হাসান আজিজুল হকের প্রথম উপন্যাস
বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের খ্যাতি মূলত গল্পকার হিসেবে। অবশ্য প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত। ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের জন্য আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্তি (২০০৮) তাঁকে বৃহত্তর পাঠকসমাজের কাছে পরিচিতি দিয়েছে। পরবর্তীকালে ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’(২০১৩) উপন্যাসটিও তাঁকে ঔপন্যাসিক হিসেবে সমান প্রতিষ্ঠা দেয়। গল্প রচনার পাশাপাশি তিনি উপন্যাস রচনার কথা ভেবেছেন নানাসময়ে। উপন্যাসিকা বা নভেলা লিখেছেন একাধিক। ১৯৬০-এ ‘বৃত্তায়ন’(১৯৯১) লিখেছিলেন রাজশাহীর পূর্বমেঘ পত্রিকার পরপর তিনটি সংখ্যায়। গত শতকের ষাট দশকের মধ্যবর্তী সময়ে লিখেছিলেন ‘শিউলি’, যা উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় অনেক পরে ২০০৬ সালে। 'বিধবাদের কথা' প্রথম প্রকাশিত হয় ঢাকার নিরন্তর পত্রিকায় ২০০৫ সালে। পরে এটি গ্রন্থভুক্ত হয় (২০০৭)। তবে প্রথম উপন্যাস ‘শামুক’ রচনা করেন ১৯৫৭ সালে, যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮ বছর। এই উপন্যাস লেখার একটি নেপথ্য কাহিনি আছে, যা এখানে বিবৃত করতে চাই।
১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বরে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পরে ‘উল্টোরথ’ পত্রিকার তরফ থেকে ‘মানিক স্মৃতি উপন্যাস’ প্রতিযোগিতার জন্যে নবীন লেখকদের কাছে উপন্যাস জমা দেওয়ার আবেদন জানানো হয়। হাসান আজিজুল হক তখন সেই ১৯৫৭ সালে একটি উপন্যাস লিখে ডাকযোগে পাঠিয়ে দেন, যার নাম ‘শামুক’। দপ্তরে জমা পড়া ৩০০ পাণ্ডুলিপি থেকে প্রথম দফায় ১০০টি রচনা বাছাই করা হয়। মনে রাখতে হবে, বিচারকমণ্ডলীতে তখনকার বিখ্যাত সব কথাসাহিত্যিকেরা ছিলেন। যা হোক ওই ১০০টা উপন্যাস থেকে প্রথম দফায় ২৮টা এবং পরে ৭টা বাছাই করা হয়। ওই সাতটা উপন্যাসের মধ্যে হাসান আজিজুল হকের লেখাটি ছিল। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি তখন তিনি আজিজুল হক। ওই নামে আরেকজন লেখক ছিলেন বলে ষাট দশকের গোড়ায় নামের আগে 'হাসান' শব্দটি বসান ।
আরও পড়ুন : ভূত দেখেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র! / বিবস্বান দত্ত
যথাসময়ে 'মানিক স্মৃতি পুরস্কার'-এর বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। প্রথম হন মতি নন্দী। তাঁর উপন্যাসের নাম ‘নক্ষত্রের রাত’, দ্বিতীয় হন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর উপন্যাসের নাম ছিল ‘সমুদ্র মানুষ’। তৃতীয় হন পূর্ণেন্দু পত্রী তাঁর ‘তিন নম্বর ছাগলছানার গল্প’-র জন্যে। চতুর্থ হয়েছিলেন হাসান আজিজুল হক। কিন্তু পুরস্কার না পেলে যা হয়, তাই হল; অর্থাৎ তাঁর নাম কেউ জানল না, অচিরেই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলেন তিনি।
১৯৬০ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত ‘শকুন’ গল্পের মধ্য দিয়ে হাসান আজিজুল হকের লেখক হিসেবে নতুন করে অভিযাত্রা শুরু হলে তিনি রাজশাহীর পূর্বমেঘ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে থাকেন। ওই পত্রিকার সম্পাদকদ্বয় মুস্তাফা নূর উল ইসলাম ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর প্রবল চাপের মুখে ওই ‘শামুক’ উপন্যাসটিকে পুনর্লিখন করে পত্রিকা দপ্তরে জমা দেন যা ওই পত্রিকার পরপর তিনটি সংখ্যায় ছাপা হয়। এরপরেই ওটা ক্রমশ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। অনেকদিন পরে লেখকের ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও উপন্যাস আকারে শামুক (২০১৫) প্রকাশিক হয়। উপন্যাস লেখার আটান্ন বছর পরে সেটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হচ্ছে। তথ্যটি অভিনব এবং কৌতূহলোদ্দীপক। বইয়ের ভূমিকায় অকপটে লেখক ওই লেখাটির জন্মকাহিনি বিবৃত করেন।
জ্যা-মুক্ত তিরের মতো একবার লিখে ফেললে তা আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। যত কাঁচাই হোক, হাসান আজিজুল হকও তাই এই লেখাগুলোর দায় অস্বীকার করেন না। তবে এগুলো তাঁর হয়ে ওঠার, হাত মকসো করার লেখামাত্র। এই লেখা গ্রন্থাকারে মুদ্রণের জন্যে তিনি কোনওরকম সংশোধনের কথা ভাবেননি। কারণ হিসেবে বলেছেন –
“আমি এই উপন্যাসটিকে কোনোরকম সংশোধনে যাইনি। বিস্তৃত করা, সংশোধন বা কাটাকাটি করার জন্য হাত লাগাইনি। কারণ তা করলেই আমি বর্তমানের মধ্যে ঢুকে পড়ব। যদি কাঁচা মনে হয় কাঁচাই মনে হোক, দরকচা মনে হয়, দরকচাই মনে হোক, জায়গায় জায়গায় কাঁচা, জায়গায় পাকা মনে হয় হোক, এই নিয়ে আমি ভাবি না। (শামুক গ্রন্থের ভূমিকা)
আরও পড়ুন : বিশ্বের একমাত্র হাতে লেখা দৈনিক সংবাদপত্র : ‘দ্য মুসলমান’ / টিম সিলি পয়েন্ট
১৯৫৭ সালে কোনওভাবে উল্টোরথ পত্রিকার 'মানিক স্মৃতি পুরস্কার'-এর যে কোনও একটি যদি হাসান আজিজুল হক পেতেন তাহলে হয়ত তাঁর লেখক জীবনের ইতিহাস একটু অন্যরকমভাবে লেখা হত। হয়ত তাঁর লেখক হিসেবে অভিষেক হত ঔপন্যাসিক হিসেবেই। কিন্তু যা হয়নি তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। বরং ইতিহাসের উপকরণ হিসেবে এইসব লেখাসমূহের এক উজ্জ্বল ভূমিকার কথা মনে রাখব আমরা।
.............
#সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #web portal #হাসান আজিজুল হক #শামুক #সুশীল সাহা #ফিচার