বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

জ্ঞানের আলো ছড়ানোয় খুন হতে হয়েছিল হাইপেশিয়াকে

অর্পণ পাল Nov 2, 2021 at 2:54 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বহুদিন আগে, মানে এখন থেকে দেড় হাজার বছরেরও বেশি আগে, মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের রাজপথ ধরে এগিয়ে চলেছিল একটি মিছিল। এক দল লোক নিয়ে সেই মিছিল, ধর্ম পরিচয়ে তারা প্রত্যেকে খ্রিস্টান, আর সেটাই সেদিন ছিল তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়। এই দলের নাম ‘প্যারাব্যালানি’, চার্চের আর্চবিশপ নিযুক্ত এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনির মূল লক্ষ খ্রিস্ট ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা করায় নজর দেওয়া। তাদের পুরোভাগে পিটার দ্য লেক্টর নামে একটি লোক, সে-ই নেতাগোছের। আর তাদের সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল একটি ঘোড়ার গাড়ি। তারা ওই গাড়িটাকে নিয়ে এল একটা চার্চের সামনে। আর গাড়ি থেকে যাকে টেনে নামানো হল, না তিনি কোনও দাগি আসামি বা অপরাধী নন, তিনি একজন মহিলা! তবে ওই ক্ষুব্ধ জনতার চোখে তিনি অপরাধীই।

তারপর, নৃশংসভাবে ওই মহিলাটিকে হত্যা করল ওই উন্মত্ত জনতা।  

ওই দলের সদস্যদের হাতে এর আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ার বহু প্যাগান মন্দির, পুথিপত্র বা স্থাপত্য। আর এবারে তারা এমন একজনকে হত্যা করল, যাঁর একমাত্র অপরাধ ছিল মানুষকে জ্ঞান বিতরণ করা। হ্যাঁ, হাইপেশিয়া নামে ওই মহিলার পরিচয় তিনি সে আমলের একমাত্র মহিলা গণিতজ্ঞ এবং দার্শনিক। কেবলমাত্র লিঙ্গ-পরিচয়ে নারী হয়েও জ্ঞানদানে পুরুষের পাশাপাশি নিজেকে নিয়োজিত করবার ‘অপরাধে’ই তাঁকে মরতে হয়েছিল ধর্মান্ধ কিছু দুর্বৃত্তের হাতে। কিন্তু ৪১৫-৪১৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে ঘটে যাওয়া ওই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারানো মহিলাটির অপরাধ কী ছিল? আর কেন-ই বা তাঁকে আমরা প্রথমেই ‘অপরাধী নন’ বলে ঘোষণা করলাম? এই দুই মন্তব্যের ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে কয়েকশো বছর। 

শিল্পীর চোখে হাইপেশিয়ার মৃত্যু মিছিল 

হাইপেশিয়ার আমলের চেয়ে আরও সাতশো বছর আগে, খ্রিস্ট-পূর্ব ৩৩১ সালে আলেকজান্ডার দি গ্রেট পত্তন করেন আলেকজান্দ্রিয়া শহরের। আরও পুরনো আমলের এক বন্দর-শহর রাকোটিসকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয় এই শহরকে। শোনা যায় যে আলেকজান্ডার নিজেই নাকি এই শহরের প্ল্যান বানিয়েছিলেন, আর তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর ক্লিওমেনিস-কে সেই প্ল্যান অনুযায়ী শহর গড়ে তোলার দায়িত্ব দিয়ে নিজে রাজ্যবিজয়ে বেরিয়ে পড়েন। আলেকজান্ডারের পরে যিনি রাজা হয়েছিলেন, সেই প্রথম টলেমির আমলে শহরটি আরও বেশি পূর্ণতা পায়। 

