ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

জিতে যায় ইতিহাস: সায়ন্তন ঘোষালের আলিনগরের গোলকধাঁধা

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য Jan 6, 2021 at 11:48 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

ছবি: আলিনগরের গোলকধাঁধা
মুক্তি: ২০১৮
প্রযোজনা: ঋতম জৈন
পরিচালনা: সায়ন্তন ঘোষাল
কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপ: সৌগত বসু
অভিনয়: অনির্বাণ ভট্টাচার্য, পার্নো মিত্র, কৌশিক সেন, গৌতম হালদার, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আশুতোষ সেনের বাড়িতে কন্যা বৃষ্টির হাত ধরে প্রবেশ ঘটে অনাথ আশ্রমে বেড়ে ওঠা ইতিহাসের মেধাবী ছাত্র সোহমের। বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে সোহমের সুগভীর জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে আশুতোষবাবু বন্ধু সোমনাথ দাসের পাঠানো একটি ধাঁধার অর্থ উদ্ধার করবার ভার দেন তাকে। বাঙালির ইতিহাস আশ্রয় করে বানানো একের পর এক ধাঁধার সমাধান করতে করতে এক ভয়ানক রহস্য উন্মোচন করে ফেলে সোহম, পৌঁছে যায় এমন এক মহামূল্য সম্পদের দোরগোড়ায়, যা হাতিয়ে নেবার জন্য তার পিছনে লেগেছে অসাধু ব্যবসায়ী আমিরচাঁদ মিত্তল।

সায়ন্তন ঘোষালের আলিনগরের গোলকধাঁধা ছবিটির পিছনে রয়েছে একাধিক বাংলা গোয়েন্দাকাহিনির প্রভাব, সত্যজিৎ রায়ের গোরস্থানে সাবধান তার মধ্যে অন্যতম। ব্রিটিশ ভারতের প্রাক্তন রাজধানী কলকাতার বুকে ছড়িয়ে রয়েছে যে অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন, তাদের মাঝে লুকিয়ে আছে অজস্র ভুলে যাওয়া গল্প, ঠিকঠাক কাজে লাগালে যেগুলো থেকে পাওয়া যেতে পারে থ্রিলারের প্রচুর উপাদান। কাহিনি ও চিত্রনাট্যকার সৌগত বসু ঠিক সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছেন। ছবিতে যথেষ্ট ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ থাকলেও তা কখনোই ঘটনাক্রমের গতি কমিয়ে দেয়নি, বরং যথার্থভাবে মিশে গিয়েছে কাহিনির রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলির সঙ্গে। তবে জেমস লং সরণিতে অবস্থিত মিষ্টির দোকানের নাম দীনবন্ধু, নবরত্ন মন্দিরের স্থানে লোহার দোকানের মালিকের নাম গোবিন্দরাম, ওল্ড মিশন চার্চের বর্তমান ফাদারের নাম কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়- এতগুলো কাকতালীয় হজম করে ওঠা একটু কঠিন ব্যাপার বইকী। পুরোহিতবেশী মনু মুখোপাধ্যায় যখন প্রাচীন কলকাতার প্রবাদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘আজকালকার ছেলেছোকরারা তো এসব মানে টানে না, জানতেও চায় না’, তাঁর কণ্ঠে যেন ধ্বনিত হয় ইতিহাসবিমুখ বাঙালি জাতির প্রতি পূর্বপুরুষদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। বাঙালির ইতিহাস আজ প্রকৃতই বড় উপেক্ষিত, সামাজিক অনুষ্ঠান বা জমায়েত তো দূরের কথা, ক্লাসের মধ্যে তার অবতারণা করলেও অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর মুখে দেখা যায় বিরক্তির ছাপ। সায়ন্তন ঘোষালকে কুর্নিশ, তিনি এমন একটা ছবি বানিয়েছেন যা ইতিহাসনির্ভর হলেও দর্শককে পর্দার সামনে বসে থাকতে বাধ্য করবে। সোহম, বৃষ্টি বা সোমনাথ নয়, এ ছবিতে তাই শেষমেষ জিতে যায় ইতিহাস।

ছবির প্লটে মূল্যবান শিল্পকর্ম, পাপী বনেদি পরিবারের সদস্য, অসাধু অবাঙালি ব্যবসায়ী প্রভৃতি ভদ্রলোকীয় গোয়েন্দাকাহিনির একাধিক উপাদান থাকলেও পরিবর্তন এসেছে শেষাংশে। শার্লক হোমস বা ফেলুদার গল্পগুলির মতো বনেদি পরিবারের প্রতিনিধি এখানে তার কৃতকর্মের জন্য শুধুমাত্র মৌখিক দুঃখপ্রকাশ করেই পার পেয়ে যায় নি, ছবির শেষে তাকে রীতিমতো শাস্তিভোগের জন্য আইনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, কাহিনিতে এই অন্তিম শাস্তিবিধান ঘটেছে এক মহিলা চরিত্রের মাধ্যমে। অভিনয়ে দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য, শক্তিশালী চরিত্রের প্রতি সম্পূর্ণ সুবিচার করেছেন তিনি। নিয়মিত ওয়েব সিরিজে তাঁর ব্যোমকেশ করবার সুফল স্পষ্টভাবে দেখা গিয়েছে এই ছবিতে। কৌশিক সেন ও পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সুন্দর, গৌতম হালদারের অভিনয় পর্দায় বরাবরের মতোই ভীষণ চড়া লেগেছে। অনির্বাণের পাশে পাশে ঘুরে  বেড়ানো ছাড়া বেচারি পার্নোর বিশেষ কিছু করার ছিল না, তবে তনিমা ঘোষ ছোট্ট চরিত্রের মধ্যেই মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন। সুদীপ্ত মজুমদারের ক্যামেরার গুণে ঝকঝকে হয়ে উঠেছে বাংলার ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলি, ছবির টাইটেল কার্ডও সুন্দর। ভালো লেগেছে মিমো এস রায়ের সঙ্গীত, গানগুলির দৃশ্যায়নের সময় লক্ষ্য রাখা হয়েছে যাতে ছবির গতির সঙ্গে আপোষ না করতে হয়। আজ যখন হিন্দির আগ্রাসনে বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতি ক্রমশ বিপন্ন, হিন্দিভাষী সঞ্চালক বাঙালিকে ধমকে বলছেন রাভিন্দ্রানাথ ঠাকুর নেহি ট্যাগোর বোলিয়ে, তখন এ ধরনের ছবির তাৎপর্য আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।  


#বাংলা #সিনেমা #আলিনগরের গোলকধাঁধা

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

85

Unique Visitors

184486