বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

ডঃ স্ট্রেঞ্জ, গুগল ও টাইম ক্রিস্টাল

সৌভিক সিনহা Aug 31, 2021 at 2:25 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

ওরে বাপরে! সে এক বিদঘুটে কুচ্ছিত দৈত্য ডরমামু। সে চিৎপুরিয়া যাত্রাপার্টি চোখফোখ রাঙিয়ে ডঃ স্ট্রেঞ্জকে ধমকাচ্ছে, “ওরে উজবুক তুই আমার সাথে লড়তে এইছিস? মরবি! তখন কে বাঁচাবে তোর গোল্লু পৃথিবীকে?” কথা মন্দ নয়, ডরমামুর আকার বিবেচনা করলে ওকথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ডঃ স্ট্রেঞ্জেরও কলজে আর মগজ, দুইয়েরই যথেষ্ট হাঁকডাক আছে এলাকায়। সেই বা কেন বিনা যুদ্ধে দিবে কণামাত্র ধরণী? একি মোয়া না মগের মুল্লুক? কিন্তু এই দৈত্যের সাথে লড়াইতে যে ঠিক এঁটে ওঠা যাবে না একথাও সত্যি। তবে উপায়? সে হারতে পারে, আবার হারতে পারে, বারবার হারতে পারে; অনন্তকাল ডঃ স্ট্রেঞ্জ কেবল হারতে পারে ডরমামুর কাছে। ডরমামু বারবার ডঃ স্ট্রেঞ্জকে মেরে ফেলে, সে আবার ফিরে আসে। আবার মারে, আবারও ফেরে। যতবার মারে, ততবার ফেরে। কী জ্বালা! ডঃ স্ট্রেঞ্জ সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলে, সে বারবার তার হেরে যাওয়ার আগের মুহূর্তে ফিরে এসে ডরমামুকে সময়ের মায়াজালে আটকে ফেলে। ডরমামু বারবার জিতলেও ওই জেতার মুহূর্তের বাইরে সে আর বেরোতে পারেনা। অগত্যা পৃথিবীর তল্লাট ছেড়ে, ডঃ স্ট্রেঞ্জের সময়ের জালে কাপড়ে-চোপোড়ে হয়ে সে বেল্লিক বিদায় নেয়। সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলে ডঃ স্ট্রেঞ্জ আধখাওয়া আপেলকে আবার গোটা করে দিতে পারে, নেভা আগুনকে পোড়া বারুদে জ্বালিয়ে দিতে পারে, হেরে যাওয়া হিরোদের আখরি মোকাবিলায় ফিরিয়ে আনতে পারে। কেমন হতো যদি এ ফিকশনে বাস্তবতার রোদ পড়ত? এ মায়াজাল ছুঁয়ে দেখার একটা খুঁটি থাকত?


নোবেলজয়ী পদার্থবিদ ফ্রাঙ্ক উইলজেক ২০১২ নাগাদ ‘টাইম ক্রিস্টাল’-এর কথা প্রথম বলেন। ক্রিস্টাল কী? বেশ কিছু কণার এক বিশেষ বিন্যাস যা নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর পুনরাবৃত্তি হয়। মানে এখানে পুনরাবৃত্তির মাঝে রয়েছে ‘দূরত্ব’। যদি ‘দূরত্ব’কে বদলে ফেলি ‘সময়’ দিয়ে? তখন কণার বিশেষ বিন্যাস পুনরাবৃত্তি হবে নির্দিষ্ট সময় অন্তর। মানে ‘আধখাওয়া’ আর ‘গোটা’ আপেল যদি দুটো বিন্যাস হয়, নির্দিষ্ট সময় অন্তর একবার ‘গোটা’ একবার ‘আধখাওয়া’, আবার ‘গোটা’ আবার ‘আধখাওয়া’ আপেলের এই পুনরাবৃত্তি চলতে থাকবে। একেই বলে  ‘টাইম ক্রিস্টাল’। তবে কেবল ‘পুনরাবৃত্তি’ হলেই যে টাইম ক্রিস্টাল হবে তা কিন্তু নয়, সে তো ঘড়ির কাঁটার অবস্থানেরও পুনরাবৃত্তি হয়। কিন্তু ব্যাটারি ফুরোলেই টিকটক খতম। তাই টাইম ক্রিস্টালের এক অমোঘ শর্ত হল কোনও ব্যাটারি-ফ্যাটারি ছাড়াই গ্রিনপ্লাই প্লাইউডের মতো ‘চলতা রহে, চলতা রহে’। মানে বাহ্যিক শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন ব্যতিরেকে যদি বিন্যাসের পুনরাবৃত্তি হয় তবেই তা টাইম ক্রিস্টাল। কিন্তু গড়বড়ও এখানেই। কারণ এর অর্থ – টাইম ক্রিস্টাল গড়তে হলে ভাঙতে হবে ‘টাইম ট্রান্সলেশন সিমেট্রি’ – মানে স্থায়ী কোনও বস্তু চিরকাল তার একই আকার-বিকার বজায় রাখবে এহেন নিয়ম। নিউটন সাহেবও তেমনই বলেছিলেন, বাইরে থেকে খুব হুজ্জুতি না করলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির আর অস্থির মন অস্থির থেকে যাবে। তাহলে টাইম ক্রিস্টাল কী? স্থির না অস্থির? স্থায়ী না অস্থায়ী? এখানেই মজা, ধারণাগতভাবে টাইম ক্রিস্টাল ভীষণ স্থায়ী একটি পদার্থ যা ধারাবাহিক আকার পরিবর্তনের মধ্যেও তার স্থায়িত্ব বজায় রাখতে পারে। তত্ত্বগতভাবে এ ভীষণ জটিল আর অদ্ভুতুড়ে একটা বস্তু।

