ফিচার

খিদে পেয়েছে, ইন্ডিয়া?

টিম সিলি পয়েন্ট Oct 31, 2020 at 4:52 am ফিচার

ছয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গ যখন খাদ্য আন্দোলনে উত্তাল, প্রতিবাদ-মিছিল লক্ষ করে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন মন্তব্য ছুড়েছিলেন, “কাঁচকলা খাও।” ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তেমন আত্মঘাতী কথাবার্তা বলার লোক না। তিনি ক্ষুধার্ত ভারতবাসীকে শুরু থেকেই মন্দির বা পাকিস্তান খাওয়ান, এবং এমনই সর্বগ্রাসী হিপনোটিজমের রাজনীতি ভারতের বর্তমান শাসক দলের যে তাতে এখনও পর্যন্ত অনেক ভারতবাসীর পেট ভরাও থাকছে।

অথচ বাস্তব পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর, সেটা বোঝা যায় সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচক বা Global Hunger Index-এর রিপোর্টে ১১৭ টি দেশের মধ্যে তুল্যমূল্য বিচারে ১০২ নম্বরে নেমে গিয়েছিল ভারত। এ বছর প্রকাশিত রিপোর্টে ১০৭ টি দেশের মধ্যে ভারত ৯৪ তম স্থানে। দৃশ্যত কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে মনে হলে জানিয়ে রাখা ভালো, গতবারের তালিকায় থাকা ১০ টি দেশের তথ্য এবার পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেলে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এর দেশের রেজাল্ট আরও লজ্জাজনক হত। 


অপুষ্টি, শিশুমৃত্যু, পাঁচ বছরের চেয়ে কমবয়সি শিশুর উচ্চতার তুলনায় কম ওজন ইত্যাদি কয়েকটি মাপকাঠিতে বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি বিচার করে তৈরি হয় বিশ্ব ক্ষুধা সূচক। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ১৪ শতাংশ ভারতবাসীই অপুষ্টির শিকার। শিশুমৃত্যুর হার ১৭.৩ শতাংশ। এই রিপোর্টে সর্বমোট ৫০ নম্বরের মধ্যে ভারতের স্কোর ২৭.২, যাকে ‘গুরুতর’ শ্রেণিতে রেখেছে GHI। এই সূচকে প্রাপ্ত নম্বর যত বেশি, পরিস্থিতি তত উদ্বেগজনক। GHI -এর হিসেবে ২০ থেকে ৩৪.৯ পর্যন্ত ‘serious’, ৩৫ থেকে ৩৯.৯ পর্যন্ত ‘alarming’ এবং ৪০ এর ওপরে ‘extremely alarming’। শেষ শ্রেণিতে GHI এবার কোনও দেশকেই রাখেনি। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, প্রতি বছর প্রকাশিত এই রিপোর্ট তার আগের বছরের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। ফলে ভাইরাস-লাঞ্ছিত চলতি বছরের ছবি যখন ২০২১ সালের ক্ষুধাসূচকে প্রকাশ পাবে, ততদিনে পৃথিবীর অবস্থা কেমন দাঁড়াবে বলা মুশকিল। GHI কর্তৃপক্ষ এই রিপোর্টের ভূমিকায় সেই দুশ্চিন্তাই প্রকাশ করেছেন - “while the 2020 GHI does not yet reflect the impacts of COVID-19, it shows that the situation is already worrying in many contexts and is likely to worsen in the years to come.” ভাবলে অবাকই লাগে যে ভারতের চেয়ে ভালো জায়গায় রয়েছে পাকিস্তান (৮৮), বাংলাদেশ(৭৫), শ্রীলঙ্কা(৬৪), মায়ানমার(৭৮) বা নেপালের (৭৩) মতো দুর্বল অর্থনীতির প্রতিবেশীরা। এ বছরের সূচকে ভারতের থেকে খারাপ অবস্থায় রোয়াণ্ডা, চাদ, আফগানিস্তান, লাইবেরিয়ার মতো একেবারে হতদরিদ্র কয়েকটি দেশ। ঢাকঢোল পিটিয়ে ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতি ফুলিয়ে এই শাইনিং ইন্ডিয়া তাহলে ঠিক কোনদিকে এগোচ্ছে? ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগেই ভারতের যে ছবি এই রিপোর্ট দেখাচ্ছে, ভাইরাসের ধাক্কায় সে দেশের অবস্থা মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতোই হবে তা বলাই বাহুল্য। 


