ভয় (তৃতীয় কিস্তি)
দিদুনের ভারি ইচ্ছে ছিল, তার শ্রোতা হোক অনেকে। কথার লাগাম নেই কোনো। সারাক্ষণ, মানে এক্কেবারে সর্বক্ষণ যা নয় তাই বলে চলেছে। কাউকে একটা হাতের কাছে পেলে হলো। গল্পের ঝাঁপি খুলতে দিদুন উদগ্র। এত গল্প একটা মানুষের এক জীবনে কিভাবে আসতে পারে, আমি বুঝতাম না। গল্প ফুরিয়ে গেলেও অসুবিধে নেই। টিভিতে দেখা সিরিয়ালের বিশ্লেষণ, এর পরের এপিসোডগুলোয় কী হতে পারে, সে নিয়ে আলোচনা। আলোচনায় আর দ্বিতীয় কোনো বক্তা না হলেও চলবে। দিদুনের শ্রোতা প্রয়োজন। বাড়িতে লোকজন জমায়েত হলে তো কথাই নেই। সময় ফুরিয়ে যায়, দিদুনের কথা ফুরোয় না। আমার বন্ধুরা আড়ালে হাসে, বাবা-মা বিরক্ত হয় আড়ালে, জ্যেঠু আর থাকতে না পেরে কখনও ধমকেই ওঠে, "এবার একটু থামবে তুমি?" জ্যেঠুর বকুনি শুনে দিদুনের আর কোন ছোটবেলার গল্প যেন মনে পড়ে যায়। মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সবাই বলে পালাই-পালাই। প্রতিদিন, প্রতিরাত সব্বাই জানি, দিদুনের শ্রোতা হতে গেলে তার সামনে বসতে হয় না। আসা-যাওয়ার পথে সকলেই তার শ্রোতা। আমরা কেউই তার কথা শুনি না। বাড়তির খাতায় রাখে।
পুজোর ঠিক সাতদিন আগে, আমাদের পাম্পঘরের সামনে সিঁড়ির নিচের যে অল্প-আলো জায়গাটা, সেখানে পুরোনো একটা ভাঙা বালতি রেখে ফিরে এসে কথা বন্ধ হয়ে গেল দিদুনের। ঘরে ছিল মা আর কাজের দিদি নমিতা। দিদুন ঘরে ঢুকে নমিতা দিদিকে কী যেন একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন, তারপর একেবারে অগ্রপশ্চাৎ ভুলে যাওয়া এক মানুষ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমাদের ঠাহর করতে একটু সময় লাগলো বটে ব্যাপারটা; বোঝার পর দিদুনকে ধরে বসানো হলো চেয়ারে। প্রশ্ন করা হলো। মুখে-চোখে আর কোনো ভাবলেশ নেই। যে প্রশ্ন করছে, তার মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে দিদুন। প্রশ্নের উত্তর আসছে না। জ্যেঠু অফিস থেকে ফিরে বললেন, মাইনর স্ট্রোক নিশ্চয়ই। ডাক্তার এলেন, গেলেন। দরকারি টেস্ট করা হলো। কিন্তু মগজে ক্লট নেই কোনো। ডাক্তার বললেন, সময় লাগবে। আমিও ভাবলাম, পরীক্ষার মুখে কদিন দিদুন একটু কম কথা বলবে, শান্তি! আর কেউ মুখে না বললেও, এর থেকে খুব আলাদা যে কিছু ভেবেছিল, মনে হয় না।
এখন দিদুনের ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মাঝেমাঝে তাকাই। বাজ পড়ে মরে যাওয়া শিরীষ গাছের মতো দিদুন দাঁড়িয়ে থাকে বেশিরভাগ সময়, দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে। দেখে মনে হয়, দেওয়ালে কিছুটা উঁচুতে যেন কেউ ঝুলছে, তার সর্বস্ব মেপে নিচ্ছে দিদুন। খাওয়া-দাওয়া ঠিকই আছে। ঘুমও। বাথরুম কখনও-সখনও জামায় হয়ে যায়, কিন্তু শারীরিকভাবে অথর্ব হয়ে যাওয়া যাকে বলে, দিদুন তার ধারেকাছে নয়। ঘরের মধ্যে হাঁটে আস্তে আস্তে, খেতে আসে দেওয়াল ধরে, এক-দুবার ছাদে ওঠার চেষ্টা করেছে, মা উঠতে দেয় নি। কিন্তু সবার চেয়ে আলাদা হয়ে গেছে দিদুনের চোখ, আর নীরবতা। কিছুর দিকে, কারুর দিকে তাকালে আর চোখ ফেরায় না। পুজো পেরিয়ে শীত চলে এলো, শীত চলেও গেল, দিদুন কথা বলে না। আত্মীয় পরিজন, এমনকি বন্ধুরা ফোন করে, জানতে চায়, দিদুন কথা বললো? বাড়িতে লোকজন ভিড় করে আসে জমায়েতে। ড্রয়িং রুমে সবার মাঝে একটা চেয়ারে দিদুনকে বসানো হয়। সবাই নানা প্রশ্ন করতে থাকে, কথা শুনতে চায়। দিদুন তাকায়। হয়তো বা শোনে। কিন্তু হাসে না, ভুরু কুঁচকোয় না, সাড়া দেয় না। শ্রোতারা সরব হয়ে ওঠে, তারপর উদ্দীপনা নিভে আসে। দিদুন সমাধিস্থ। কথায় তাকে যারা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল, নীরবতায় তারা শুধু স্বর শুনতে চায়। কারণ, দিদুন এত কথা বলতো, ঠিক কেমন কথা যে বলতো, কী যে বলতো, সবাই ভুলে গেছে। তাই, আর একবার তারা শুনতে চায়। কী জেতাই না জিতলে তুমি, আমি দূর থেকে দেখি আর ভাবি। পাম্পঘরের পাশে সিঁড়ির আলো দপদপ করে ওঠে। মনে মনে ঠিক করে রাখি, আমিও একদিন এরকম চুপ করে যাব, কাউকে কিচ্ছু না বলে। তারপর আমি আর দিদুন মুখোমুখি বসে অনেক না-কথা বলবো, আর দুজনেই জানবো, এ সবই মুখোশ।