মজার ক্রিকেট, ক্রিকেটের মজা
বাংলায় লেখা প্রথম ক্রিকেটের বই খুঁজতে গেলে আপনাকে অনেক পিছনে যেতে হবে। সেই চারের দশকে যখন দেশ পরাধীন হয়ে প্রভুদের বিরুদ্ধে সবে গোটাকয়েক টেস্ট খেলেছে। লেখক 'যাযাবর', যাঁর আসল নাম বিনয় মুখোপাধ্যায়, দুটি ছোট ছোট বই লিখেছিলেন। এদের মধ্যে একটির নাম 'মজার খেলা ক্রিকেট', যার মত সুপ্রযুক্ত নামকরণ কমই দেখা গিয়েছে। ক্রিকেট দর্শককে যে অফুরন্ত মজার জোগান দেয় তেমনটা অন্য খেলা বোধহয় পারে না! কারণ একটাই। খেলাটা যখন যে দেশকে আঁকড়ে ধরেছে তার সমাজ, সংস্কৃতি, মানুষ সবকিছুকে এমনভাবে মজিয়েছে যে দিনযাপনের প্রতিটি অংশে ঢুকে গিয়েছে।
মজাই বলি আর বীরত্বই বলি, দাড়িওয়ালা ডাক্তারকে বাদ দেবার উপায় নেই। হ্যাঁ ক্রিকেটের জনক ডব্লু.জি. গ্রেস। একটি দ্রুতগতির বল এসে বেলটিকে সরিয়ে দিয়ে চলে গেল। নির্বিকার গ্রেস বেলটি তুলে রাখলেন, স্মিত হেসে তাকালেন আর বোলারকে বললেন- "খুব হাওয়া, না?"
গ্রেসের এই চালিয়াতি হজম করেননি জাঁদরেল বোলার চার্লস কর্টরাইট। গ্রেসকে একটা কাউন্টি ম্যাচে সোজা বোল্ড করলেন তারপর মন্তব্য- "ডাক্তার, চললেন কোথায়? ঐ দেখুন একটা এখনো দাঁড়িয়ে!"
গ্রেস নাহয় লোককথার অঙ্গ হয়ে গিয়েছেন, তার চরিত্রটাই এত বড় মাপের যে এসব দুষ্টুমি মানানসই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গড়পড়তারা এমন করলে? ১৯৫৫ সালে ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে একটা রান নিতে গিয়ে আউট হলেন অ্যালফ্রেড ভ্যালেনটাইন, শেফার্ডের থ্রোয়ে। সহখেলোয়াড় রসিকতা করে বললেন "অ্যালফ ছিঃ! তুমি জানো না টেন কম্যান্ডমেন্ট এ আছে, কখনো চুরি করিবে না!" শেফার্ডের মন্তব্য যাক, অন্তত একটা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান টেন কম্যান্ডমেন্টটা জানে। মনে রাখতে হবে তখন ইংল্যাণ্ড রমরম করছে চূড়ান্ত জাতিবিদ্বেষ, জর্জ ফ্লয়েড রুটিন ঘটনা তখন। অন্যরকম মানে হতেই পারত একথার। মজাড়ু ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা অবশ্য পাত্তাই দেননি।
অস্ট্রেলিয়ানরা অবশ্য একটু কাঠখোট্টা, গোমড়ামুখো, কেবল জিততেই মাঠে নামে। তবুও কী মজা না হলে ক্রিকেট এর নেশা চড়ে? ইমরান খান আর অ্যালান বর্ডারের ঝামেলা! কেন? ইমরান বলেছিলেন শুধু গাভাসকার আর চন্দ্রশেখরকে চাই, অস্ট্রেলিয়াকে বলে বলে হারাবো। স্মিত হেসে বর্ডার, "দুটো পাকিস্তানি আম্পায়ার চাই। গোটা বিশ্ব ইনিংসে হারবে আমাদের কাছে"!
