নিবন্ধ

নিষেধের তর্জনী

রণিতা চট্টোপাধ্যায় April 18, 2021 at 7:43 am নিবন্ধ

২০১৮ সালে কুয়েত ইন্টারন্যাশনাল লিটারারি বুক ফেয়ারের ঠিক আগে আগে সে দেশের তথ্যমন্ত্রক ৯৪৮টি বইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তার মধ্যে ছিল দস্তয়েভস্কির ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’, ভিক্টর হুগোর ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অফ নোৎরদাম’, মার্কেজের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড’। সারা পৃথিবী জুড়ে পরিচিত এই বইগুলোকে হঠাৎ নিষিদ্ধ বলে দেগে দেওয়া হল কেন? বলা হয়েছিল, সবকটি বই-ই নাকি প্ররোচনামূলক বা ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দিতে সক্ষম। গোদের ওপর বিষফোঁড়া, কোনও কোনও বই ‘ইমমরাল’-ও বটে।

মরাল’-এর প্রশ্ন যখন উঠল, এখান থেকেই উঠে আসে আর-একটা প্রশ্ন, শিল্প (শিল্পের আওতায় সাহিত্যকেও ধরে নিচ্ছি আপাতত) বা শিল্পীর স্বাধীনতার গণ্ডি কতদূর? এ কথা বলা যেতেই পারে, স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারের মধ্যে তফাত ঠিক ততটুকুই, যতটুকু শিল্প হয়ে ওঠা আর না-হতে পারার মধ্যে। না-শিল্পের ক্ষেত্রে মাত্রাবোধ শব্দটিই প্রযুক্ত হয় না, আর শিল্পী হয়ে ওঠার অন্যতম শর্ত হল সংযম। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, এই সংযমের কোনও ‘আকাদেমি অভিধান’ হয় না। হওয়া সম্ভব নয়, উচিতও নয় আদৌ। বিশেষত সেই বিধি রচনার ভার বর্তাক রাষ্ট্র বা সিস্টেমের ওপর, এমনটা চান না কোনও মুক্তমনা মানুষই। কোনও বই বা আর্ট ফর্মকে নাকচ করার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে তার উপভোক্তার। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা আসলে পাঠক বা দর্শকের স্বাধীনতাকেও খর্ব করছে, কারণ এই নিষেধাজ্ঞা তাদের নির্বাচনের অধিকার ও পারঙ্গমতা কোনোটিকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে না। ধর্ম-প্রতিবাদ-অশ্লীলতা-নৈতিকতা যে-কোনো যুক্তিতেই প্রশাসনিক নজরদারি, কিংবা আইনি নিষেধের বেড়ায় শিল্পকে বেঁধে ফেলা মুক্তচিন্তার পক্ষে বরাবর অমঙ্গলের। কারণ নিষেধের খিদে সহজে মেটে না। তার থাবায় কোথাও ধরা পড়ে অ্যানে ফ্রাঙ্ক-এর অজ্ঞাতবাসের দিনলিপি— ‘দ্য ডায়েরি অফ আ ইয়ং গার্ল’, তো কোথাও নিষিদ্ধ হয় তার ঘাতক অ্যাডলফ হিটলারের আত্মজীবনী— ‘মেইন ক্যাম্ফ’। একে পোয়েটিক জাস্টিস মনে করে হেসে ওঠাই যায়, কিন্তু তার সঙ্গে এই ভয়টাও পাওয়া উচিত যে যে-কোনো সময় ওই নিষেধাজ্ঞার আগ্রাসন নেমে আসতে পারে এই হাসির ওপরেও।

আপনি ভাবতেই পারেন, হাসির মতো একটা সামান্য ব্যাপার, তার ওপর নিষেধাজ্ঞা? রজ্জুতে সর্পভ্রম করার তো একটা সীমা থাকা উচিত! তাহলে ১৯৩৯ সালে লেখা একটা নাটক একটু উলটেপালটে দেখে নেওয়া যাক—

— এ কী ব্যাপার! হাসি!

— লজ্জা নেই তোমাদের! হাসি!

— নিয়ম মান না তোমরা! হাসি!

আসলে, যা কিছু নিয়মের বাইরে, ক্ষমতাতন্ত্র তাকেই ভারী ভয় পায়। মানুষ নিজের মতো ভাবলে, নিজের মতো বললে, নিজের মতো চললে, সে যদি রাষ্ট্রের ঠিক করে দেওয়া নিয়ম আর না মানতে চায়, তাহলে তো রাষ্ট্রের গদি টলমল করে উঠবে। তাই মানুষের চিন্তাচেতনাকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সবসময়, সে চিন্তার সারবত্তা তার কাছে থাক বা না থাক। যেহেতু শিল্প সাহিত্যের উৎস এবং বিস্তার দাঁড়িয়েই থাকে মৌলিক ভাবনাকে ভিত্তি করে, সুতরাং এদের ওপর রাষ্ট্রের জাতক্রোধ। রাষ্ট্রের উপযোগিতাবাদের দৃষ্টিতে শিল্প সাহিত্য ‘অ্যাপেন্ডিক্স’-এর মতো নিছক অপ্রয়োজনীয় হতে পারে, কিন্তু ‘অ্যাপেন্ডিক্স’-এর বেয়াড়া ব্যথা যাতে তার মাথাব্যথার কারণ না হয়ে উঠতে পারে, সেজন্য নজরদারি চালানোকে সে প্রয়োজনের তালিকায় রাখে।




