ফিশ-ফিশ ফ্রাই-ফ্রাই
বলো তার কী অপরাধধধধ? হ্যাঁ, বেচারি ফিশ ফ্রাইয়ের কথাই হচ্ছে। এবারের বইমেলায় সে হটকেক, তাই কাঠগড়ায়। চুটিয়ে বিক্রি, খুঁটিয়ে খাওয়া। অথচ খেয়াল করে দেখেছে এ রঙ্গভূমে সে ক্রমেই ব্যঙ্গের নিশানা হয়ে উঠছে। তাও স্বাদে যদি কারচুপি হত, নাহয় কথা ছিল। চমৎকার ফিলেয় হুলিয়ে মন হারিয়ে পাবলিক হাবুডুবু, তবু পাঁচকথা আর সাত কথা। লোকে রিল বানিয়ে মশকরা করছে। আচ্ছা, কদিন বাদে যখন আন্তর্জাতিক রিল মেলা হবে, তখন কি মানুষ বই খাবে! সেই তো তারই ডাক পড়বে। এইসব চুটকির তাহলে কী মানে! মানুষ পোস্টে পোস্টে তাকে নিয়ে এমন হল্লাগুল্লা করছে, যেন মেলার সবকটা নতুন বইয়ের পিডিএফ বানিয়ে সে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে!
মনের দুখে কিংবা রাগে তেতে একটা দারুণ গরম ফিশ ফ্রাই প্রতিরোধে প্রতিবাদে পড়ে গেল ঘাসে। একেবারে ধুলোয় লেপটালেপট। ঝেড়ে খাবে! বলা যায় না। যে কোনও রকম ঝেড়ে খাওয়াতেই মানুষ সিদ্ধহস্ত। তা ছাড়া যথেচ্ছ ধুলো মেখেও পাশের স্টলের মিষ্টিরা রেহাই পাচ্ছে না! তবে এ যাত্রায় কপাল ভালো বলতে হবে। মানুষের কবল থেকে আশ্চর্য মুক্তি পেয়ে একখানা ফিশ ফ্রাই ৯ নম্বর থেকে হাঁটা দিল মেলার গভীরে। বাঙালির মুখে সে হরবখত শুনেছে গভীরে যাও, অতএব...।
গিয়ে দেখে স্টলে স্টলে হলে হলে বহে কিবা মৃদু হায়! কারণ, পয়সা নাই। পেটিএম-রমণী মধ্যে মধ্যে বেদনাবিধুর কণ্ঠে অর্থাগমের কথা বলছেন বটে, কিন্তু কে না জানে মাসের শেষে হিসাবশাস্ত্র বিলকুল আলাদা। খাদ্য আর পদ্যের চাহিদায় যে কতখানি ফারাক, ফিশ ফ্রাই এই প্রথম চাক্ষুষ করল। অবিশ্যি তার বিস্ময়ের সীমা নেই, এই দেখে যে, একই সঙ্গে গান, ফান, কুইজ, ক্লাউন, কাপল প্রেমের কপোলে রক্তিমে আভা আর ভারি বিষয়ের বক্তিমে সব এক প্লেটে থাকে কী করে! ভারি মজাদার প্ল্যাটার! সে আরও অবাক হল, ছবি ওঠার বহর দেখে। যে হারে খিচিক চলছে, তাতে চাঁদের ওপিঠে সার্ভার না বসিয়ে কারবার বেশিদিন চালানো যাবে বলে তো মনে না। এর মধ্যেই চলছে অসংখ্য বইয়ের উদ্বোধন, উন্মোচন, উদ্ভাষণ আরও কী কী যেন! মোড়ক খুললেই বিস্ময়। ফিশ ফ্রাই কান পেতে শোনে, সে সবই নাকি অনন্তে থেকে যাবে। সে তার আয়ু আর পরিণতি জানে। অতএব বইয়ের এমন অমরত্ব জেনে ঈষৎ ঈর্ষাণ্বিত হয়ে পড়ে। তার পর ভাবে, মোটে ৬০ সেকেন্ডের বেশি মানুষের মন যাতে থিতু না হয়, তার প্র্যাকটিস চলছে জোর কদমে। বই তাহলে থেকে যাবে কোন দমে! অথচ গুণীবচন তো ব্যর্থ হতে পারে না। পদ্য আর খাদ্যের তফাৎ সে আর একবার বুঝে নিয়ে এবার পোট্রের্ট আঁকিয়ের পাশে বসে পড়ে। দেখে, মানুষ নিজের ছবি আঁকাতে ভালবাসে তবে রোজ সেদিকে তাকায় না। তাকালে এই চমৎকার স্পেক্টাকলের খুড়োর কল তাকে কোথায় যে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারত। এই না ভেবে ফিশ ফ্রাই একটু শান্তি পেল। দোষ তাহলে তার একার নয়। ভাজাভাজা বাঙালি জীবন মাছের গন্ধ চেখে মাসের শেষে একটু খুশি ছিল বই তো নয়। নইলে বই আর কজন পড়ে! চিরকালের এক কিসসা। পাঠক কমছে না বাড়ছে তা নিয়ে আলোচনা হয়। লেখক বাড়ছে না কমছে তা নিয়েও আজকাল কথা হচ্ছে। কথা হল, মানুষের হাতে সময় কমছে না বাড়ছে! লাইফটাইমের আর্ধেক তো খেয়ে গেল বুলবুলি স্ক্রিনটাইম। ভারচুয়ালের চোয়ালে আটকে মস্তিষ্কে মরুভূমি। না সিমপ্যাথি, না এমপ্যাথি। এমন প্যাথেটিক মগজে বই গিয়ে কেবল কড়াই নাড়তে পারে, অবনী দরজা খুলবে কিনা জানা নেই। তা ছাড়া যে হারে এন্টারটেইনমেন্ট, সে হারে কমেন্ট। পান থেকে চুন খসলেই আহত সেন্টিমেন্ট। এমন পলিটিক্যাল কারেক্ট সোনার হরিণ চরে বেড়ালে সাহিত্য-শিল্প সবকিছুরই মতিভ্রম হয়। চারিদিকের ধাক্কায় বই তাই এমনিই কোণঠাসা। তবু বইমেলা হয়, ফিশ ফ্রাইয়ের তো আর মেলা হয় না। সাত-পাঁচ ভাবনায় এক নম্বরের দিকে গেল সে দেখে, বই না হোক দই কিন্তু বেজায় বিকোচ্ছে। চারিদিকে ব্লিচিং আলপনায় হাইজিনের আশ্বাস। এ চত্বরে জীবাণু ও রাজনীতির প্রবেশ নিষেধ।ভাবতে না ভাবতেই এক দুরন্ত খোকার পায়ের টোকা পড়ল তার গায়ে।
ফিশ ফ্রাই এবার ছিটকে যাবে মেলা থেকে। যেতে যেতে সে শুধু দেখে, মেলার আকাশে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে কটা গ্যাসবেলুন। যদিও ওড়বার স্বাধীনতা তাদের নেই।