিছু জামাকাপড় আর এক্সপায়ারি হয়ে যাওয়া একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স। মানুষটাই গায়েব! এক চাষি জানাল ৪ তারিখ সকালে রাস্তা দিয়ে এক মহিলাকে সে পায়ে হেঁটে আসতে দেখেছে। মহিলা নাকি স্বাভাবিক ছিলেন না। “যেন ভূতে ভর করেছে” জানাল সেই চাষি, দুই হাতে মাথা চেপে ধরে আর্তনাদ করতে করতে প্রায় ছুটছিলেন সেই মহিলা। ঠান্ডায় দাঁতে দাঁতে খটখট শব্দ হচ্ছিল। সেই তীব্র শীতে পরনে শুধু পাতলা সুতির এক গাউন। মহিলা সেই চাষির কাছে এসে প্রায় হাতে পায়ে ধরেছিলেন গাড়ি স্টার্ট করে দেবার জন্য। সেই চাষি গাড়ি চালাতে জানে না। মহিলা তেমনভাবেই হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যেন চলে গেলেন। চাষির মুখে মহিলার চেহারার যা বর্ণনা পাওয়া গেল তা অবিকল আগাথার মতো। কোথায় গেলেন আগাথা?



প্রায় ১০০০ পুলিশকর্মী আর ১৫০০০ সাধারণ মানুষ মিলিয়ে তৈরি হল সার্চ কমিটি। ১২ তারিখ সবাই মিলে একত্রে খোঁজে নেমে পড়ল। পত্রিকায় হেডিং হল “দ্য গ্রেট সানডে হান্ট”। ওই একদিনেই প্রায় ৫০০০ মানুষ (যাদের মধ্যে ক্রাইম লেখিকা ডরোথি এল সেয়ার্স-ও ছিলেন) একসঙ্গে কিছু ব্লাড হাউন্ড, অ্যালসেশিয়ান আর অন্য কুকুর নিয়ে নিউল্যান্ড কর্নারের আশেপাশের বেশ কয়েকমাইল চিরুনি তল্লাশি চালালেন। কোনও লাভ হল না। সেই প্রথম এই সার্চ পার্টির সঙ্গে যোগ দিল পুলিশের বিমান। পাশেই ছিল কুখ্যাত সাইলেন্ট পুল। বহু মহিলার লাশ নাকি পাওয়া গেছে সেই পুলের অতলে। ডুবুরি নামল সেখানেও। একটা কালো ভ‍্যানিটি ব্যাগ ছাড়া আর কিচ্ছু পাওয়া গেল না। গতিক ভালো না বুঝে পুলিশ শার্লক হোমসের স্রষ্টা ডয়েল সাহেবকে অনুরোধ করল। অনুমান ও ডিডাকশান দূরে থাক, ডয়েল প্ল্যানচেট করতে বসলেন। আগাথার ব্যবহার করা এক গ্লাভস হাতে নিয়ে বসে থাকা মিডিয়ামের মুখ দিয়ে আত্মা জানাল, “ক্রিস্টি বেঁচে আছেন। ফিরে আসবেন আগামী বুধবারের মধ্যেই।”

দিন কেটে যায়। আগাথার খোঁজ পাওয়া যায় না। সন্দেহের তির আর্চির দিকে। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার না করলেও গৃহবন্দি করে রাখল। তদন্তে জানা গেল হারিয়ে যাবার আগে নিজের সহকারীকে বলে ইয়র্কশায়ারের হোটেলে উইকএন্ড কাটানোর সমস্ত প্ল্যান বাতিল করেন আগাথা। এদিকে প্রায় একই দিনে তাঁর দেওরকে চিঠি লিখে জানান, “আসছি ইয়র্কশায়ারে”। কেন? পুলিশ বুঝল একমাত্র পোয়ারো ছাড়া এই কেস সলভ করার সাধ্যি কারও নেই। 

খবর এল পরের বুধবার। যেমন ডয়েল বলেছিলেন। হ্যারোগেটের হাইড্রোপ্যাথিক হোটেল থেকে জানা গেল হপ্তা দেড়েক আগে এখানেই চেক ইন করেছিলেন আগাথা। নাম লিখেছিলেন মিসেস টেরেসা নিলি। বরের প্রেমিকার পদবি। ছোট্ট একটা রুমে থাকতেন সারাদিন। অবসরে হোটেলের লবিতে অন্যদের সঙ্গে ব্রিজ খেলতেন আর আলোচনা করতেন এই আগাথা ক্রিস্টি নামের মহিলার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে। কেউ ধরতেই পারেনি, তিনিই স্বয়ং সেই হারিয়ে যাওয়া লেখিকা। কেউ কেউ বলেছিলেন বটে, মহিলার সঙ্গে আগাথার দারুণ মিল, কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষ চেপে গেছিলেন। প্রতি সন্ধ্যায় হোটেলের ব্যান্ড শুনতে যেতেন মিসেস লিলি। আর সেখানেই ব্যান্ডের স্যাক্সোফোনিস্টের চোখ তাঁকে চিনে নেয়। হোটেলের কাউকে না জানিয়ে সরাসরি পুলিশে খবর দিয়েছিল সে।