এই টলেমির আমলেই আলেকজান্দ্রিয়ায় গড়ে ওঠে এক লাইব্রেরি, একটি মিউজিয়াম এবং একটি মন্দির। এবং খুব দ্রুতই শহরটি ওই আমলের শিল্প সংস্কৃতিচর্চার এক প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বলতে গেলে এই শহরের ভরকেন্দ্র ছিল ওই লাইব্রেরিটি। আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত সে লাইব্রেরি। যেখানে পাঁচ লক্ষেরও বেশি পুথির সমাহার। অবশ্য তখন একে লাইব্রেরি বা বিশ্ববিদ্যালয় আখ্যা দেওয়া হত না, একে বলা হত মিউজিয়াম। আর ওই লাইব্রেরি-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টানে এখানে পৃথিবীর দূর দূর প্রান্ত থেকে উৎসাহী মানুষ ছুটে আসত শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে। সব মিলিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া তখন জমজমাট এক শহর। 

আলেকজান্দ্রিয়া টেনে এনেছিল সে আমলের বেশ কয়েকজন বড় বড় দিকপাল দার্শনিককেও। গণিত হোক বা জ্যোতির্বিদ্যা, বা জ্যামিতি, বা অন্য কোনও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র, বিকশিত হয়েছিল এরকম বেশ কিছু ধারাই। এঁদের মধ্যে কিছু নাম তো আমাদের পরিচিতই— আর্কিমিডিস, এরাটস্থেনিস, ইউক্লিড। এখানে বসেই এরাটস্থেনিস পৃথিবীর ব্যাসার্ধের মান পরিমাপ করেন। ইউক্লিডও পড়াতেন এই শহরে, আধুনিক জ্যামিতির গোড়াপত্তন তো তাঁরই হাতে। 

আলেকজান্দ্রিয়ার পতনের দিকে যাত্রা শুরু হল ৪৮ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের দিকে, যখন জুলিয়াস সিজার আক্রমণ করলেন এই শহরকে। জ্বালিয়ে দিলেন তার বিখ্যাত গ্রন্থাগারটিকে। পুড়ে ছাই হয়ে গেল কত সব জানা অজানা মানুষের সারা জীবনের পরিশ্রমের ফসল। রোমান সম্রাট কনস্টানটাইনের আমলে এই শহরের মূল ধর্ম হিসেবে বিবেচিত হয় খ্রিস্ট প্রবর্তিত ধর্মমত, আর আস্তে আস্তে শহরের অধিকাংশ মানুষ এই ধর্মেই দীক্ষিত হতে শুরু করে। আগেকার প্যাগান ধর্মমত আর নব্য খ্রিস্ট ধর্ম, এই দুই দলে প্রায়ই লেগে যেত দ্বন্দ্ব। তা থেকে ঝগড়া, মারামারি। 

আর সেই বিখ্যাত লাইব্রেরির শেষ যে ব্যক্তিটির উল্লেখ মেলে ইতিহাসে, তিনি থিওন; হাইপেশিয়ার বাবা, এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ অধ্যাপক। সে আমলের অনেক বিদ্বান ব্যক্তির লেখাপত্রই কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও এই থিওনের কিছু রচনা টিকে গিয়েছে কালের করাল হাত এড়িয়ে। যেমন বিখ্যাত জ্যামিতিবিদ ইউক্লিডের ‘এলিমেন্টস’-এর একটি ব্যাখ্যা-ভাষ্য।

হাইপেশিয়ার জন্ম কবে, ঠিক করে জানাই যায় না। কেউ কেউ বলেন, ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম তাঁর, কেউ বা বলেন ৩৫৫ বা ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ। তবে যে সালেই জন্ম হোক, তাঁর জীবৎকালের কোনও ঘটনার কথা বিশেষ জানা যায় না। একটাই বিষয় নিশ্চিত করে কিছুটা বিস্তারিতভাবে জানা যায়, সেটা হল তাঁর হত্যাকাণ্ড। আর অবাক করবার মতো ব্যাপার, সে ইতিবৃত্তও জানা যায় যাঁদের লেখাপত্র থেকে, তাঁদের অনেকেই খ্রিস্টান। কিন্তু তাঁদের লেখাতেও দেখি যে তাঁরা হাইপেশিয়ার প্রতি নরম মনোভাবই প্রকাশ করছেন। যদিও কেউ কেউ তাঁকে ডাইনি বলতেও ছাড়েননি। 

