ফিচার

আইনস্টাইনের শত্তুরেরা

অর্পণ পাল Jan 3, 2023 at 7:47 pm ফিচার

আইনস্টাইন সম্প্রদায়গতভাবে ইহুদি, এবং জন্মসূত্রে ছিলেন জার্মান নাগরিক; পরে নিজের জার্মান পরিচয় ছেড়ে সুইৎজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন। যদিও চাকরিসূত্রে থাকতেন জার্মানির বার্লিনে। ওই শহরে থাকা শুরু করবার বেশ কয়েক বছর পরে, ১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে জার্মানিতে যখন হিটলারের নাৎসি-সরকারের শাসন-আমল শুরু হল, বিশেষ করে কোপ পড়তে শুরু করল ইহুদি ব্যক্তিদের ওপর। চাকরিক্ষেত্রে বা বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যে সমস্ত ইহুদি-পরিচয়বাহী চাকুরীজীবী বা শিক্ষক-অধ্যাপক কর্মরত ছিলেন, তাঁদের নানাভাবে বাধা দেওয়া শুরু হল, ছাঁটাই করা হল অনেককেই। রীতিমতো আইন পাশ করিয়ে কর্মচ্যুত করা হয়েছিল অধ্যাপকদের।

ওই সময়কালে জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নামডাক ছিল পৃথিবী-জোড়া। বার্লিন, হামবোল্ট, লিপজিগ, গটিংগেন বা হেইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো বা গবেষণার কাজে যুক্ত ছিলেন বহু বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। এর মধ্যে কয়েকটা নাম দেখলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা— ম্যাক্স বর্ন, এডওয়ার্ড টেলার, লিও জিলার্ড, এনরিকো ফার্মি এবং আরও অনেকে। বাদ যাননি সাহিত্য, শিল্প বা গণিতের অধ্যাপকেরাও। সব মিলিয়ে জার্মানির বিজ্ঞান-জগতে যেন নেমে এল অন্ধকার দশা। 


২/ 

ইহুদি-হঠাও নামে যে ধুয়ো উঠেছিল ওই সময়কার জার্মানিতে, ওই তালিকায় পয়লা নম্বর স্থানে ছিলেন আইনস্টাইনই। সেই ১৯১৪ সাল থেকে তিনি বাস করছেন বার্লিনে, কিন্তু হিটলারের আমলে তাঁকে তিতিবিরক্ত হয়ে অবশেষে ১৯৩৩-এর সেপ্টেম্বর মাসে পাকাপাকিভাবে তাঁকে দেশ ছাড়তে হল। যদিও এর কয়েক মাস আগে থেকেই তিনি বাস করছিলেন ইংল্যান্ডে। ওদিকে বাইরের জগতের সবাই জানত তিনি ছুটি কাটাতে গিয়েছেন। সমুদ্রের ধারের শান্ত একটি কটেজে অস্থায়ীভাবে রয়েছেন বটে, অথচ তাঁকে আর এলসাকে সর্বক্ষণ পাহারা দিয়ে চলেছে এক দল সশস্ত্র বন্দুকধারী রক্ষী। 

ততদিনে জার্মানির একাধিক কাগজে হিটলারের সমালোচনা করে মুখ খুলে নাৎসিদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছেন আইনস্টাইন। তাঁর নামে নাৎসি-পোষিত সংবাদমাধ্যমে চলছে নানারকম নিন্দাসূচক প্রচার। তাঁর লেখা বই পোড়ানো হয়েছে প্রকাশ্যে, ওইসব বই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানোও বারণ (বই পোড়ানোর ওই উৎসবে ঠাঁই পেয়েছিল ব্রেশট বা কার্ল মারক্স-এর মতো জার্মান দার্শনিকদের বইও)। আর দেশ ছেড়ে সস্ত্রীক আইনস্টাইন যখন পালালেন প্রথমে বেলজিয়াম আর পরে ইংল্যান্ডে, তখন তাঁর এবং এলসার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হল। বার্লিনের কাছে তাঁদের গ্রীষ্মাবাসে এক দল পুলিশ এসে সার্চ করে গেল যদি অস্ত্রটস্ত্র কিছু পাওয়া যায়। যেন ভয়ঙ্কর এক অপরাধ করে আইনস্টাইন পালিয়েছেন দেশ ছেড়ে, এমনভাবে প্রচার চলছিল জার্মানি জুড়ে। 



