স্বপ্নের উড়ান : ভারতের প্রথম মহিলা পাইলট সরলা ঠাকরাল
মাত্র ষোল বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল। ইচ্ছেটা তারপরেই অঙ্কুরিত হয়েছিল। লাহোরে শ্বশুরবাড়িতে এসে সরলা দেখেছিলেন, সে বাড়িতে অনেকেই বিমানচালক। স্বামী প্রেমদাস শর্মা ছাড়াও সে পরিবারে আরও আটজন ছিলেন পাইলট। তাই দেখে পাইলট হতে চেয়েছিলেন ষোড়শী সরলা। বিংশ শতাব্দীর তিনের দশক। ভারতীয় সমাজ তখন চূড়ান্ত রক্ষণশীল। দেশীয় মহিলাদের বাইরে যাতায়াতের ব্যাপারেই তখনও চোখরাঙানি। বিমানে ওঠার কথা তো দূরতম স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না তাঁরা। সেখানে বাড়ির বউ হবে কিনা পাইলট! শ্বাশুড়ি রেগে অগ্নিশর্মা। কিন্তু সরলার সৌভাগ্য, তিনি পাশে পেলেন তাঁর স্বামীকে। শ্বশুরকেও। দুজনের চেষ্টায় সরলা স্বপ্নপূরণের পথে প্রথম পদক্ষেপ নিতে পারলেন। বিমানচালনার প্রশিক্ষণ নিতে ভর্তি হলেন লাহোর ফ্লাইং ক্লাবে। আর তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৩৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লাহোর ফ্লাইং ক্লাবে রচিত হল এক ইতিহাস। শাড়ি পরে বিমানের ককপিটে একা বসলেন একুশ বছর বয়সী এক ভারতীয় তরুণী। দক্ষ হাতে সফলভাবে উড়িয়ে নিয়ে এসে নিরাপদে রানওয়ে ছোঁয়ালেন জিপসি মথ বিমানটিকে।
সরলা ঠাকরালই ভারতের প্রথম মহিলা পাইলট। জন্ম ১৯১৪ সালে দিল্লিতে। মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি বিমান চালনার লাইসেন্স পেয়েছিলেন। সে সময় তাঁর একটি চার বছর বয়সী শিশুকন্যাও ছিল। কেবলমাত্র শ্বাশুড়িই যে সরলার স্বপ্নপূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন, তা নয়। লাহোর ফ্লাইং ক্লাবের ইংরেজ ইন্সট্রাকটর মোটেই শাড়ি পরিহিত মহিলাকে ককপিটে বসতে দিতে রাজি ছিলেন না। অথচ শ্বাশুড়ির কড়া নির্দেশ, শাড়ি ছাড়া অন্য কোনও পোশাক পরা চলবে না। সরলা ও তাঁর স্বামী ক্যাপ্টেন শর্মার তীব্র ইচ্ছে দেখে তিনি শেষমেশ রাজি না হয়ে পারেন না। ১৯৩৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক রোববার অনেকের উপস্থিতিতে লাহোর ফ্লাইং ক্লাবে প্রথমবার সফল উড়ান শেষ করে অনেক প্রশ্ন, ভ্রূকুটির জবাব দিয়েছিলেন সরলা। লাহোর ফ্লাইং ক্লাবের মালিকানাধীন সেই বিমানটিকে সব মিলিয়ে মোট এক হাজার ঘণ্টা চালিয়েছিলেন তিনি।
তবে সরলার বাণিজ্যিক বিমানচালনার স্বপ্ন সফল হয়নি। ক্যাপ্টেন প্রেমদাস শর্মা ১৯৩৯ সালে একটি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপরেও বাণিজ্যিক পাইলট লাইসেন্সের প্রশিক্ষণ নেবার জন্য আবেদন করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সে সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং সিভিল পাইলট প্রশিক্ষণ স্থগিত করা হয়েছিল। এর আগেই তাঁর দ্বিতীয় কন্যাসন্তান জন্ম নিয়েছিল। সন্তানদের মানুষ করার জন্য এবং জীবিকা অর্জনের তাগিদে সরলা বাণিজ্যিক বৈমানিক হওয়ার স্বপ্ন ত্যাগ করে লাহোরে মেয়ো স্কুল অব আর্টে ভর্তি হন। এখানে তিনি ফাইন আর্টসের ডিপ্লোমা অর্জন করেছিলেন। দেশভাগের পর সরলা তার দুই কন্যাসন্তানকে নিয়ে দিল্লি চলে আসেন। দিল্লিতে তাঁর সঙ্গে আর. পি. ঠকরালের পরিচয় হয় এবং তাঁকে তিনি ১৯৪৮ সালে বিয়ে করেন। একজন সফল চিত্রকর হিসেবে সরলা ঠাকরাল পরিচিতি পেয়েছিলেন। তার পাশাপাশি তিনি পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকারের নকশার কাজ শুরু করেন। ডিজাইনিং ব্যবসাতেও সাফল্য পান। ২০০৮ সালের ১৫ মার্চ তাঁর মৃত্যু হয়।
নারীদের স্বাধীন ইচ্ছেটুকু প্রকাশের সুযোগটুকু যে সমাজে প্রায় ছিল না, সেখানে সরলা ঠাকরাল সারাজীবন নিজের ইচ্ছেয়, নিজের শর্তে দাপিয়ে বেঁচে গেছেন। শুধু বিমান চালানো না, তার পরবর্তী পর্বেও নিজের ইচ্ছেতেই চলেছেন আমৃত্যু। এই ডানাওয়ালা নারীকে যদি আমরা মনে না রাখি, সেটা অপরাধ নয়?
….…………………………..
ঋণ : উইকিপিডিয়া, www.beaninspirer.com
আরও পড়ুন:সি.ভি. রামন ও কমলা সোহনি : দ্বন্দ্বমূলক এক আখ্যান/ অর্পণ পাল