থিওন-এর কাছেই তাঁর মেয়ের গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা আর দর্শনবিদ্যার পাঠ গ্রহণ। তখনকার দর্শনই পরবর্তীকালে কিছু পরিবর্তিত হয়ে বিজ্ঞান নামে আলাদা শাখায় প্রবাহিত হয়েছে। থিওন, সে আমলের আর পাঁচজন গ্রিক পুরুষের মতো, মেয়েরা শুধু ঘরকন্নার কাজ করবে আর স্বামী-সন্তানের দেখাশুনো করবে, এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সত্যিই চাইতেন যে মেয়েরাও পুরুষদের মতোই জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা করুক। সুতরাং হাইপেশিয়া আস্তে আস্তে গড়ে উঠলেন পুরুষদের মতো করেই। আলেকজান্দ্রিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্ব পেলেন পুরুষদের মতোই। তাঁর আগে ওই প্রতিষ্ঠানে আর কোনও মহিলার প্রবেশাধিকার জোটেনি। 

আলেকজান্দ্রিয়ায় হাইপেশিয়ার পাঠশালা; শিল্পী - রবার্ট ট্রিউইক বোন; ইয়েল সেন্টার ফর ব্রিটিশ আর্ট

হাইপেশিয়া অবিবাহিত ছিলেন। যদিও তাঁর পাণিপ্রার্থীর অভাব ছিল না মোটেই, কিন্তু তিনি কাউকেই নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে চাননি; চেয়েছেন জ্ঞানচর্চাকেই আঁকড়ে থাকতে। পড়াশুনো আর শিক্ষাদানই ছিল তাঁর একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। তাঁর আরও একটা সুবিধা ছিল, তিনি ওই বিখ্যাত লাইব্রেরিটিরও সাহায্য নিতে পেরেছিলেন পুরোমাত্রায়। সে আমলের ইতিহাস-লেখকেরা হাইপেশিয়ার পড়ানোয় দক্ষতা, নানা বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি এবং তাঁর জ্ঞানার্জনের জন্য ব্যাকুলতার কথা লিখে রেখে গিয়েছেন। বহু দূর দুরান্ত থেকে নাকি তাঁর কাছে মানুষজন আসতেন জ্ঞান অর্জন করতে। 

হাইপেশিয়ার এক বন্ধুর নাম ছিল অরেস্টাস। ইনি ছিলেন রোমের এক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী এবং ইজিপ্টের সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গভর্নর। আর পাঁচজনের মতো ইনিও চেয়েছিলেন হাইপেশিয়াকে বিয়ে করতে। হাইপেশিয়া রাজি না হলেও তাঁদের বন্ধুত্বে তা কোনও প্রভাব ফেলেনি। অন্যদিকে তখন আলেকজান্দ্রিয়ার আর্চ বিশপের নাম সিরিল। তিনি আগেকার আর্চ বিশপ তাঁর কাকা থিওফিলাস-এর মতোই দারুণভাবে ধর্মান্ধ। সিরিল আর্চবিশপ হওয়ার পরেই দারুণ ঝামেলা বেধে যায় খ্রিস্টান আর ইহুদি ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে। তিনি এই ঝামেলাতে ইন্ধন জোগাতে কসুর করেননি। যদিও অরেস্টাস কিন্তু চাইতেন ঝামেলা মেটাতে। অন্যদিকে সিরিল আবার চাইতেন দ্রুত শেষ করে ফেলা হোক আলেকজান্দ্রিয়ার পাঠাগারটি। সে ব্যাপারেও তাঁকে বাধা দিতে এগিয়ে এলেন অরেস্টাস। ধর্ম-পরিচয়ে খ্রিস্টান হয়েও অরেস্টাস দাঁড়িয়েছিলেন হাইপেশিয়ার মতো বিধর্মী একজন জ্ঞান-প্রচারকের পাশেই। সুতরাং দ্বন্দ্ব শুরু হল সিরিল আর অরেস্টাসের মধ্যে। কিন্তু ক্ষমতার শিখরে থাকবার কারণেই এগিয়ে রইলেন সিরিল; তিনি পাশে পেয়েছিলেন তাঁরই মতো বহু খ্রিস্টান উন্মাদকে, যারা যে ভাবেই হোক প্যাগান ধর্মের সমর্থকদের জব্দ করতে উৎসাহী। আর এই ধর্মের এক বড় বিশ্বাসী হলেন হাইপেশিয়া নিজেই। সুতরাং অরেস্টাসকে নিজেদের দলে টেনে নিতে সকলে ঠিক করল, জব্দ করতে হবে হাইপেশিয়াকে। এমনিতেই তাঁর খ্যাতি বর্ধিত হচ্ছিল বলে তাঁর ওপর খ্রিস্টান চাঁইদের রাগ জমে ছিলই। 