অন্যদিকে আত্মভোলা আইনস্টাইন নিজে তাঁর এই কড়া নিরাপত্তার মধ্যে কাটানো বিশেষ অবস্থায় খুশি ছিলেন না মোটেই। মাঝেমধ্যেই রক্ষীদের প্রহরা এড়িয়ে চলে যেতেন এদিক-ওদিক, কখনও একটা বোটে চেপে ভেসে পড়তেন সমুদ্রের বুকে। তাঁর ওপর যে যে কোনো সময় প্রাণঘাতী আক্রমণ হতে পারে, এটা জেনেও তিনি এ ব্যাপারে প্রায় উদাসীনই থাকতেন। এমনকি এটা জানলে মজাই লাগে যে নিজে সাঁতার জানতেন না, তবু সঙ্গে করে একটা লাইফ-জ্যাকেট বা লাইফ-বেল্ট পর্যন্ত রাখতেন না কখনও। 

কিন্তু আগস্ট মাসের পর আইনস্টাইনের নতুন করে আবার প্রাণ-সংশয় দেখা দিল, কারণ ওই মাসে তাঁর এক বন্ধু এবং জার্মান দার্শনিক থিওডোর লেসিং খুন হলেন চেকোস্লোভাকিয়ায়। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হল যে এবার আসছে আইনস্টাইনের পালা। এমনকি তাঁর মাথার দাম পর্যন্ত ধার্য করা হয়েছে জার্মানিতে, এমনও খবর শোনা গেল। এটা শুনে আইনস্টাইন নিজে নাকি বলেছিলেন, ‘আরে আমি তো জানতামই না যে আমার মাথার এত দাম!’ 

অবশেষে আমেরিকার প্রিনস্টনে যাত্রা করলেন আইনস্টাইন, সেখানকার ‘ইনস্টিটিউট ফর দ্য অ্যাডভান্সড স্টাডি’ প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে। আর কোনোদিন তিনি লন্ডনে বা জার্মানিতে ফেরেননি। 

৩/ 

কিন্তু এই পুরো ঘটনা-প্রক্রিয়ায় আরও নিন্দাজনক ভূমিকা নিয়েছিলেন দু-জন জার্মান বিজ্ঞানী। যাঁরা নিজেরা বিজ্ঞানের জগতের মানুষ হয়েও সেদিন প্রবলভাবে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আইনস্টাইনের। এঁদের একজন ফিলিপ লেনার্ড (১৮৬২ - ১৯৪৭), অন্যজন জোহানেস স্টার্ক (১৮৭৪ - ১৯৫৭)। আর্য বিজ্ঞান বা ‘Ariyan Physics’ বা ‘Deutsche Physik’-এর সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলেন এই দুই বিজ্ঞানী। 

বিজ্ঞানীরাও যে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো ঈর্ষান্বিত, হিংসুটে বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে পারেন, তার খুব ভালো উদাহরণ এই লেনার্ড সাহেব। কোনো ধাতুর ওপর ঠিকঠাক তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বা কোনো তরঙ্গ ফেললে সেই ধাতুর মধ্যে থেকে বের হয়ে আসে ইলেকট্রন, এই ব্যাপারটাকে প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন এই লেনার্ডই। আইনস্টাইনের চেয়ে সতেরো বছরের বড় এই জার্মান পদার্থবিদ নিজে ছিলেন পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানে দারুণ দক্ষ। নোবেল পেয়েছিলেন আইনস্টাইন ওই পুরস্কার পাওয়ার সতেরো বছর আগে। কিন্তু আইনস্টাইনের বিরোধিতায় নেমে পড়বার পর তাঁর অন্য সব কাজ গেল মাটি হয়ে। 