‘নিষিদ্ধ’ বলতে কী বোঝায়, তার একটা চমৎকার সংজ্ঞা দিয়েছিল একবার ‘রোববার’ পত্রিকা— যা কিছু ঠিকঠাক ‘সেদ্ধ’ হয় না ধর্মখ্যাপা ও সামাজিক মাস্টারদের মগজে। সাহসী উচ্চারণ মাত্রেই পড়তে পারে এহেন নিষেধের পাল্লায়। সংবিধান বাকস্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে মানেই যা-ইচ্ছে-তাই বলবে নাকি? কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। সে কর্তার ইচ্ছে ‘যাচ্ছেতাই’ হলেও। কর্তৃত্বের অহংকারে ক্ষমতা বারবার শিল্পের স্বাধীনতার সীমারেখা বেঁধে দিতে চেয়েছে। কখনও দেশের নামে, কখনও ধর্মের নামে, কখনও নীতির সাপেক্ষে, কখনও শ্লীলতার অজুহাতে।

‘স্বাধীনতা’ মানেই তো কোনও না কোনও অধীনতা থেকে মুক্তি। যে ক্ষমতাবান, সে তো চাইবেই বরাবর নিজের অধিকার কায়েম রাখতে। আর সেই কায়েমি স্বার্থেই, প্রতিস্পর্ধার শেষতম স্ফুলিঙ্গটুকুও বিনষ্ট করে দেওয়ার একান্ত তাড়নায় সে মুছে দিতে চাইবে অপর বা ‘other’-এর কণ্ঠস্বর। তবে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেলে যেমন অভিভাবকদের মুশকিল হয়, তেমনই যে খায় তারও ঝামেলা বাড়ে বই-কি। স্বাধীনতা মানেই ছক ভাঙা, মানে প্রথার সঙ্গে বিরোধ, মানে নিষেধ, মানে হেনস্থা। স্বাধীনতার ভার অনেকখানি বলেই সাধারণ মানুষ সত্য আর মিথ্যা, খাঁটি আর ভেজাল, বিবেক আর বুদ্ধিকে ‘সমাজ’ নামক একটা পাকযন্ত্রে চাপিয়ে একটা পাঁচন বানিয়ে ফেলে নিশ্চিন্তে থাকে। কিন্তু যা কিছু সুন্দর, যা কিছু সত্য, তার নামই তো শিল্প। সুতরাং যে-কোনো অসুন্দর আর অসত্যের দিকে আঙুল তোলা শিল্পের মৌল চারিত্র্য, তার স্বাধীনতাও বটে। আর এখানেই সিস্টেমের বেঁধে-দেওয়া ছকের সঙ্গে তার বিরোধ। কারণ চিরদিনই প্রশাসন মুছে দিতে চায় সব নিয়মভাঙার গল্প। তাই ১৮৭৬-এর পরাধীন ভারতে ‘Dramatic Performances Control Act’ পাস হয়। সত্তরের দশকে উৎপল দত্তের একের পর এক নাটকের ওপর নেমে আসতে থাকে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা। ১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনায় মিলিটারি শাসন চলার সময় নিষিদ্ধ হয় ছত্রিশ বছর আগে মুক্তি পাওয়া সিনেমা, ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’। ২০০৫ সালে নিষিদ্ধ হয়ে যায় ‘হারবার্ট’ সিনেমা। ২০১৩-তেও ‘কাঙাল মালসাট’-এর মুক্তি নিয়ে সরকারের সঙ্গে তরজা চলে। এমনকি, এই ২০২১ সালেও বন্ধ করে দেওয়া হয় একটি ছোটো দলের নাটক ‘ইঁদুরকল’। আর আমরা দেখি অদ্ভুতভাবে এক অসীম স্থিতিজাড্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সময়।


আরও পড়ুন

রাষ্ট্রের শিল্পী নাকি শিল্পের রাষ্ট্র?



