মঞ্চে ব্যর্থ, কলমে মায়াজগৎ গড়েছিলেন হান্স আন্ডারসন
হতে চেয়েছিলেন থিয়েটারকর্মী, কিন্তু ভাগ্য তাঁর জন্য অন্য কিছু ভেবে রেখেছিল। হান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্ডারসন আজ তাঁর রূপকথার কাহিনির জন্য গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছে এক কিংবদন্তী। তিনি নাট্যচর্চায় সাফল্য পেয়ে গেলে কি শিশুসাহিত্য পেত লিটল মারমেড, হাঁসের ছানা বা তুষাররানিকে?
কোপেনহেগেনের দক্ষিণ-পশ্চিমে ডেনমার্কের এক শহর অডেন্স (Odense)। এখানেই ১৮০৫ সালে জন্ম নিয়েছিলেন অ্যান্ডারসন। মা করতেন ধোপার কাজ, আর বাবা বানাতেন জুতো। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই ছিল। অ্যান্ডারসেনের মনে শিল্পসাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তৈরি হয়।
পরে মায়ের থিয়েটারে কাজ পাবার সূত্রে ছোট্ট অ্যান্ডারসন মাঝে মাঝেই থিয়েটারে যাবার অবকাশ পেলেন। ফলে থিয়েটারের প্রতি তাঁর আকর্ষণ তৈরি হলো। বাবা তাঁকে বাসাতেই খেলনা একটি থিয়েটার বানিয়ে দেন, যেখানে শিশু অ্যান্ডারসন নিজের হাতে গড়া পুতুল দিয়ে নাটক করতেন। পিতার অকালমৃত্যুর পর উপার্জনের তাগিদে কিছুদিন তাঁকে তাঁতির কাজ করতে হয়, একটি তামাকের কোম্পানিতেও কিছুদিন কাজ করেন। কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখতেন ডেনমার্কের থিয়েটার জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। তাই ১৮১৯ সালে অ্যান্ডারসন চলে যান কোপেনহেগেন। রয়্যাল থিয়েটারে পরিচালক সিবোনিসের গানের একটি অনুষ্ঠানে তিনি পারফর্ম করে কিছু অর্থ পান। সিবোনিস তাকে প্রতিশ্রুতি দেন নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়ার। পাশাপাশি রয়্যাল থিয়েটারের বালকদের গানের দলে তিন বছরের জন্য তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হলো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বয়ঃসন্ধিকালে অ্যান্ডারসনের কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হলে তা আর বালকদের দলে গাইবার উপযুক্ত রইল না। ফলে একরকম বাধ্য হয়েই এক বছর পরেই সিবোনিস তাকে গানের দল থেকে খারিজ করে দেন। এরপর অ্যান্ডারসন নৃত্যে প্রশিক্ষণ নেবার জন্য রয়্যাল কোর্ট স্কুল অফ ড্যান্সে ভর্তি হন। পাশাপাশি অভিনয় শেখার চেষ্টা করতে থাকেন।
এই সময় থেকেই তিনি লেখালিখির চেষ্টাও শুরু করেন। ১৯২১ সালে একটি নাটক লিখে থিয়েটারে জমা দেন, কিন্তু সিলেকশন কমিটি সেই নাটক মঞ্চস্থ করবার যোগ্য মনে করেনি। পরবর্তীতে প্রকাশিত একটি বইয়ে সেই নাটকের একটি দৃশ্য অন্তর্ভুক্ত হলে রয়্যাল থিয়েটারের পরিচালন সমিতি থেকে অ্যান্ডারসনকে ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি জোনাস কলিন্স নামে এক ভদ্রলোকের নজরে পড়ে গেলেন। কলিন্স ছিলেন রয়্যাল থিয়েটারের একজন পরিচালক এবং ডেনমার্কের রাজা ষষ্ঠ ফ্রেডেরিকের ঘনিষ্ঠ। অ্যান্ডারসনের ছাইচাপা প্রতিভা তার জহুরি চোখ চিনতে ভুল করেনি। তখনকার দিনে রাজার পক্ষ থেকে বিশেষ বিশেষ ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা ছিল। কলিন্স ফ্রেডরিকের সাথে কথা বলে অ্যান্ডারসনের জন্য সেই ব্যবস্থা করলেন। তিন বছরের জন্য ৩৫০ ড্যানিশ মুদ্রা তার জন্য বরাদ্দ হয়, যার মেয়াদ পরে ১৮২৯ সাল অবধি বাড়ানো হয়েছিল।
১৮২৯ সাল অ্যান্ডারসনের জন্য ছিল একটি মাইলফলক। এই বছর প্রকাশিত হয় তাঁর ছোটগল্প 'A Journey on Foot from Holmen’s Canal to the East Point of Amager'। গল্পটি পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। উৎসাহিত অ্যান্ডারসন এরপর লিখে ফেলেন 'Love on St. Nicholas Church Tower' নামে একটি নাটক। তারপর জার্মানি ঘুরে এসে ১৮৩১ সালে লিখলেন তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা, শ্যাডো পিকচার্স অফ অ্যা জার্নি টু দ্য হার্জ মাউন্টেইনস অ্যান্ড স্যাক্সোনি। জার্মানিতে থাকার সময় তিনি সেখানকার সাহিত্যে অনুপ্রাণিত হন, বিশেষ করে গ্রিম ভাইদের গল্পগুলো তাকে নাড়া দেয়। দেশে ফিরে আসবার পরে রাজার তরফ থেকে তাকে আরো কিছু অর্থ অনুমোদন দেয়া পেয়ে অ্যান্ডারসেন ইউরোপে পাড়ি জমালেন। জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ঘুরে ১৮৩৪ সালের অক্টোবরে তিনি ইতালিতে এসে পৌঁছেন। এখানকার মানুষ আর প্রকৃতি তাকে অভিভূত করে। তিনি লিখে ফেলেন আত্মজৈবনিক আকারে রচিত গল্পগ্রন্থ 'The Improvisatore', যা প্রকাশিত হয় ১৮৩৫ সালে। এই বছর থেকেই প্রকাশিত হতে শুরু করে হান্সের রূপকথার গল্পসমূহ। রাতারাতি খ্যাতি পেতে শুরু করেন তিনি। ১৮৩৭ সালে Bentley's Miscellany ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় অ্যান্ডারসেনের গল্প 'The Little Mermaid' তুমুল জনপ্রিয় হয়। সব মিলিয়ে অ্যান্ডারসেন লিখেছেন ১৬৮টি-র মতো রূপকথার গল্প। The Tinderbox, The Nightingale, The Snow Queen, The Ugly Duckling, The Emperor's New Clothes, The Flying Trunk, The Red Shoes, The Princess and the Pea ইত্যাদি। তার অনেক লেখা যুগ যুগ ধরে লোকমুখে চলে আসা গল্পের পরিশীলিত রূপ, আর কিছু কিছু রচনা অন্যান্য উৎস থেকে অনুপ্রাণিত হলেও কাহিনী মৌলিক।
১৮৭৫ সালে তিনি মারা যান। জন্মস্থান অডেন্স শহরে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত হয় মিউজিয়াম, যা পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। হান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্ডারসনের রূপকথার কাহিনি আজও সব বয়সের মানুষকে নির্মল আনন্দ দিয়ে আসছে।
#হান্স আন্ডারসন #থিয়েটার #শিশু সাহিত্য #রূপকথা #সিলি পয়েন্ট #ওয়েব পোর্টাল