ভয় (দ্বিতীয় কিস্তি)
বাড়ি ফেরার আর তেমন তাড়া নেই। কারণ আজকাল মাথার ভিতর অনেকের স্বর শুনতে পাই। কার কার কণ্ঠ, আলাদা ভাবে বুঝতে পারি না অবশ্য। কিন্তু প্রায় সমস্ত দিনই চারটে আলাদা আলাদা স্বর, কখনও হয়তো পাঁচটা, অনর্গল কথা বলে চলেছে আমার মাথার ভিতর। বেশিরভাগ সময়েই কথাগুলো বলা হচ্ছে আমাকে, কিন্তু একেবারে প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য করে নয়। কিছুটা না-শোনানোর ভানে। আমার ভিতর কথাগুলো মোনোলগের মতো শুনি। আলাদা আলাদা চারটে বা পাঁচটা মোনোলগ, স্পষ্ট উচ্চারিত হয়। কখনও আবার একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, সবাই একসঙ্গে বলতে শুরু করে। শেষ কিছুদিন শুনতে শুনতে আমি বুঝি, সবকটা কথাই আসলে আমার প্রতি।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বরগুলো আমাকে বলে, ঠিক হচ্ছে না। যা হচ্ছে, ঠিক হচ্ছে না। যা করছি, ঠিক হচ্ছে না। যা মানছি, ঠিক হচ্ছে না। স্পষ্ট বুঝতে পারি, রাগে মনে মনে গজরাচ্ছে ওরা। আমার উপর ভয়ানক রাগ, কারণ আমি সমক্ষে নিজেকে যা-ই দাবী করি না কেন, আসলে আমি সবার মতো নিরাপত্তার লোভে অসভ্যের পা-চেটে প্রসাদ খাওয়া একটা জন্তু। সেদিন এক স্বর ভিতরে হঠাৎই বললো, লজ্জা করে না নিজেকে শিক্ষাজগতের মানুষ বলতে? শুনেই কান-মাথা ঝাঁঝাঁ করে উঠলো, নিজের মনেই দাঁত শক্ত করে উত্তর দিতে যাবো নিজেকেই, দ্বিতীয় স্বর বললো, 'শিক্ষাজগতে আছো বলেই কিন্তু সমাজ হেবি সম্মান দেয় এখনও; "কলেজে পড়াই" বলে প্রেস্টিজ কুড়িয়ে নাও এই ফাঁকে, হাজার গরমিল করলেও কেউ কিছু বলার আগে দু'বার ভাববে! বুঝছো না কেন, আর যা কিছু করতে চাইছো, তার জন্য এই পদটা জরুরি?' কেমন ভেবলে গেলাম উত্তরটা দিতে গিয়েও। তৃতীয় একটা গলা বিচ্ছিরি হেসে কাকে যেন একটা বললো, 'আবার ভাবছে এখন! এদের শিরদাঁড়া, আত্মসম্মান থুতু দিয়ে তৈরি।' চতুর্থ স্বর কী বললো বুঝতে পারলাম না; সে কেবল পচা মাংসে যেমন পোকা কিলবিল করে, সেভাবে আমার মাথার প্যাঁচে প্যাঁচে ঢুকে স্নায়ুগুলো টেনে ছিঁড়ে দিতে লাগলো।
আজকাল এদের সঙ্গেই আমার বেশি কথা হয়। আসল রক্তমাংসের মানুষদের সঙ্গে নয়। কারণ আসল মানুষেরা সুরাহা চায়, শান্তি চায়, হাতমুঠোয় যেটুকু ধরা যায়, তাকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু দুঃখের বা সুখের বিষয় হলো এই যে, আমি বুঝেছি ওই সুরাহা, বাঁচায় শুধু মৃত্যু আছে। অথচ মৃত্যুর উল্টোদিকে যে একটা জীবনের খোঁজ দেব, তার জোর নেই এই থুতুভরা শিরদাঁড়ায়। এদিকেও মৃত্যুই। পাঁচটা স্বর মিলে আমাকে মেরে ফেলছে প্রায়। সকাল থেকে তাদের সঙ্গে কথা বলে বলে দুপুর গড়িয়ে গেলে যখন তারা একটু থামে, আমার মনে হয় এবার পরম শান্তি; এই নিশ্ছিদ্র স্তব্ধতাতেই নিশ্চয়ই আমি নিজেকে পাবো।
আরও পড়ুন : ভয় (প্রথম কিস্তি) / শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী
কিন্তু পাই না। মর্গে থাকতে থাকতে একটা সময়ের পর মড়ার গন্ধ না পেলে অপূর্ণ লাগে, আমারও, মাথার ভিতর কথা থেমে গেলে একা লাগে খুব। ভয় করতে থাকে। বিকেল নাগাদ আবার প্রলাপ শুরু হয়। আমাকে দোষারোপ, কুৎসিত ভাষায় খিস্তি, টিটকিরি। আমার শান্ত লাগে, পূর্ণ লাগে। সারাদিন এত অকাজে থাকি, যে ভিতরের এই পাঁচটা স্বর কথা বলে উঠলে মনে হয়, একটা কাজ পেলাম। কথা চলতে থাকে। ট্রানজিস্টরের খবর শোনার মতো কখনও কখনও ওদের কথায় কান দিই। আমাকে নিয়ে অনর্গল আলোচনা। আঃ! ইগো-গ্র্যাটিফিকেশন! তারপর আবার মন সরিয়ে নিই। ভালোলাগে না। বাচালতায়, নীরবতায়, কোথাওই নিজেকে খুঁজে পাই না আর আজকাল। বাড়ি থেকে দূর, আরো দূরে হাঁটতে থাকি। ফেরার কোনো তাড়া নেই।
........................................
[পোস্টার : অর্পণ দাস]