যে দেশ ২০২২-এর মধ্যে চিনের চেয়েও বড় অর্থনৈতিক মহাশক্তি হবার দিকে এগোচ্ছে বলে দাবি-টাবি করা হচ্ছে, গত সেপ্টেম্বরে তার জিডিপি নামতে নামতে এসে ঠেকেছিল মাইনাস ২৩.৯ শতাংশে। সম্প্রতি অক্সফ্যাম ‘Commitment in reducing inequality index 2020’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী সমীক্ষা করা ১৫৩ টি দেশের মধ্যে মাত্র ২৬ টি দেশ প্রতিশ্রুতিমতো বাজেটের ১৫% স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করেছে। ভারতের স্থান এই তালিকায় ১৫৫ কারণ মোদি সরকার স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের ৪ শতাংশের চেয়েও কম খরচ করেছে। এপ্রিল থেকে অগাস্ট মাসের মধ্যে দেশে বাঁধা বেতনের চাকরি গিয়েছে ২.১ কোটি। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কত চাকরি গেছে, সে হিসেবের কোনও পিতা-মাতা নেই। কাজ হারিয়ে, চাকরি হারিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ, অথচ এই ক্ষয়প্রাপ্ত সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে সামান্য কয়েকজন পুঁজিপতির হাতে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ভারতের জনসংখ্যার নীচের তলার অর্ধেক মানুষ দেশের মোট সম্পদের মাত্র ৬.৪ শতাংশের মালিক। ওপরের তলার ১ শতাংশ মানুষের অধিকারে রয়েছে ৩০ শতাংশ সম্পদ। 

অবিশ্বাস্য শোনাতে পারে, তবে সাধারণ মানুষের এই মর্মান্তিক অবস্থার মধ্যেও ভারতের বিলিওনেয়ারের তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরও ১৫ টি নাম। ব্লুমবার্গ বিলিয়নেয়ার ইনডেক্সের তথ্য অনুসারে আনন্দবাজার পত্রিকা গত ১২ অক্টোবর দেশের প্রথম পাঁচ ধনকুবেরের সম্পত্তি বৃদ্ধির একটি হিসেব প্রকাশ করেছে। দেখা যাচ্ছে এক নম্বরে থাকা মুকেশ অম্বানির সম্পত্তি এ বছর বেড়েছে ২ লক্ষ ৫ হাজার ১৩০ কোটি। লকডাউন শুরু হবার পর থেকে ঘণ্টায় ৯০ কোটি টাকার সম্পদ বেড়েছে মুকেশ অম্বানির, যা অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয় বোধহয়। মোট সম্পদের দিক থেকে দু’ নম্বরে থাকা আজিম প্রেমজি এ বছরের সম্পত্তি বৃদ্ধিতে অম্বানির তুলনায় অনেক পিছিয়ে। তাঁর সম্পত্তি এ বছর বেড়েছে ৩১ হাজার ৯৮ কোটি। এরপর তালিকায় রয়েছেন শিব নাদার (৪০ হাজার ৫৮৮ কোটি), গৌতম আদানি (৬৯ হাজার ৯৩৪ কোটি) এবং সাইরাস পুনাওয়ালা (৪২ হাজার ৬৩২ কোটি)।  ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে, অর্থাৎ মোদির রাজত্বে মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি ১.৬৮ লক্ষ কোটি থেকে বেড়ে ৩.৬৫লক্ষ কোটি হয়েছিল। বৃদ্ধির হার ১১৮%। এ বছর সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৩৪ লক্ষ কোটি। গৌতম আদানির সম্পত্তি ২০১৪ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে ৫০.৪ হাজার কোটি থেকে বেড়ে ১.১ লক্ষ কোটি হয়েছিল। বৃদ্ধির হার ১২১%। এ বছর বেড়ে হয়েছে ১.৫৩ লক্ষ কোটি। 

মুকেশ অম্বানি নিজেকে বাকিদের ধরাছোঁয়ার বাইরে  নিয়ে যেতে পেরেছেন। এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এ বছর ইউরোপের সবচেয়ে ধনী বানার্ড আর্নল্টকে টপকে গিয়েছেন। তিনি এখন দুনিয়ার চতুর্থ সবচেয়ে ধনী মানুষ (জেফ বেজোস, বিল গেটস ও মার্ক জুকেরবার্গের পরেই)। দুনিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে মুকেশই একমাত্র ব্যক্তি যিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ১০ জনের মধ্যে রয়েছেন। মজার ব্যাপার হল, ২০১৪ সালে, যখন বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে, তখন মুকেশ অম্বানির সম্পত্তির মূল্য ছিল ১৮.৬ বিলিয়ন ডলার। তখন তিনি ছিলেন পৃথিবীর চল্লিশতম ধনী ব্যক্তি। ছয় বছরে তার সম্পত্তি প্রায় সাড়ে চারগুণ বেড়ে ৮০ বিলিয়ন ডলার টপকে গিয়েছে। অম্বানির এই সম্পদ বৃদ্ধির পেছনে কোনো সৃজনশীলতা নেই, রয়েছে একচেটিয়া ক্ষমতা। রয়েছে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম (এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে মুষ্টিমেয় বিজনেস টাইকুনদের সঙ্গে সরকারের উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিবর্গের এক অলিখিত অনৈতিক বোঝাপড়া থাকে, যার ফলে উভয়পক্ষই লাভবান হয়)। দ্য ইকোনমিস্টের হিসেব অনুয়ায়ী ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের প্রভাব যে দেশগুলিতে সবচেয়ে বেশি, তাদের মধ্যে ভারত নবম স্থানে রয়েছে। এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ অবশ্য এখানে নেই। পাঠককে শুধু খেয়াল করতে বলি ভারতের এই চূড়ান্ত বৈষম্যমাখা ঘটমান বর্তমানকে।  

