আমাদের একটু সাহস ধার দেবেন, বিলকিস বানো?
আমাদের শুধু মোমবাতি হাতে নীরব থাকার দায় ছিল, বিলকিস।
ভুল বললাম, আপনার জন্য সে দায়ও আমরা পালন করিনি। আপনি একে মেয়ে, তায় মুসলিম। আপনি সবদিক থেকেই প্রান্তিক, সর্বতোভাবে অপর। সংখ্যাগুরু হওয়ার দৌলতে যে নিরাপত্তার খুদকুঁড়োটুকু আমাদের এখনও জুটছে, অন্তত জুটছে বলে আমরা ভাবছি সেই সিংহচর্মাবৃত রাসভটির মতো, আপনার জন্য নিজে হাতে সেই মায়াজাল কাটিয়ে বেরোই কেমন করে! আমাদের সাহস যে বড্ড কম, বিলকিস! আমাদের রোজকার ঘাম-জল-রক্তের জীবনে ভরে থাকে না-পাওয়ার গল্প। যা হওয়া উচিত, যা হওয়ার কথা ছিল, তা না পেয়ে মানিয়ে নেওয়ার কথকতা। পালটা লড়াই করতে গেলেও হেরে যাওয়ার নিয়তি। হারতে হারতে যখন আমরা প্রায় বিশ্বাস করেই বসি যে, আসলে সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই; সেই সময়েই আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় কোনও এক মধ্যবিত্ত সাংবাদিক ক্লার্ক কেন্ট, কিংবা হ্যারি পটার নামের এক মার-খাওয়া অনাথ কিশোর। সুপারম্যানের জোব্বা গায়ে চাপিয়ে নিয়ে, কিংবা হাতে একটা ম্যাজিক ওয়ান্ড নিয়ে যারা ন্যায়বিচার ছিনিয়ে আনে। ভালোর জয় দেখে আবার ভরসায় বুক বাঁধি আমরা, যদিও জানি, এ গল্প আসলে রূপকথার। কিন্তু কেবল রুপোলি পর্দাতেই নয়, বাস্তবেও কোনও কোনও মানুষ একরকম নাছোড় লড়াইয়ের গল্প লেখেন। সে গল্প সিনেমার চেয়ে কম নয়। বিলকিস বানো, সাম্প্রতিক সুপ্রিম রায়ের পর আপনাকে দেখে ঠিক সে কথাই মনে হচ্ছে, জানেন!
২০২২ সালের ১৫ আগস্ট। অমৃত মহোৎসবের পূর্তি উপলক্ষ্যে সেদিন সেজে উঠেছিল দেশ। লাল-হলুদ-সবুজের উজ্জ্বল বাঁধনি প্রিন্টের পাগড়ি মাথায় লাল কেল্লায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী সোচ্চারে ঘোষণা করছিলেন ‘নারীশক্তি’র জয়। ভারী আন্তরিক কণ্ঠে আশ্বাস দিচ্ছিলেন, যে আচরণ নারীর প্রতি অসম্মানের, যে সংস্কৃতি নারীর দিকে অপমান ছুড়ে দেয়, এমন কোনও কিছুর ঠাঁই নেই এই নতুন ভারতে। অথচ… এত ঔজ্জ্বল্য, এত চিৎকারের থেকে অনেকটা দূরে সেদিন বোবা হয়ে বসে ছিলেন আপনি। কারণ ঠিক সেদিনই, খুলে গিয়েছিল গোধরা জেলের দরজা। দরজার এপারে মালা, মিষ্টি নিয়ে বরণডালা সাজানো হয়েছিল। আর সেই আয়োজনের সামনে নিরুদ্বেগ পদক্ষেপে এসে দাঁড়াচ্ছিল একের পর এক লোক। দু-দশক আগে তাদের দলের কেউ কেউ যেভাবে ত্রিশূলে গেঁথে নিয়েছিল ভ্রূণ, ঠিক তেমনিভাবেই তারাও পুরুষাঙ্গে গেঁথে নিতে চেয়েছিল বেজাতের এক মেয়ের বেঁচে থাকার অধিকার। সেইসব সংস্কারী ধর্ষকদের জন্যই দু-দশক পরে বরণডালা সাজাচ্ছিল নতুন ভারত। আর তাদের খোলা বাতাসে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দিতে আপনার দম বন্ধ করে দিচ্ছিল আপনারই দেশ।