আসলে জ্ঞানের প্রচার বা প্রসারে নিয়োজিত থাকবার কারণেই শুধু নয়, ধর্মবিশ্বাসে স্থিত থাকবার কারণেও হাইপেশিয়া চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন খ্রিস্টান আর্চ বিশপ এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের। আর উন্মত্ত জনতা কী করতে পারে, সে তো জানাই আছে! খোলা রাস্তা দিয়ে মিছিল করে তাঁকে টেনে নিয়ে যাওয়া, তাঁর দেহে ঝিনুকের খোলা দিয়ে ঘষে ঘষে চামড়া তুলে দেওয়া আর শেষে একটা চার্চের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে প্রচুর শারীরিক অত্যাচার করে তবে তাঁকে মেরে দেওয়া সবই ঘটল পরপর, সম্ভবত পূর্বপরিকল্পিতভাবেই। এরপরে তাঁর দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে কেটে সেগুলোকে পুড়িয়েও দেওয়া হয়। বিরুদ্ধ মতের সমর্থককে এইভাবে পাশবিক উপায়ে হত্যা করা ইতিহাসে বহু দেখা গিয়েছে; তবে সেরকম কর্মকাণ্ডে ধার্মিক মানুষেরাও যে বড় কম যায় না, এ ঘটনা তার জীবন্ত প্রমাণ। 

সিরিল নিজে কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে নিজেকে মোটেই জড়াতে চাননি। যদিও তিনি হাইপেশিয়া যে নির্দোষ ছিলেন, এমনটাও বলেননি। হাইপেশিয়া মূর্তি-পুজোয় বিশ্বাসী ছিলেন, আর এইটাই তো তাঁর পক্ষে সবচেয়ে বড় অপরাধ, বক্তব্য ছিল তাঁর। 

হাইপেশিয়া সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা যায় না, পাওয়া যায় না তাঁর লেখাপত্রের হদিসও। তবু দেড় হাজার বছর আগেও যে একজন নারী একাই এগিয়ে এসেছিলেন জ্ঞানভাণ্ডার খোলার চাবি হাতে নিয়ে, এবং সে জন্য তাঁকে মারতে পর্যন্ত দ্বিধা করেনি ধর্মীয় উন্মাদেরা, এইটুকু ইতিহাস আমাদের মনে রাখতেই হয়। 

******************************** 

প্রচ্ছদ: জুলস মরিস গ্যাসপার্ড চিত্রিত প্রতিকৃতি   

ছবিঋণ: ইন্টারনেট 

********************************

#হাইপেশিয়া #আলেকজান্দ্রিয়া #দার্শনিক #শিক্ষাবিদ #খ্রিস্টান #প্যাগান #বিজ্ঞান #কুসংস্কার #নারীবিদ্বেষ #লাইব্রেরি #অর্পণ পাল #বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি #সিলি পয়েন্ট #বাংলা পোর্টাল #ওয়েবজিন #web portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

20

Unique Visitors

219128