স্বভাবতই ইমরান ভয়ানক চটে যান। তবে যুক্তিতে ভুল নেই। পাকিস্তানের মাটিতে খেলা হলে আম্পায়াররা যা করতেন পাড়ার চোট্টা ছেলেও লজ্জা পাবে। একজন শুধু আউট না দিয়ে থামেননি সোজা তেড়ে গেছিলেন ইংল্যাণ্ড অধিনায়ক মাইক গ্যাটিং এর দিকে। তিনি শাকুর রানা। চোট্টামিতে তিনি আর সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ একই লেভেল! এর সুযোগ্য উত্তরসূরী স্টিভ বাকনার। ক্যাপ্টেনস ওপিনিয়নে সৌরভ এনাকে একটি বৃহৎ গোল্লা দিয়েছিলেন।
বাকনার জাতে ক্যারিবিয়ান। ওদেশে একবার অসাধারণ কাজির বিচার পেয়েছিল বিষেণ সিং বেদির ভারত। ১৯৭৬ সাল। হোল্ডিং-রবার্টস একটা ওয়ানডে ম্যাচে বাউন্সারের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। স্কোর মোটে এগোচ্ছে না। বেদি আম্পায়ারের কাছে অভিযোগ জানাতে তাঁর উত্তর "দূর মশাই, আমি কী করব! রান না হলে এই বেঁটে বিশ্বনাথকে সরিয়ে লম্বা ব্যাটসম্যান পাঠান।" বেদি চটে লাল হয়ে ওয়াকওভার দিয়ে দিলেন।
নজরে থাকুক
চের্নোবিল থেকে প্যারা অলিম্পিক্স : ওকসানা মাস্টার্সের আশ্চর্য গল্প
হাসি মজার অ্যানেকডোটগুলো ক্রিকেটের শুক্তোয় ফোড়নের মত। এসবের লক্ষ্য যিনি হবেন তাঁর কিঞ্চিৎ প্যাঁচে পড়া ব্যাপার হবে, বাকিরা নির্ভেজাল মজা নেবে।আর রসিকতা, ব্যঙ্গ, কটুক্তি থেকে বিশ্রী ব্যক্তিগত আক্রমণের কাহিনিরও অভাব নেই। সাতের দশকে ইয়ান চ্যাপেল এর আমদানি করেন, তাঁর দলের নাম হয় "আগলি অস্ট্রেলিয়ানস"। স্লেজিং নামক শিল্পের তিনিই জুকারবার্গ। আর বিষাক্ত টিপ্পুনি আর অপমানজনক মন্তব্যের ব্যাসদেব হলেন টনি গ্রেগ। ব্রায়ান লারা ১৯৯৩-তে সিডনিতে অসাধারণ ২৭৭ করলেন, দেশে ফিরে মেয়ের নাম রাখলেন সিডনি। টনি গ্রেগ বলেছিলেন- "Thank God, Lara didnt make the hundred in Lahore!"
লারা এর প্রতিক্রিয়ায় কিছু বলেছেন বলে জানা যায়নি। তবে স্যার ভিভ রিচার্ডসকে খোঁচাতে গিয়ে মোক্ষম দাবড়ানি খেয়েছিলেন এক বাচাল ইংরেজ সাংবাদিক। ভিভের চরিত্র নিয়ে নানা কথা রটছে এমন কথা বলে ফেলেছিলেন সাংবাদিক সম্মেলনে। ভিভ তখন অধিনায়ক। সাংবাদিককে বললেন, "তোমায় একটা স্কুপ দিচ্ছি।বিশ্বের নানা প্রান্তে আমার চারটে অবৈধ সন্তান।খুঁজে বার করো। Your time starts now!"
আগুনে চরিত্রের ভিভ শ্বেতাঙ্গদের বারফট্টাই একটুও বরদাস্ত করতেন না।পিছনে ছিল দীর্ঘ কৃষ্ণাঙ্গ নির্যাতনের ইতিহাস। তাই তাঁকে ঠিক মজাড়ুদের দলে ফেলা যাবে না। ও দলের চূড়ামণি জাভেদ মিয়াদাঁদ।উত্যক্ত করে মনঃসংযোগ নষ্ট করায় জাভেদের উপর কেউ ছিলনা মত গাভাসকারের। দিলীপ দোশিকে খুঁচিয়েই চলেছেন"এ দিলীপ তেরা রুম নাম্বার কেয়া হ্যায়?" তিতিবিরক্ত দিলীপ বললেন "হোয়াটস ইওর প্রবলেম? ইটস থ্রি জিরো নাইন"। "আচ্ছা ঠিক হ্যায় আগলা বল য়ঁহি ভেজুঙ্গা!" শুনে দমফাটা হাসি ক্লোজ ইনে থাকা গাভাসকার আর শ্রীকান্তের।
গোলাপ মানে তাতে কাঁটাও থাকবে। শুধুই কী হাসি-মজার মেলা ক্রিকেট? রক্তাক্ত ইতিহাস,অপমান অসম্মানের কদর্য কাহিনি এত আছে যে কালী সিঙ্গির একখণ্ড মহাভারত হয়ে একটা চটি বইও হয়ে যাবে। সেকথা হবে পরে একদিন!