ফিচার

গগন ঠাকুরকে বেতারযন্ত্র বানিয়ে উপহার দিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু

শৌভিক মুখোপাধ্যায় Sep 17, 2021 at 11:14 am ফিচার

কলকাতায় বিদ্যুৎ এলো। ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হলেও ক্রেতার দেখা মেলা ভার। ইলেকট্রিক নিয়ে সবারই মনে তখন সন্দ, খট করে একটা বোতাম টিপলেই রাতবিরেতেও দিনের মতো আলো! কি অশৈলী কাণ্ড। এমনটা কেউ আগে দেখেছে না শুনেছে! কর্তাদের মাথায় হাত। ক্রেতাই যদি না থাকে তবে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হয়। গুজব উড়িয়ে কয়েকটি বাঙালি পরিবার এগিয়ে এলেন। জোড়াসাঁকোর ছয় নম্বর বাড়ি তার মধ্যে অন্যতম। বাড়ির বড় ছেলে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে দাঁড়িয়ে সব ব্যবস্থা করলেন। ক’দিনের মধ্যেই তাদের ঘরে এলো বিজলীবাতি। শোনা যায় ঠাকুরবাড়িতে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেওয়ার পর আরও অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন। প্রথম দফায় ইলেকট্রিক কানেকশন নেওয়ার জন্যে কোম্পানির কাছে কোনো টাকা তাদের জমাও রাখতে হয়নি।

নতুন কিছুর প্রতি গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৌতূহল সবসময়েই থাকত। যেখানেই যা নতুন কিছু দেখতে পেতেন তা তাঁর জোগাড় করা চাইই চাই। ফোনোগ্রাফ তখন সবে বাজারে এসেছে। ঠাকুরবাড়িতেও এলো। এভাবেই একে একে গ্রামোফোন, টেলিস্কোপ, দূরবীন সব হাজির হয়েছিল। তবে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর সবচেয়ে মজা পেয়েছিলেন একটি ছোট বেতার যন্ত্র পেয়ে। জগদীশচন্দ্র বসু তখন সবেমাত্র বেতার তরঙ্গ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেছেন। গগন ঠাকুর জানতে পেরে খোদ আবিষ্কর্তার কাছেই দরবার করলেন, তাঁকেও অমন একটি যন্ত্র বানিয়ে দিতে হবে। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে বসুবাড়ির সুসম্পর্ক সুবিদিত। একটি ছোট যন্ত্র বানিয়ে দিলেন জগদীশ বসু। এই ঘর থেকে বেতার যন্ত্র চালু করলেন গগন ঠাকুর, পাশের ঘরে ঘন্টা বেজে উঠল। এই ঘটনায় শিশুর মতো খুশি হয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। একাধিক স্মৃতিচারণে সে সাক্ষ্য পাওয়া যায়। সময় পেলেই বেতারযন্ত্রটি নিয়ে মেতে থাকতেন।

তাঁর কাছে বাড়ির ছোটদের ছিল অবাধ যাতায়াত। নতুন যন্ত্রের পাশাপাশি নতুন খেলনা সংগ্রহেরও শখ ছিল। নিউ মার্কেট থেকে ফেরত এলেই তার চারপাশে ভিড় করত বাড়ির ছোটোরা। তবে সবসময় এ অভিজ্ঞতা সুখের ছিল না। একবার যেমন মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় দেখলেন, ছবি আঁকতে আঁকতে বড়দাদামশাই কাঠকয়লার টুকরো মুখে পুরে চিবোচ্ছেন। তিন দাদুর খেয়ালী স্বভাবের কথা জানতেন মোহনলাল। বিশেষ করে বড়দাদু আর ছোটদাদুর তো আঁকতে বসলে কোনোদিকেই খেয়াল থাকে না। আজ হয়ত মনের ভুলেই ছবি আঁকার সরঞ্জাম থেকে কাঠকয়লার টুকরো তুলে নিয়েছেন। দূর থেকেই ভুল শুধরোবার চেষ্টা করলেন তিনি। জিজ্ঞাসা করলেন, দাদু কী ভুল করেই কাঠকয়লা চিবুচ্ছেন? উত্তর পেলেন, এ আসলে একরকমের বিস্কুট। এবং তার সঙ্গেই চেখে দেখার ডাক। মুহূর্তেই বাকি ছোটরা উধাও। অগত্যা মোহনলাল একাই চেখে দেখলেন। ‘খেতে এমন কিছু ভালো নয়, মিষ্টি কম, কিন্তু জিনিসটা খাদ্যবস্তু। … মার্কেটে গিয়েছিলেন, দেখেছেন একটা নতুন রকমের খাবার জিনিস এসেছে—কাঠকয়লার বিস্কুট—কিনে এনেছেন। চিবিয়ে চিবিয়ে চেখে চেখে দেখছেন।’