সরকার রিলায়েন্স রিটেলের হাতে দেশের সমস্ত খুচরো ব্যবসার ভবিষ্যৎ তুলে দিয়ে পুঁজির একচেটিয়া ঝোঁকের পথ কেটে দিয়েছেন। রিলায়েন্স রিটেলের (জিও মার্ট) সঙ্গে আবার চুক্তিবদ্ধ হয়েছে ফেসবুকের মতো সংস্থাও। বিতর্কিত কৃষি বিল কৃষকদের পরিণতি কোনদিকে নিয়ে যায় সেটাও দেখার। ২০১৮ সালে নরেন্দ্র মোদি জিওকে ভারতের সবচেয়ে বড়ো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে দেন। জিও পেমেন্টস ব্যাঙ্কের সঙ্গে রিলায়েন্সের ৩০:৭০ অনুপাতে যৌথ উদ্যোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। যে পেমেন্টস ব্যাঙ্ক সবে ২০১৫ সালে অনুমোদন পেয়েছিল। এসবিআই-এর বিপুল সম্পদও এখন রিলায়েন্সের করায়ত্ত। ভুললে চলবে না, এসবিআই-য়ের চেয়ারপার্সন অরুন্ধতী ভট্টাচার্যের আমলেই এই চুক্তি সম্পন্ন হয়। ২০১৭ সালের অক্টোবরে তিনি অবসর নেন। তারপর এক বছরের কুলিং অফ কাটিয়েই ২০১৮ সালে তিনি ৫ বছরের জন্য রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পদে যোগ দেন। এমন উদাহরণ অজস্র।  

আইএমএফের সাম্প্রতিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছরে ভারতীয় অর্থনীতির সঙ্কোচনের হার (১০.৩%) ছাপিয়ে যেতে পারে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানকে। মাথাপিছু জিডিপির নিরিখে এ দেশকে টপকে যাওয়ার মুখে বাংলাদেশ। গত কয়েক দিন ধরে এই সমস্ত তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সমালোচনায় কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছে বিরোধী মহল। তাদের প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী যে বার বার বলেন, এক জনকেও তিনি অভুক্ত থাকতে দেবেন না, পরিসংখ্যানে তার প্রতিফলন কোথায়? বরং দেশের মানুষের খারাপ থাকার মূল্যে মোটা হয়ে চলেছে পুঁজিপতিদের হাত। আর্থিক সংকটের জন্য সিনিয়র সিটিজেন বা ছাত্রছাত্রীদের ছাড়সহ শতকরা আশি ভাগ ছাড় তুলে দিল রেল। কিন্তু বহাল থেকে গেল বিধায়ক-সাংসদদের ছাড়। দেশের মানুষ যখন দু-বেলা দু-মুঠো খেতে পাচ্ছে না, চিকিৎসার অভাবে অকালে মারা যাচ্ছে - তখন ৮৮৪০ কোটি খরচ করে প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতির জন্য কেনা হচ্ছে প্রমোদবিমান। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দিল্লি সৌন্দর্যায়ন প্রকল্প, সাততারা হোটেলের সুবিধাযুক্ত সংসদ ভবন তৈরির প্রকল্প ঘোষণা করা হচ্ছে এই করোনার সময়েই। মন্দির-রাজনীতি দিয়ে সব ভুলিয়ে রাখার আয়োজন করা হচ্ছে। এই লজ্জা রাখার জায়গা নেই। খিদে পেলে এদেশে উচ্চারণ করা পাপ। খিদে পেলে বেশি গোলমাল না করে চুপচাপ পরিপাটি মরে যেতে হবে। 


তথ্যঋণ :

১) 2020 Global Hunger Index (October, 2020) 

২) আনন্দবাজার পত্রিকা

৩) পিপলস ম্যাগাজিন (www.peoplesmagazine.in)

৪) www.indiatoday.in 

#Global Hunger Index #GHI #GHI 2020 #বিশ্ব ক্ষুধা সূচক #খাদ্যসমস্যা #খাদ্যসংকট #Hunger #Crony Capitalism #Billionaire #পরিসংখ্যান #GDP #Economic Crisis #Mukesh Ambani #Jio #Narendra Modi #COVID-19 #Monopoly #একচেটিয়া ঝোঁক #অপুষ্টি #শিশুমৃত্যু #Malnutrition #Child Mortality #টিম সিলি পয়েন্ট #Silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

101

Unique Visitors

184834