২০১৫ সালে একদল পদার্থবিদ প্রথম খাতায়-কলমে প্রমাণ করেন যে উইলজে‌কের টাইম ক্রিস্টালের অস্তিত্ব নেহাত আজগুবি নয়, এমন ম্যাজিকাল মায়াজালটি বানানো সম্ভব। তারপর থেকে গত পাঁচ বছরে অনেকেই টাইম ক্রিস্টাল বানিয়ে ফেলার দাবি করলেও তা কখনওই পুরোপুরি সাফল্য পায়নি। ২০১৯ সালে গুগল জানায় যে তাদের স্যকামোর কোয়ান্টাম কম্প্যুটার এক জটিল অঙ্ক কষে ফেলেছে মাত্র ২০০ সেকেন্ডে, যা সাধারণ কম্প্যুটারের কষতে সময় লাগবে ১০,০০০ বছর। এ খবর পড়ে ২০১৫-এর সেই গবেষকদল গুগলের সাথে যোগাযোগ করে তাদের কোয়ান্টাম কম্প্যুটারের সাহায্য চায় ‘টাইম ক্রিস্টাল’ গবেষণায়। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্প্যুটার কেন? খুব সহজ করে বললে কচি ল্যাপটপ থেকে জাঁদরেল সুপার কম্প্যুটার যেখানে ‘বিটস্‌’-এর মাধ্যমে সমস্ত জটিল-কুটিল হিসেব কষে, কোয়ান্টাম কম্প্যুটার তা কষে ‘কিউবিটস্‌’-এর হিসেবে। বিট এর মান ‘০’ অথবা ‘১’ হতে পারে, আর কিউবিট ‘০’ এবং ‘১’ হতে পারে একসাথে, একই মুহূর্তে। অর্থাৎ অনেকগুলো কিউবিটকে একসাথে কোনও কাজ দিলে, ডঃ স্ট্রেঞ্জের মতো চোখ বুজে কোটিখানেক সম্ভাব্য সমাধান চট করে কষে ফেলতে পারে। কঠিন হিসেব সহজে কষে ফেলার এই সুবিধাই ‘টাইম ক্রিস্টাল’ গবেষণার জন্য এক্কেবারে আদর্শ ব্যবস্থা! আর সেই সম্ভাবনারই সুফলরূপে, গত ২৮শে জুলাই একটি গবেষণাপত্রে প্রকাশ পায় যে গুগলের কোয়ান্টাম কম্প্যুটার টাইম ক্রিস্টালের প্রথম নিশ্চিত অস্তিত্বের সন্ধান পেয়েছে। মানে ‘আধখাওয়া’ আর ‘গোটা’ আপেল, মানে ‘ডঃ স্ট্রেঞ্জ’, মানে বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার এক আশ্চর্য কল্পনাতীত সাফল্য। 

