ফিচার

গোপালচন্দ্র প্রহরাজ

মন্দিরা চৌধুরী Dec 2, 2020 at 10:31 am ফিচার

ওড়িয়া সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অত্যুজ্জ্বলএকটি নাম গোপালচন্দ্র প্রহরাজ। তাঁর সারাজীবনের কার্যাবলি ছিল বহুধাবিস্তৃত। গোপালচন্দ্রের জন্ম ওড়িশার কটক জেলার সিদ্ধেশ্বরপুর গ্রামে। তিনি অভিজাত, ধর্মপরায়ণ ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন। এই পরিবেশের প্রভাব তাঁর বেড়ে ওঠায় থাকলেও তাঁর জীবনে চলার পথে তা কখনও অন্তরায় হয়নি।

গোপালচন্দ্রের শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের পাঠশালায়। উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন কটকের র‍্যাভেনশ কলেজে, এখান থেকে এন্ট্রান্স ও বি.এ. পরীক্ষা পাশ করেন। এরপর তিনি বি.এল. পাশ করে ওকালতি করতে শুরু করেন। উচ্চশিক্ষা চলাকালীন প্রাচীন ভারতীয় ধর্মীয় সাহিত্য ও উপকথা বিষয়ে তাঁর আগ্রহ জন্মায় এবং এই বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা তিনি করেন।


পেশায় গোপালচন্দ্র ছিলেন পুরী জেলার সরকারি অ্যাডভোকেট। ওকালতি পেশায় তাঁর যথেষ্ট পসার ছিলো। কিন্তু ১৯১৬ সালে মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি নির্দ্বিধায় সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন এবং সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। এরপর থেকে আমৃত্যু তিনি জাতীয় কংগ্রেসের সভ্য ছিলেন। কংগ্রেসের কার্যাবলির পাশাপাশি, দেশীয় রাজ্যগুলির সামন্তপ্রভুদের বিরুদ্ধে তাদের প্রজাদের যে আন্দোলন হয়েছিল, তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করলেও সর্বতোভাবে এই আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন গোপালচন্দ্র।


ওড়িয়া সাহিত্য এবং সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও গোপালচন্দ্রের অবদান নেহাত নগণ্য নয়। 'সত্য সমাচার' এবং 'প্রজাতন্ত্র' নামক দুটি পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করতেন। এছাড়া স্থানীয় কিছু দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকাতেও তিনি নিয়মিত লিখতেন। সাংবাদিকতার সমান্তরালে চলেছিল গোপালচন্দ্রের সাহিত্যিক জীবন। তাঁর বিচরণ ছিল কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে। গোপালচন্দ্রের লেখা গল্প, উপন্যাসগুলো ভীষণভাবে বাস্তবানুগ, বলা চলে মাটির কাছাকাছি। 'বাই মহান্তি পাঞ্জি', 'ননাঙ্ক বস্তানি', 'ভাগবত টুঙ্গিরে সন্ধ্যা' প্রভৃতি রচনায় তিনি সমাজজীবনের চিত্র নিখুঁত ও স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পের মাধ্যমে সামাজিক ত্রুটি বিচ্যুতির দিকে ব্যঙ্গাত্মক তির্যক অঙ্গুলিনির্দেশ তাঁর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। 'উৎকল কহানী', 'ওড়িয়া ঢগ ঢমানী' ইত্যাদি রচনাতেও তাঁর পরিহাসপ্রবণতার দৃষ্টান্ত দেখা যায়। গল্প-উপন্যাস রচনায় যথেষ্ট কৃতিত্বের ছাপ থাকলেও ওড়িয়া ভাষায় গোপালচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ কীর্তি 'পূর্ণচন্দ্র ভাষাকোষ'- সাত খণ্ডে রচিত চতুর্ভাষিক এই গ্রন্থ ওড়িয়া ভাষার প্রথম বিশ্বকো।  বিবিধ শব্দ গ্রহণ এবং শব্দভাণ্ডারের নিরিখে এই বিশ্বকোষের শ্রেষ্ঠত্ব সন্দেহাতীত, এর সমান মানের বিশ্বকোষ এখনও পর্যন্ত ওড়িয়া ভাষায় রচনা হয়নি। তাঁকে ওড়িয়া ভাষা তথা সাহিত্যের উৎস ও ইতিহাস সম্পর্কিত গবেষণার পথিকৃৎ বললে মোটেও অত্যুক্তি হয়না।  


নিরলস, কর্মোদ্যগী এই মানুষটির কাজের পরিধি শুধু স্বাধীনতা সংগ্রাম বা কলম পেষাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সমাজের অন্ধকার দিকগুলোতে আলো পৌঁছে দেবার যথাসাধ্য চেষ্টা তিনি করেছিলেন। নিজে বাহ্মণ হলেও তিনি অন্য ধর্ম সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ও উদার ছিলেন। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন এবং আপামর দেশবাসীর মধ্যে এই শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। গোপালচন্দ্র তথাকথিত উচ্চবর্ণের লোকেদের তীব্র রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদী ছিলেন। তিনি অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ প্রথারও বিরোধী ছিলেন। তাঁর বন্ধু এবং অনুগামীদের নিয়ে তিনি ওড়িশায় বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের পক্ষে প্রচার করেছিলেন। 


গোপালচন্দ্র প্রহরাজ তাঁর সারাজীবনের সুকৃতির স্বীকৃতিস্বরূপ বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছিলেন। অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয় 'সাহিত্য বিশারদ' ও 'সাহিত্যভূষণ' উপাধিতে সম্মানিত করে। এছাড়া তিনি 'কাইজার-ই-হিন্দ' ও 'রায়বাহাদুর' খেতাব পান। তিনি দীর্ঘকাল 'উৎকল ইউনিয়ন কনফারেন্স'-এর সদস্য ছিলেন


#উড়িষ্যা #গোপালচন্দ্র প্রহরাজ #কথাসাহিত্যিক

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

11

Unique Visitors

216311