একবার মার্কেট থেকে গগনেন্দ্রনাথ একটা রঙ দেখবার যন্ত্র কিনে আনলেন।‘সেটি ছোট মাইক্রোস্কোপের মতো একটা যন্ত্র। মুখের দিকে চোঙ লাগিয়ে অন্য দিকে টুকরো কাঁচ বা স্বচ্ছ পাথর রাখলে নানারকম রঙ দেখা যায়। ভাঙা কাঁচ, পাথর অনেক কিছু জোগাড় হল। আমরা সবাই চোখ দিয়ে দেখলুম। সবুজ, বেগুনী, হলদে, নীল, লাল নানা রঙ ঐ ভাঙা টুকরোগুলো থেকে দিকে-বিদিকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। যেন একটা রঙের ফোয়ারা।… ঐ নিয়ে বসে থাকতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নানা রকম রঙের খেলা দেখতেন আর থেকে থেকে আমাদের ডেকে দেখাতেন। লোকে থিয়েটার দেখে, বায়োস্কোপ দেখে, নাচ দেখে, একজিবিশনে গিয়ে ছবি দেখে, পাথরে-কাটা মূর্তি দেখে, বড়দাদা রঙ দেখতেন।… অনেকেই জানেননা এই হচ্ছে বড়দাদামশায়ের কিউবিজ্ম্ ছবি আঁকার প্রথম ইতিহাস। এই যন্ত্রের ভিতর দিয়ে রঙ আর রেখার কাটাকুটি দেখতে দেখতে বড়দাদা কিউবিজ্ম্-এর ছবির প্রেরণা জাগে।’ ‘দক্ষিণের বারান্দা’-র পাতায় পাতায় মোহনলালের স্মৃতি এখনও জীবন্ত হয়ে আছে। যদিও ক্যালাইডোস্কোপ ধাঁচের এই যন্ত্রকেই শুধুমাত্র ছবি আঁকায় অন্য ঘরানা আবির্ভাবের মুখ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করলে ভুল হবে। গগন ঠাকুরের কাছের বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শিল্পসমালোচক ও শিল্পরসিক যামিনীকান্ত সেন। তাঁর পরামর্শে পাশ্চাত্য আর্ট সম্বন্ধীয় বিস্তর বই কিনে পড়াশোনা করেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। তবু এই নতুন যন্ত্রের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। তাঁর আঁকা ‘দুই আলোকপরীর নৃত্য’ দেখে যারা তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন তাদের মনে হয়েছিল, তা ঠিক যেন ঐ ‘কাঁচের পরকলার’ মধ্যে দিয়ে দেখা রঙের খেলা।

পোশাক নিয়েও শুরু হলো এক্সপেরিমেন্ট। পিরালি পাগড়ি আর লম্বা কোট একদমই পছন্দের নয় এদিকে বাইরে বেরোতে হলে সেগুলোই চাপাতে হয়। মাঝে জুরিবোর্ডের সদস্যপদের দায়িত্ব সামলেছেন। তখনও সঙ্গী সেই পাগড়ি-কোটের অস্বস্তি। দর্জির ডাক পড়ল ছয় নম্বর বাড়িতে। জোড়াসাঁকোয় যখন জাপানি শিল্পীরা কিছুদিনের জন্যে এসেছিলেন, তাদের দেশীয় পোশাক দেখেই প্রথম আইডিয়া দানা বাঁধে। তার সঙ্গে তাল দিলো কাশ্মীরিদের হাফ জোব্বা। এই দুয়ে মিলে তৈরি হলো ঠাকুরবাড়ির জোব্বা। আর পাগড়ির বদলে বিশেষ নকশার ভেলভেটের টুপি। রবিকাকা এসব দেখে তো খুব খুশি। ভীষণ পছন্দ হলো। দর্জি ফতেউল্লাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল তাঁর কাছে। পরে ঠাকুরবাড়ির অনেকেই এই পোশাক নকল করেছেন। আরও অনেক দিন পরে দার্জিলিংয়ে গিয়ে তিব্বতি বকু দেখে, এই বকু পরার অভ্যেস করছিলেন। 