কিন্তু এই গবেষণায় আমাদের ফায়দা কী? না থাকলে আর এত ভণিতায় কোন মধুভান্ড উদ্ধার হল! যে কোয়ান্টাম কম্প্যুটার ব্যবহার করে এ সাফল্য এল, ফায়দা আসলে তারই, আর তার হাত ধরে মানবজাতির। আসলে, সাধারণ কম্প্যুটারের পক্ষে অসাধ্য বা মানবসভ্যতার কয়েক শতক সময় লাগবে এমন সমস্ত কঠিন ও জটিল সমস্যার সমাধান কোয়ান্টাম কম্প্যুটার নিমেষেই করতে পারে। যেকোনও ‘কম্বিনেটরিক্স’ ঘরানার গণনা করতে সাধারণ কম্প্যুটারের অসাধারণ বেশি সময় লাগে। এই ধরনের গণনায় মূলত নির্দিষ্ট সংখ্যক বস্তুকে বিভিন্ন ক্রম বা জুটিতে সাজানোর সম্ভাব্যতা বিচার করা হয়, যেমন – দাবার ঘুঁটিগুলো কোন বিশেষ বিন্যাসে সাজালে কালো-পক্ষের জয় ও সাদাকে হেরোপার্টি নিশ্চিত করা যাবে। স্বাভাবিকভাবেই, ঘুঁটির সংখ্যা বা রঙের প্রকার বাড়লে, হিসেবের জটিলতাও বহুগুণ বেড়ে যায়। আজকের জমানায় আমার ডিজিটাল মাধ্যমের সাইবার সিকিউরিটি থেকে শুরু করে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, নতুন ড্রাগের আবিষ্কার থেকে শুরু করে আপনার শেয়ার বাজারের ফাটকা, সবেতেই ‘কম্বিনেটরিক্স’ গোছের গণনার ছড়াছড়ি। কোয়ান্টাম কম্প্যুটারের সাহায্যে এইসব কঠিন অঙ্কের দ্রুত সমাধান করে ফেলা সম্ভব। এতে রাজনৈতিক হিংসা থেকে দুষ্টু ভাইরাসের ন্যাংটা নাচ, আর্থিক বাজারের ছেঁকা থেকে থ্যানোসকে বেঁধে পেটানোর উপায়, সবই অনেক আগে কষে-বুঝে ফেলা যাবে। কিন্তু ঝামেলা হল এই কোয়ান্টাম কম্প্যুটার থেকে পাওয়া তথ্যের সঠিক মর্ম উদ্ধার। কারণটা আগেই বলেছি, কিউবিট যেহেতু কোয়ান্টাম সূত্র মেনে চলে তাই একই সঙ্গে একাধিক অবস্থানে থাকতে পারে। তাই যখন কিউবিট থেকে সরাসরি কিছু গণনা করা হয় তখনকার কিউবিটের চরিত্রের সঙ্গে গণনা না-করার সময়ের চরিত্রের আকাশপাতাল পার্থক্য। চোখের সামনে যা ধরা পড়ে, চোখের আড়ালে তার চালচলন ভিন্ন। স্বাভাবিকভাবেই, যেকোনও ফলাফল আদপে সঠিক কিনা তা নিশ্চিত করা দুষ্কর ও সময়সাপেক্ষ। শুধু তাই নয়, এমন অদ্ভুতুড়ে মাল্টি-পার্সোনালিটির জন্যই কোয়ান্টাম কম্প্যুটার বানানো ও তার পরিচর্যা গুগল, IBM এর মতো দানব সংস্থা ছাড়া সম্ভব নয়। এই মাল্টি-পার্সোনালিটির দাওয়াই হল টাইম ক্রিস্টাল। এর ফলে কোয়ান্টাম কম্প্যুটার নির্ভর গণনার বাস্তব প্রয়োজনভিত্তিক রূপায়ন নিশ্চিতভাবে সম্ভব, যা এতদিন কেবল সম্ভাবনা ছিল। 

যদিও এই সদ্য-আবিষ্কার নেহাতই পুঁচকে এক পদক্ষেপ, তবে ভবিষ্যতের নিরিখে এ এক দানবীয় লম্ফ। হয়তো আরও কয়েক দশক লাগবে টাইম ক্রিস্টাল নির্ভর কোয়ান্টাম কম্প্যুটার তৈরি করতে, বা কেবল টাইম ক্রিস্টালকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে। কিন্তু এই সাফল্য যখন আসবে, তখন হয়ত ক্যান্সারের সবচেয়ে প্রভাবশালী দাওয়াই এর খোঁজ মিলবে বা বিনা ধরণীসম্পদের অপচয়ে জুটবে বাড়িতে বাড়িতে বিদ্যুৎ। ডঃ স্ট্রেঞ্জ ক্রমশ আসিতেছেন। করোনা যদি তদ্দিনে নাও ভেগে পড়ে, বুঝে নেব তবে! 

মানবজাতের আস্তিনে আরও এক পাট ভাঁজ পড়ল, সগর্বে।   


কৌতূহলী পাঠকের জন্য :  Eternal Change for No Energy: A Time Crystal Finally Made Real 


.....................................................................................................................

প্রচ্ছদ ঋণ : ইন্টারনেট 

.....................................................................................................................


#টাইম ক্রিস্টাল # গুগল # কোয়ান্টাম কম্পিউটার # সুপার কম্পিউটার #ডঃ স্ট্রেঞ্জ # মার্ভেল # বিজ্ঞান # গবেষণা # সৌভিক সিনহা # সিলি পয়েন্ট # বাংলা পোর্টাল # ওয়েবজিন #web portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

36

Unique Visitors

219179