চাষনালা, তরাইয়ের কান্না, আর অমলকান্তিকে সুরে বেঁধেছিলেন যিনি
শুরু হয়েছিল ধ্রুপদী সঙ্গীতের তালিম দিয়ে। কিন্তু দ্রুতই খুঁজে নিয়েছিলেন নিজের এলাকা। চারণকবি মুকুন্দ দাসের পর বাংলা গণসঙ্গীতকে ঠিক এই উন্মাদনার জায়গায় সম্ভবত হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছাড়া আর কেউ পৌঁছে দিতে পারেননি।
সময়টাকে কামড়ে ধরেছিলেন অজিত পাণ্ডে। বাঘ যেভাবে শিকার ধরে। ছাত্রকাল থেকে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে আমূল জড়িয়ে থাকা মানুষটির জীবনে শিল্প আর রাজনীতি কখনোই সংঘাতের রাস্তায় আসেনি। বরং একে অন্যকে উস্কানি দিয়ে গেছে। আর সেটাই ছিল স্রষ্টা হিসেবে তাঁর সবচেয়ে জোরের জায়গা।
১৯৩৭ সালে মুর্শিদাবাদের লালগোলায় জন্ম। সিপিয়েমের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে। কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট বহু রত্নের আঁতুড়ঘর। যদিও অনেকেই বেশিদিন গণনাট্য সংঘে থাকতে পারেননি। অজিতবাবু কিন্তু থেকে গেছিলেন। নিজে একাধিক মিউজিকাল যন্ত্র বাজাতে পারতেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্যের লেখায় সুরারোপ করেছেন। নিজেও লিখেছেন কখনও কখনও। চাষনালার কয়লা খনিতে জল ঢুকে অকালে মারা যাওয়া এক শ্রমিকের পত্নীকে নিয়ে লেখা গান ‘চাষনালার খনি’ (চাষনালার খনিতে মরদ আমার ডুবে গেল গো) বহুদিন পর্যন্ত চাষনালার শ্রমিকদের মুখে মুখে ফিরত। তরাই কান্দে গো, জ্বরে কাঁপছে আমার গা, একটা গল্প বলি শুনুন, ও নুরুলের মা, এমন একটা পৃথিবী চাই, মা আমার স্বদেশ আমার, সেই গ্রাম নগর যেখানে - এরকম আরও কত গান তৈরি করেছেন। নিজে দাপিয়ে গেয়ে বেরিয়েছেন ছোট বড় নানা মঞ্চে। দীনেশ দাসের ‘কাস্তে’, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’ বা শঙ্খ ঘোষের ‘ভিখিরি(আগে বলবেন গা রে খোকা)’-র মতো কবিতায় তিনি সুরারোপ করেছিলেন। মারতিন নিমোলোর নাৎসি- বিরোধী কবিতা থেকে তৈরি করেছিলেন ‘প্রথমে ওরা এলো’। চিলির বিখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী ভিক্টর জারাকে নিয়ে বেঁধেছিলেন ‘ভিক্টর জারা তোমার স্বপ্ন সত্যি হবে’।
সারাজীবনে প্রায় তিরিশটির মতো অ্যালবাম অজিতবাবু রেকর্ড করে গেছেন। প্রত্যেকটি সৃষ্টিই প্রান্তিক বা সংগ্রামী জীবনকে একেবারে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে। তিনি একজন প্রকৃত গণশিল্পী ছিলেন। রাশিয়া বাংলাদেশ ভিয়েতনাম থেকে আন্তর্জাতিক সম্মানপ্রাপ্ত অজিত পাণ্ডে অনুষ্ঠানের জন্য কোনওদিনই টাকা বা মঞ্চ বিচার করেননি। আর্থিক সমস্যায় থাকা ছোট ছোট ক্লাবগুলির জন্য তিনি ছিলেন ভগবানের মতো। নব্বইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাড়ায় পাড়ায় যে জলসা বা মোড়ে মোড়ে স্ট্রিট কর্নারের রেওয়াজ ছিল, সেখানে একটা স্লোগানই তৈরি হয়ে গিয়েছিল - ‘টাকা নেই ফান্ডে, আছেন অজিত পাণ্ডে।’ বউবাজার আসন থেকে নির্বাচন জিতে বিধায়কও হয়েছিলেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিধায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০১৩ সালে, ৭৫ বছর বয়সে তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।
আজও অনেকে অজিত পাণ্ডের গান মনে রেখেছেন। বেশ কিছু গান ইন্টারনেটে সহজলভ্য। তবে তাঁকে নিয়ে, তাঁর গান নিয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। রাজনীতিবোধকে বাদ দিয়ে তাঁর মতো শিল্পীর যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব হবে না। কারণ তাঁর গানের মেরুদণ্ডই হল প্রখর রাজনৈতিক সচেতনতা, নিপীড়িত মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ থেকে যার জন্ম।