ফিল্ম রিভিউ – ‘নগরকীর্তন’
সিনেমা : নগরকীর্তনপরিচালক : কৌশিক গাঙ্গুলীকাহিনি ও চিত্রনাট্য : কৌশিক গাঙ্গুলীঅভিনয় : ঋদ্ধি সেন, ঋত্বিক চক্রবর্তী, ইন্দ্রাশিস রায়, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, নীল চক্রবর্তীপ্রযোজনা : অ্যাক্রোপলিস এন্টারটেইনমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেডমুক্তি : ২০১৭
অভিসার বিষয়ক কীর্তন পদ দিয়ে শুরু হয় ‘নগরকীর্তন’। সিনেমার গল্পটি আবর্তিত হয় মিলনের সুর বুকে নিয়ে। কাহিনির মূল দুই চরিত্র পুঁটি (ঋদ্ধি সেন) এবং মধু (ঋত্বিক চক্রবর্তী) । আপাদমস্তক পুরুষ মধুর প্রেমে মজে মনের দিক থেকে নারী পুঁটি। মধুর ভালোবাসাতেই বিলীন হয় পুঁটির শরীর ও মন। পুঁটি তার পরিমলের শরীরকে পাল্টেও ফেলে হয়ে উঠতে চায় রাধারূপী পরী কিংবা মধুদা’র রিঙ্কু। আর বাঁশীবাদক মধুদাও ধীরে হয়ে ওঠে কৃষ্ণ। অভিসার, বিরহের পর্যায়ক্রমে প্রবুদ্ধ’র সুরে এইভাবেই এগিয়ে চলে নগরকীর্তন।
ছবির মাঝামাঝি দেখা যায়, অনেক ওঠা-পড়ার পর মধুদা’র হাত ধরে পুঁটি পৌঁছে গেছে শ্রীচৈতন্যের শহরে। শ্রীচৈতন্যের কৃষ্ণের পায়ে নিজেকে বিলীন করার কাহিনি এই অনুষঙ্গে ছবির মূল গল্পটিকে এক অনন্যতা দান করে। নবদ্বীপে মধুদা’র বৌদির (বিদীপ্তা চক্রবর্তী) সঙ্গে আলাপ হয় পুঁটির। নিজের চোখের সামনে বৌদির শাড়ি বদলের দৃশ্য পুঁটির চোখে-মুখে ফুটিয়ে তোলে এক অপার-বিস্ময়। সে অনুভব করে যে, সে আসলে কী হয়ে উঠতে চায়। পুঁটির মনন এবং শরীর যে ভিন্ন তা আবারও স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার কাছে।
পুঁটির আকাঙ্ক্ষিত শরীর প্রাপ্তির চাহিদা সিনেমাটির ছত্রে ছত্রে ব্যক্ত করেছেন নির্দেশক। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সঙ্গে এক সুরের সুতোয় তিনি জুড়েছেন ‘নগরকীর্তন’কে। তাই তো কীর্তনের সুরে, প্রেমিকের বাঁশির গুঞ্জনে পুঁটির মনে পড়ে যায় তার প্রথম প্রেম – সুভাষদাকে (ইন্দ্রাশিস রায়), যে প্রেমকে নিজের দিদির পায়ে কাছে বিলীন হতে দেখেছিল পুঁটি থুড়ি পরী। ছিঁড়ে পাওয়া রঙিন কাগজের মতো সেই বিয়ের রাতেই পরী নামক ফুলটি চ্যুত হয়েছিল সমাজ নামক মালা থেকে। গুরুমা’র কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে সে হয়ে উঠেছিল পুঁটি। পুরুষের দেহে নারীমন নিয়ে বেড়ে ওঠে যে, তাকে সমাজ কীভাবে ঠেলে দেয় অন্ধকারের অভিমুখে - তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন 'নগরকীর্তন'-এর নির্দেশক।
ইতিমধ্যেই সিনেমায় আলাপ হয়েছে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পুঁটির সামনে উন্মোচিত হয় ইতিহাসের পর্দা, সে স্পষ্ট বুঝতে পারে তার মধুদা’র প্রতি প্রেমটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সে এগিয়ে চলে তার পথে, পেতে চায় নারী শরীর। উপহারে পায় এক শ্রীচৈতন্যের মূর্তি, সেই শ্রীচৈতন্য – যার সঙ্গে পুঁটির এক অদ্ভুত মিল।
সকল চরিত্রেরই অভাবনীয় এবং সংযমী অভিনয় যেমন মন কাড়ে তেমনই কয়েকজন বৃহন্নলার অভিনয়ও কুর্নিশ করার মতো। ছবির একেবারেই শেষ পর্যায়ে দেখা যায়, আগের প্রেমিকের কথা মনে করে কীর্তনের সুরে একাত্ম পুঁটির সজল চোখ কোনোভাবেই খেয়াল করতে পারে না যে ভরা সভায় কখন তার পরচুলা খুলে পড়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে সে পালিয়ে যায় তার মধুদা’কে ছেড়ে। কিন্তু রাধা যেমন কৃষ্ণের অভিসারে গেছিলেন তেমনি দোলের দিন রঙমাখা মুখে, মলিন হৃদয় নিয়ে মধুদাও আসে পুঁটির খোঁজে। জানতে পারে, মিথ্যা অভিযোগে একদল হিজড়ে-র হাতে মার খায় পুঁটি। রাস্তার মোড়ে সর্বসমক্ষে তারা নগ্ন করে পুঁটিকে, তাকে দিয়ে জোর করে বলায় “আমি ব্যাটাছেলে”। আসলে সেখানেই মৃত্যু ঘটেছিল পুঁটির, তারপর তার নীল রঙমাখা ঝুলন্ত দেহ শুধুমাত্র মৃত্যু ঘোষণা করেছিল তার রাধা হয়ে বাঁচার স্বপ্নের। তাই তো নির্দেশক কৌশিক গাঙ্গুলী, রাধা হয়ে ওঠার স্বপ্ন নিয়ে জেগে থাকা পুঁটির জীবনের অবসান ঘটালেন কৃষ্ণের নীলরঙা দেহ নিয়ে।
কিন্তু আমাদের সিনেমার কৃষ্ণ যখন রাধারূপে ফিরে আসে সেই অন্ধকার জীবনে, তখন তার সাথী হন শ্রীচৈতন্য। জিতে যায় রাধা, মৃত্যু হয় কৃষ্ণের।
আসলে হেরে যাই আমরা, হেরে যায় সমাজ।
#Review #Film #নগরকীর্তন #কৌশিক গাঙ্গুলী #ঋত্বিক চক্রবর্তী #ইন্দ্রাশিস রায় #ঋদ্ধি সেন #Third Gender #Transgender #সিলি পয়েন্ট #অহনা বড়াল