আগাথাকে পাওয়া যাবার পর চারিদিকে যে হইহই শুরু হল তা হারানোতেও হয়নি। সবাই জানতে চায় কী হয়েছিল আচমকা! স্ক্যান্ডালের গন্ধে ভরে উঠতে লাগল ট্যাবলয়েডের পাতা। স্বামী আর্চি জানালেন কোনও কারণে সাময়িক স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল আগাথার। সেই সময়ের কিছুই তাঁর মনে নেই। প্রেস বিশ্বাস করল না। পরে আগাথাও একবারই বলেছেন এই ঘটনা নিয়ে, “গাড়িটার অ্যাক্সিডেন্ট হওয়াতে মাথায় চোট লাগে। তারপরের ২৪ ঘণ্টা কীভাবে কেটেছে আমার কিচ্ছু মনে নেই। আমি যেন ঘুমের মধ্যে রয়েছি। হ্যারোগেটের হোটেলে যখন পৌঁছলাম মনের মধ্যে কে যেন বলে দিল, আমার নাম টেরেসা। আমি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসেছি।”

আগাথার জীবনীকার জ্যানেট মর্গান প্রেসক্রিপশান দেখিয়ে প্রমাণ করেছেন, ঘটনাটা মোটেও একেবারে ভাঁওতা না। সেই সময় আগাথা রীতিমতো স্মৃতিভ্রংশ রোগে ভুগছিলেন। তাঁর চিকিৎসাও চলছিল এক মনোবিদের কাছে। গাড়ির দুর্ঘটনার কথা তাঁর মনে নেই। কিন্তু গিল্ডফোর্ড থেকে ওয়াটারলু এক দুধের গাড়িতে আর সেখান থেকে হ্যারোগেটে ট্রেনে করে যাবার কথা পরে তাঁর মনে পড়েছিল। তাঁর হাত দিয়ে আর কপাল দিয়ে রক্ত ঝরার কথাও মনে ছিল তাঁর। কিন্তু তিনি কে, কেন এই ট্রেনে যাচ্ছেন, সে বিষয়ে কিচ্ছু না। আগাথার সপক্ষে আরও প্রমাণ দেওয়া যায়। আগাথার টাকা ফুরিয়ে আসছে। তিনি মনে করতে পারছেন না তিনি কে। এই মর্মে টাইমস পত্রিকায় তিনি ১১ ডিসেম্বর একটা বিজ্ঞাপনও দেন। তাতে লেখা, “দক্ষিণ আফ্রিকার মিসেস টেরেসা নিলির আত্মীয় বা বন্ধুরা দয়া করে যোগাযোগ করবেন। জরুরি দরকার”।

তবে আগাথার এই গল্প অনেকেই বিশ্বাস করেন না। আর্চিকে শাস্তি দিতে ইচ্ছে করেই এই কাজ করেছিলেন বলে বেশিরভাগের ধারণা। আর্চি ঠিক করেছিলেন উইকএন্ডটা ন্যান্সির সঙ্গে কাটাবেন। আগাথার এই হারিয়ে যাওয়াতে তাঁর প্ল্যান বরবাদ তো হলই, তিনি গ্রেপ্তার হতে হতে বাঁচলেন। কেউ আবার বলেন, ওসব কিচ্ছু না। নতুন বইয়ের জন্য পাবলিসিটি স্টান্ট। নিজের নামকে ছড়িয়ে দেবার কৌশল। যদি সত্যিই তাই হয়, তবে কৌশল কাজে লেগেছিল। এই ঘটনার পরেই তাঁর বইয়ের বিক্রি দশগুণের বেশি বেড়ে গেল। পরের বছরই এক বৃদ্ধাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে গোয়েন্দা গল্প লিখলেন তিনি। ‘দ্য টুইসডে নাইট’ ক্লাবের সেই গোয়েন্দানির নাম মিস মার্পল। আর্চি আলাদা থাকতে শুরু করলেন। আগাথার সঙ্গে ম্যাক্স আলোয়ানের বিয়ে হল। আলাপ দুই বছর আগেই হয়েছিল। আগাথা বছরে দুটো করে বেস্টসেলার উপহার দিতে থাকলেন। বিক্রি আকাশ ছুঁল। 

১৯৭৬ সালে ৮৫ বছর বয়সে যখন মারা যান, তখন বইয়ের বিক্রিতে যিশু আর শেক্সপিয়র ছাড়া আর কোনও প্রতিদ্বন্ধী নেই তাঁর সামনে। মজার ব্যাপার, জীবনে আর কোনোদিন নিজের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করেননি আগাথা।         


#agatha christie #detective novels #Hercule Poirot # Miss Marple #Disappearance #Mystery #রহস্য #কৌশিক মজুমদার #সিলি পয়েন্ট #Daily Mirror

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

60

Unique Visitors

215951