জিনিয়াস এক গণিতজ্ঞ এবং...
ছেলেটি কলেজের পড়া শেষ করতে পারেনি। গণিত ছাড়া অন্য সব বিষয়েই ফেল করেছে সে। তার শুধু ভালো লাগে খাতায় সংখ্যা আর অক্ষর সাজিয়ে গণিতের নতুন নতুন নিয়ম খুঁজে পেতে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা তার জন্য বন্ধই। বাড়িতে আবার অর্থের টানাটানি। বাবা এক বস্ত্রব্যবসায়ীর কাছে কাজ করে যেটুকু আয় করেন, তাতে সংসার চলে না। অগত্যা সে চেষ্টা করে চাকরির৷ যে কোনও চাকরি।
অবশেষে চাকরি সে পেল, কিঞ্চিৎ ধরাধরির পর। মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টে ক্লার্কের চাকরি। চাকরির দরখাস্তের সঙ্গে সে জুড়ে দিয়েছিল মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিতের এক সাহেব অধ্যাপকের সুপারিশ, যাতে লেখা, 'I can strongly recommend the applicant. He is a young man of quite exceptional capacity in mathematics and especially in work relating to numbers. He has a natural aptitude for computation and is very quick at figure work.' এই লেখাটাই হয়ত তার চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে মূল অনুঘটকের কাজ করেছিল।
সত্যিই গণিতে ব্যতিক্রমী প্রতিভার অধিকারী হিসেবেই নিজেকে তৈরি করেছিলেন দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর আয়েঙ্গার ব্রাহ্মণ পরিবারের সেই ছেলেটি, যিনি মাত্র তিরিশ বছর বয়েসে ব্রিটেনের সেরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান রয়্যাল সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করবেন শুধু এই অনন্য প্রতিভার জোরেই।
প্রতিভা, নাকি পরিশ্রমের দ্বারা অর্জিত ক্ষমতা? কীসের জোরে শ্রীনিবাস রামানুজন অর্জন করেছিলেন অসাধারণ গাণিতিক দক্ষতা? প্রথাগত পড়াশুনো ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় দিকপাল সব গণিতজ্ঞকে মুগ্ধ করবার মতো তত্ত্ব, উপপাদ্য বা নিয়ম আবিষ্কার করে যিনি চমকে দিয়েছিলেন, তিনি কি born-genius নন?
সঙ্গে ভাগ্যও অনেকটাই সঙ্গত করেছে তাঁর জীবনধারাকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে। বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ জি. এইচ. হার্ডির নজরে না পড়লে তাঁর হয়ত দেশের বাইরে পা রাখাই হত না। পোর্ট ট্রাস্টের চাকরিটাও তাঁর জীবনে আশীর্বাদের মতো, কারণ এই চাকরির সুবাদেই তাঁর পরিচিতি বাড়ে, আর হার্ডির কাছে পৌঁছে যায় তাঁর বিরল মেধার স্বাক্ষর কিছু গাণিতিক পেপার। যা পড়ে হার্ডি হতভম্ব, আর হার্ডির উদ্যোগেই তাঁর ইউরোপ যাত্রা, বিশ্বযুদ্ধ শুরুর মাস কয়েক আগে।
আর তারপরেই কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে পড়ার সুযোগ পাওয়া। এই কলেজ থেকে তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে ফেলো হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ১৯১৮ সালে লন্ডন ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেন এবং পরের বছর দেশে ফিরে আসেন।
রুগ্ন স্বাস্থ্য এবং স্বল্প-আয়ু-- এই দুই প্রতিবন্ধকতাই রামানুজনের পৃথিবীতে বেশি দিন কাটাবার পথে অন্তরায় হয়েছে, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গণিতের সাম্রাজ্য। এক ট্র্যাজিক নায়ক হিসেবে তিনি গণ্য হন আজ। যে বিদেশযাত্রা তাঁকে বহির্বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তোলে, সেই বিদেশবাসই তাঁর অসুস্থ হওয়ার কারণ; দেশে ফেরার মাস কয়েক পরেই দেহত্যাগ করেন তেত্রিশ বছরের রামানুজন (এই নিবন্ধলেখক রামানুজনের চেয়ে ঠিক একশো বছরের ছোট এবং এখন তাঁর বয়স তেত্রিশ!)।
রামানুজনের শ্রেষ্ঠ জীবনীটি লিখেছেন আমেরিকান বিজ্ঞান-লেখক রবার্ট ক্যানিগেল, বইটির নাম ‘দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি’। ২০১৫ সালে এই নামেই একটি চলচ্চিত্রও তৈরি হয় বইটির উপর ভিত্তি করে।
আমরা ভারতীয়রা মনীষীদের স্মৃতিরক্ষার অবহেলায় এতটাই পারদর্শী যে রামানুজনের মতো একজন মহাপুরুষের জন্মস্থান খুঁজে বের করতে অপেক্ষা করতে হয় একশো বছর! সাহেবদের দেশে তিন-চারশো বছর আগেকার কবি-সাহিত্যিকদের বাড়িকেও যথাযোগ্য সংরক্ষণ করে মিউজিয়াম বা দ্রষ্টব্যস্থান হিসেবে গড়ে রাখার নজির যথেষ্ট, আর আমাদের এখানে একশো বছর আগেও হেঁটেচলে বেড়াতেন এমন বিজ্ঞানীর বাড়িও খুঁজে পাওয়া দায় হয়ে পড়ে। চেন্নাই শহর থেকে পাঁচশো কিলোমিটার দূরে রামানুজনের মামাবাড়ি, যেখানে তাঁর জন্ম, সেই বাড়িটি সম্প্রতি উদ্ধার করে স্মৃতিরক্ষার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আর এই কাজে যিনি এগিয়ে এসেছিলেন, তিনি কোনও ভারতীয় নন, জাপানের টোকিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক সুসুমু সাকুরাই।
অবশ্য রামানুজনকে আমরা একেবারে ভুলে গিয়েছি বলা চলে না, কারণ ২০১২ সাল থেকে তাঁর জন্মদিন ২২শে ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে গণিত দিবস হিসেবে। আর এই উপলক্ষ্যে গত কয়েক বছর ধরেই এই সময় সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এই বছরে অতিমারির আবহে সেই অনুষ্ঠান হবে ভার্চুয়াল মাধ্যমে। ২২শে ডিসেম্বর থেকে টানা চারদিন কেন্দ্রীয় সরকারের কয়েকটি দপ্তরের উদ্যোগে চলবে India International Science Festival (IISF)। এই বছর এই অনুষ্ঠানের থিম হিসেবে থাকছে Science for self-reliant India and Global Welfare।
জিনিয়াস খুব বেশ জন্মান না, স্বল্পায়ু হলেও তাঁরা যা রেখে যান, মুগ্ধ বিস্ময়ে লক্ষ করতে হয়, তা দীর্ঘজীবী কৃতীদের প্রদত্ত সম্পদের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়। রামানুজন স্বল্পায়ু প্রতিভাবানদের মধ্যে অগ্রগণ্য, বাংলায় তাঁকে নিয়ে আরও বিস্তারিতভাবে লেখার প্রচলন শুরু হওয়া উচিত।