এই পোশাক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে বড় মেয়ের বিয়েতে পাত্রপক্ষকে চমকে দিয়েছিলেন। মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে সেলাই করা বস্ত্র পরা যায় না। তাই আগে বিবাহনুষ্ঠানে পাত্রীর ব্লাউজ পরার চল ছিল না। ছয় নম্বর ঠাকুরবাড়িতেও এর আগে অন্যথা হয়নি। এদিকে বিয়ের আসরে মেয়েকে চেলি-শাড়ি-ব্লাউজ পরে উপস্থিত হতে দেখে প্রাজ্ঞেরা অবাক হলেন। কন্যাপক্ষের কাছে এই অনিয়মের কারণ জানতে চাওয়া হলো। এদিকে কন্যাপক্ষর তরফে বলা হল, যা কিছু সব নিয়ম মেনেই করা হয়েছে। সেলাই করা কোনো বস্ত্রই ব্যবহার করা হয়নি। পাত্রপক্ষ হতভম্ব। চোখের সামনে দেখছেন , অথচ কন্যাপক্ষেরা বলছে তা ঠিক নয়। পরে জানা গেলো, আঠা দিয়ে জুড়ে পোশাক  তৈরি করা হয়েছিল। আর এই পরিকল্পনা এসেছিল গগন ঠাকুরের মাথাতেই। এমন বেয়াই ঠকানো দেখে সবাই খুব মজা পেয়েছিলেন। 

এমনই ছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আপাদমস্তক সংসারী মানুষ, অথচ তার মধ্যেও সাধনাটি অক্ষুণ্ণ। একটুও ফাঁকি পড়েনি। কখনও কেউ তাঁকে রাগতে দেখেনি। সকল বিষয়ে  আগলে রাখতেন সবাইকে। অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের দায়িত্ব যখন কাঁধে এসে পড়ল সেই থেকেই গগন ঠাকুর আর ছয় নম্বর বাড়ি সমার্থক। বিলেত যাওয়ার সুযোগ এসেছিল কৈশোরে। যাওয়া হয়নি। পরবর্তী জীবনে হাতে গোনা কয়েক জায়গার বাইরে আর বেড়াতে যাননি। প্রতিবছর বৈশাখে বাড়ি মেরামতের জন্যে অন্য কোথাও কয়েকদিন কাটিয়ে আসতেন। সে কলকাতা বা কলকাতার হাতার মধ্যেই। কখনও হওয়া বদলে গেলে পরিবারশুদ্ধু সবাইকে নিয়ে যেতেন। পরিবারকে বাদ দিয়ে কোনো কিছু ভাবতে পারতেন না। এর বাইরে সফরের চিন্তা? নৈব নৈব চ। পরবর্তীকালে ছয় নম্বর বাড়ি বাঁচাবার শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ হওয়ার পর যখন বাড়ি ছেড়ে একে একে চলে যাচ্ছেন সমর অবন, তাঁরা এটুকু শান্তি নিয়ে যাচ্ছেন , এই আঘাত বড়দাদাকে পেতে হয়নি। দীর্ঘদিন পক্ষ্মাঘাতজনিত অসুস্থতার শেষে গগনেন্দ্রনাথ তখন অন্য লোকে পাড়ি দিয়েছেন। একবার রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শিলাইদহে আসার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়ে পত্রে লিখেছিলেন, “জোড়াসাঁকোর গলির মুখ থেকে প্রথমটা বেরোবার যে—দুঃখ সেইটুকু কোনোমতে কাটাতে পারলে এখানে এসে খুব আনন্দ পাবে সন্দেহ নেই।” এ জীবনে তাঁকে সেই দুঃখ পেতে হয়নি।

গ্রন্থঋণ-১. দক্ষিণের বারান্দা - মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় 
          ২. ঠাকুরবাড়ির গগনঠাকুর - পূর্ণিমা দেবী
          ৩. গগনেন্দ্রনাথ - মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়

কৃতজ্ঞতাসৌমেন্দ্র পর্বত
              বিদিশা বিশ্বাস
#গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর #ফিচার #ওয়েব জিন #পোর্টাল # জোড়াসাঁকো #শৌভিক মুখোপাধ্যায়

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

61

Unique Visitors

215846