২০০২ সালের সেই গুজরাট তখন গোধরার পরের হিংসার আগুনে জ্বলছিল। আতঙ্কে তিন বছরের শিশুকন্যা আর জনা পনেরো আত্মীয়ের সঙ্গে গ্রাম ছেড়েছিলেন আপনি, ২১ বছরের অন্তঃসত্ত্বা তরুণী এক। তারপরেও শেষরক্ষা হয়নি। পালাতে পালাতে যে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল তাড়া-খাওয়া মানুষগুলো, পশুর মতো গুটিসুটি মেরে নিজেদের ঢেকে নিতে চাইছিল সমস্ত চোখের আড়ালে, সেখানেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল তারা। তবে বেজাত হলে কী হবে, মেয়েরা তো মেয়েই। তাই আপনি, আপনার বোন, আপনার মা… কেউ রেহাই পাননি। ঠিক কতজন আপনাদের শরীর খুবলে নিয়েছিল, আজও কি সে হিসেব করতে পেরেছেন বিলকিস বানো? কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তকারীরা পরে জানিয়েছিলেন, আপনার আত্মীয়দের এমনভাবে খুন করা হয়েছিল যে, সবাইকে শনাক্ত পর্যন্ত করা যায়নি। কিন্তু হামলাকারীদের শনাক্ত করতে আপনি একটুও ভুল করেননি, বিলকিস। যেখানে সিবিআই বলছে ময়নাতদন্তের রিপোর্টে গোটা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, যেখানে পুলিশ বয়ান নিতে অস্বীকার করেছে, চিকিৎসক মেডিক্যাল টেস্টে নারাজ, যেখানে বারে বারে খুনের হুমকি এসেছে, যেখানে মহিলা উপরন্তু সংখ্যালঘু হিসেবে লড়াইটা এমনিতেই কঠিন ছিল… সেখানে একা দাঁড়িয়ে থাকার সাহস আপনি কীভাবে পেয়েছিলেন, বিলকিস বানো?
আপনার ২২ বছর জুড়ে চলা এই লড়াইয়ের মধ্যে এ দেশ কামদুনি দেখে ফেলেছে। দেখে ফেলেছে উন্নাও। দেখেছে হাথরাসও। তারপরেও বিলকিস বানো, আপনি একক, আপনি আলাদা। ধর্ষণ কাণ্ডে শাসকের বয়ান বদলায়, সামাজিক কণ্ঠরোধের প্রয়াস চলে সর্বত্রই, কিন্তু আপনার বেলায় যে খোদ শীর্ষ আদালতের গতিপ্রকৃতিও বোঝা ভার! দীর্ঘ আইনি পথ পেরিয়ে সেই ১২ জন ধর্ষকের কারাদণ্ডটুকু নিশ্চিত করা গিয়েছিল বটে। কিন্তু দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছরের উদযাপনে, তার মধ্যে জীবিত ১১ জনই বেকসুর খালাস পেয়ে যায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। ২০০২ সালে যে বিলকিস চোখের সামনে বাড়ির ১৪ জনকে নৃশংস ভাবে খুন হতে দেখেছিলেন, দেখেছিলেন তিন বছরের মেয়েকে পাথরের উপরে আছড়ে পড়ে মরে যেতে, আর তারপর পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা তরুণী মা বারবার, বারবার ধর্ষিতা হয়ে চলেছিলেন... সেদিনের রক্তের মধ্যে পড়ে থাকা সেই বিলকিস বানোকে গরল ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না আজকের অমৃত মহোৎসবও।