অথচ তাঁদের সম্পর্ক প্রথম দিকে বেশ স্বাভাবিকই ছিল। দুজনের মধ্যে কথাবার্তা, চিঠিপত্রের আদানপ্রদান— এসব চলতই। কিন্তু পরের দিকে দুজনের সম্পর্কে শীতলতা আসতে শুরু করে; প্রথমে লেনার্ডই আইনস্টাইনের কাজ সম্বন্ধে নিন্দা করতে শুরু করেন প্রকাশ্যে। আর এই সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অন্ধকার নেমে আসে ১৯২০ সালে, যে বছর আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের সাধারণ তত্ত্বকে প্রকাশ্যেই প্রবলভাবে আক্রমণ করেন লেনার্ড। আর ততদিনে তিনি সে দেশে ইহুদি-বিদ্বেষীও নিজেকে বেশ প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন, সুতরাং আইনস্টাইনের তত্ত্বের ওপর এই আক্রমণ জার্মানিতে ভালোরকম সমর্থনও পেল। আইনস্টাইন প্রথমদিকে তার এই আক্রমণের ব্যাপারে উদাসীনতা দেখালেও পরের দিকে তিনিও লেনার্ডকে ব্যক্তি-আক্রমণ করতে শুরু করেন। আরও পরে ১৯৩৩ সালের দিকে, যখন সে দেশে ইহুদি বিদ্বেষ চরম অবস্থায় পৌঁছেছে, তখন লেনার্ড একটি বই প্রকাশ করেন ‘গ্রেট মেন ইন সায়েন্স’ নামে; যে বইয়ে তিনি আইনস্টাইনের নাম বাদই দিয়ে দিলেন! শুধু আইনস্টাইন কেন, সেখানে রইল না মাদাম কুরি বা উইলহেল্ম রয়েন্টগেন-এর নামও। এঁরাও যে আর্য-রক্তের বাহক নন! জার্মানিকে আর্য-রাষ্ট্র বানাতে হিটলারের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েছিলেন ফিলিপ লেনার্ড। 

অন্যজন, জোহানেস স্টার্ক-ও নোবেল পেয়েছিলেন আইনস্টাইনের আগেই, ১৯১৯ সালে। ইনি আবিষ্কার করেছিলেন তাঁরই নামে পরিচিত ‘স্টার্ক এফেক্ট’, যার মূল কথা: কোনো পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রন যখন এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে ঝাঁপ দেয়, তখন কিছুটা শক্তি ফোটন কণার আকারে নির্গত হয়। এই ফোটন কণার শক্তির ওপর বাইরে থেকে প্রযুক্ত ইলেকট্রিক ফিল্ড বা তড়িৎক্ষেত্রের কী প্রভাব থাকতে পারে। কোনো তড়িৎযুক্ত আধান বা চার্জ একটা জায়গায় রাখা হলে ওটার চারপাশে কিছুটা এলাকা অবধি ওই চার্জের দরুন মন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়, যেখানে অন্য একটা চার্জকে আনলে সে কিছু টান অনুভব করে। ওই এলাকাকেই বলে তড়িৎক্ষেত্র। 

বাহ্যিক তড়িৎক্ষেত্রের প্রভাবে ইলেকট্রনের কক্ষ-পরিবর্তনের দরুন উৎপন্ন ফোটনের শক্তিস্তর কয়েকটা ভাগে ভেঙে যায়, এইটাই দেখিয়েছিলেন স্টার্ক। আর যেহেতু ইনি লেনার্ডের মতোই পরীক্ষা কাজে ছিলেন দারুণ দক্ষ, তাই স্বভাবতই আইনস্টাইনের তত্ত্বীয় আবিষ্কারগুলিকে হেয় প্রতিপন্ন করবার একটা চেষ্টা প্রথম থেকেই চালিয়ে যেতেন স্টার্কও। পরের দিকে লেনার্ডের সঙ্গে মিলে আইনস্টাইনের মতো ইহুদি বিজ্ঞানীদের পেছনে লাগতে শুরু করেন। আর্য-বিজ্ঞানের মূল কথা হচ্ছে পরীক্ষার সাহায্যে সত্যিটাকে খুঁজে বের করা, সেখানে আইনস্টাইনের মতো ইহুদিরা ঠিক এর উলটো পথে হেঁটে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধার ধারছে না, আইনস্টাইন-বিরোধিতার এটাও ছিল একটা অজুহাত। 

আজ দেখতে দেখতে নব্বই বছর পেরিয়ে এসেছি আমরা সেই সব দিন থেকে। আইনস্টাইনের স্থান বিজ্ঞান জগতে কোথায় সেটা আমরা এখন দেখতেই পাচ্ছি। অথচ তাঁকে নস্যাৎ প্রতিপন্ন করতে চেয়ে যাঁরা সেদিন হিটলারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, তাঁদের কথা আজ জানতে হচ্ছে সেই আইনস্টাইনের জীবনের কথা আলোচনা করতে গিয়েই। আইনস্টাইন-রূপী বৃক্ষের গায়ে এখন তাঁরা পরজীবী হয়ে বাস করছেন, যে বৃক্ষকে একদিন এঁরা কেটে সমূলে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন। 

…………………………………… 


#Philipp Lenard #Johannes Stark #Albert Einstein

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

34

Unique Visitors

215002