২০০৮ সাল নাগাদ মুক্তি পেয়েছিল কেতন মেহতা-র সিনেমা ‘রং রসিয়া’, যার বিষয় ছিল শিল্পের স্বাধীনতা। সামাজিক সেন্সরশিপের রক্তচক্ষু রবি বর্মার ছবিকে শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে রাখতে পারেনি, কিন্তু নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর তরুণী মডেলের বেঁচে থাকার অধিকার। রুশদি পালিয়ে বাঁচলেও জাপানে, সুইডেনে খুন হয়ে গেছেন ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’-এর অনুবাদকেরা। চোদ্দো বছর আগে আঁকা ছবিতে সরস্বতীকে অবমাননার অপরাধে হুসেন দেশছাড়া হয়েছেন, ‘কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে’ স্তব-আওড়ানো মানুষদের হাতে। কয়েক বছর আগেও মনীশ মিত্রের ‘ওথেলো’ নাটকে পুরুষশিল্পীর নগ্নতা নিয়ে কম হইচই ওঠেনি। পাকিস্তানি হওয়ার অপরাধে ভারতীয় সিনেমায় অভিনয়ের অধিকার নিষিদ্ধ হয়ে গেছে ফওয়াদ খানের কাছে। শিল্পীই হন, বা শিল্পের উপজীব্য বিষয়, শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অনুষঙ্গদেরও স্বাধীনতা কতটুকু? যাকে ভিত্তি করে শিল্প, সেই জীবন, বিশেষ করে মেয়েদের গোটা জীবনটাই তো একটা নিষিদ্ধ আর্ট ফর্ম। যে সত্য প্রমাণ হয়ে গেছে তসলিমা নাসরিন কিংবা মায়া আঞ্জেলো-র জীবনে। আর আজকাল তো হুসেনের চোদ্দো বছরের পুরোনো সরস্বতীর ছবির মতোই একটা বহু পুরোনো শব্দ জেগে উঠেছে। ধর্মবিশ্বাস। তাতে যে কার কখন কীভাবে আঘাত লেগে যাবে, কিচ্ছু বলা যায় না। ফলে শিল্পের কেন, যে-কোনো মুক্ত চিন্তা, যে-কোনো সাহসী উচ্চারণের নিঃশ্বাস নেওয়ার পরিসর সংকীর্ণ হয়ে আসছে আরও দ্রুত। 

পৃথিবীর প্রাচীনতম গণতন্ত্রের মুক্তচিন্তা বিনিময়ের স্থান ছিল মার্কেটপ্লেস। গ্রিক মার্কেটপ্লেস, তাদের ভাষায় যার নাম ‘অ্যাগোরা’। আমাদের ‘ওপেন স্পেস’-রা ক্রমশ মার্কেটের আক্ষরিক অর্থকে ধারণ করে নিচ্ছে নিজেদের শরীরে। উপযোগিতা-সুবিধা-লাভ-লোকসান, এমন বিভিন্ন শব্দ হিসেব কষে স্থির করছে আমাদের চিন্তা-চেতনাকে ঠিক কতখানি মুক্ত রাখা উচিত। হিসেবে ভুল হলে প্রত্যক্ষ নিষেধের তর্জনী উঁচিয়ে ধরছে ক্ষমতাকেন্দ্র। মুক্তচিন্তাকে ভেতর থেকে চুপ করিয়ে দেওয়ার এই যে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ চলছে সারা দেশ জুড়ে, তার বিরুদ্ধে লড়াইটা সহজ নয়। তবু, ভেঙে যাওয়া মানুষেরা যা কিছু নিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারে, বই-সুর-ছবি সেরকম কয়েকটা অস্ত্র। তাই যে-কোনো শাসক একে ভয় পায়। তাই, এ সব কিছুকে মুছে দিতে চায় যে নিষেধাজ্ঞা, তার বিরুদ্ধে লড়াই জারি থাকা জরুরি।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার: 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাসের দেশ

ঋতুপর্ণ ঘোষ, ফার্স্ট পার্সন

প্রতিদিন রোববার, ‘নিষিদ্ধ’ সংখ্যা 



[ লেখার মধ্যে ব্যবহৃত পোস্টারের  কার্টুনটি ডেভিড লো-র আঁকা]

[কভার পোস্টার : অর্পণ দাস] 
#বাংলা #নিবন্ধ #নিষিদ্ধ বই #রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন বিরোধী লেখাগুচ্ছ #জুজু #দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ #দ্য হাঞ্চব্যাক অফ নোৎরদাম #ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড #দ্য ডায়েরি অফ আ ইয়ং গার্ল #মেইন ক্যাম্ফ #দ্য গ্রেট ডিক্টেটর #হারবার্ট #কাঙাল মালসাট #ইঁদুরকল #রং রসিয়া #‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস #সলমন রুশদি #মনীশ মিত্র #ওথেলো #তসলিমা নাসরিন #মায়া এঞ্জেলো #অ্যাগোরা #ফ্যাসিবাদ #Fascism #প্রতিবাদ #স্বাধীনতা #শাসকের তর্জনী #সাহিত্য #সাংস্কৃতিক আগ্রাসন #শৈল্পিক প্রতিবাদ #নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন #রণিতা চট্টোপাধ্যায় #কুয়েত ইন্টারন্যাশনাল লিটারারি বুক ফেয়ার #মার্কেজ #ভিক্টর হুগো #দস্তয়েভস্কি #প্রতিদিন রোববার #তাসের দেশ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

117

Unique Visitors

183762