গোটা পরিবার, সমস্ত আত্মীয়স্বজনকে হারিয়ে লড়াইয়ের শুরুতে বিলকিস যতটা বিপন্ন ছিলেন, অপরাধীদের সাজা মকুব করে কুড়ি বছর পরেও তাঁকে একই বিপন্নতায় ফিরিয়ে দিয়েছিল তাঁরই দেশ। তাঁরই দেশ কি? যে দেশে ধর্ম দেখে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়, সে দেশকে নিজের বলার অধিকার কতটুকু— জানেন না বিলকিস বানো। তার পরেও, ফের সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানিয়েছেন আপনি। ফের আইনের দোরে দোরে মাথা ঠুকেছেন। আপনার জন্য মোমবাতি মিছিল হয়নি। আপনার জন্য সারা দেশে আওয়াজও ওঠেনি সেভাবে। তারপরেও, আপনি দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছেন। খোলা বাতাসে শ্বাস নেওয়ার জন্য লড়েছেন। হ্যাঁ, আমরা পারিনি, তবে আপনাকে সেই বাতাসটুকু জুগিয়ে দেওয়ার জন্য পাশে থেকেছেন হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ। দু-দশক ব্যাপী লড়াইয়ে নিম্ন আদালত থেকে হাই কোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট, গুজরাটের সেই গ্রামের মেয়েটির জন্য আইনের দরজায় ছুটে বেরিয়েছেন আইনজীবী শোভা গুপ্তা। ধর্ষকদের মুক্তির পর বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দায়ের করেছেন আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগালের কন্যা, ৭৬ বছরের বাম নেত্রী সুভাষিণী আলি। তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন গুজরাট হিংসা নিয়ে লেখা ‘দ্য অ্যানাটমি অফ হেট’ বইয়ের লেখক, সাংবাদিক রেবতী লাল; আর লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, হাথরাস মামলায় সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের জামিন হতে চাওয়া ৮০ বছর বয়সি অধ্যাপক রূপরেখা ভার্মা। শেষ পর্যন্ত গুজরাটের ভোট, আর আরও পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোট পেরিয়ে ঢোক গিলেছে সুপ্রিম কোর্ট। ধর্ষকদের ফের জেলে ফেরার নির্দেশটুকু মহামান্য শীর্ষ আদালতের মুখ থেকে আদায় করে নিয়েছেন আপনি, আপনারা।
বিলকিস, আপনার এইটুকু পাওয়া আমাদের সব না-পাওয়াকে ফের একটুখানি স্বপ্ন দেখতে বলে, জানেন? আপনার লড়াই আপনার একার ছিল, কিন্তু আপনার জয় তো আপনার একার নয়। আপনার এই জিতে যাওয়া একটা গোটা দেশের ন্যায় ও ন্যায্যতার প্রতি আস্থা ফিরে আসার আখ্যান। আপনি কি জানেন, আপনার মতো সংখ্যালঘু সাধারণ মেয়ে না হয়েও, খ্যাতনামা পদকজয়ী তারকা হয়েও নিগ্রহের সামনে একইরকম অসহায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এ দেশের একাধিক মহিলা কুস্তিগির? আপনার মতোই, তাঁদের ন্যায়বিচার মেলার আশাটুকুও রোজ মরে যাচ্ছে। আপনার এই সাম্প্রতিক জয়ের রেশ সর্বাঙ্গে মেখে নিয়ে তাঁদেরই একজন, বিনেশ ফোগত একটা ছোট্ট খোলা চিঠি লিখেছেন আপনাকে। বলেছেন, “আপনি একটা লম্বা যুদ্ধ লড়েছেন বিলকিস। আপনার সে পথের দিকে তাকিয়ে সাহস কুড়িয়ে নিই আমরাও।”
আসলে ধর্ম নয়, প্রতিবাদ আপনাকে সংখ্যালঘু করেছে, বিলকিস বানো। আজকের দিনে প্রতিবাদী স্বরই আসলে সংখ্যালঘু প্রজাতি। আমাদের এই লিলিপুট জীবনে আরও একটু সাহস কুড়িয়ে নিতে শেখাবেন, বিলকিস বানো?