প্রলাপ (প্রথম কিস্তি)
[১]
পাশাপাশি দুটো মানুষ বসে রং করছে। একজন পাতা ভর্তি করে লাল নীল হলুদ সবুজে গোল গোল আঁকছে আর সবকটাকেই বলছে সূর্য। আর একজন গোল, চৌকো, তিনকোনা আকারের নকশা কেটে যাচ্ছে। দুজনার বয়সের অনেক ফারাক। কে বড়ো কে ছোটো বলব না। তাহলে তো হিসেবটা মিলিয়ে নিতে সকলের সুবিধা হয়ে যাবে! একজনের সূর্য রং পাল্টায়, মুখ পাল্টায়, হাসি পাল্টায়। আরেকজনের নকশা কোনোটা মেলে কোনোটা অর্ধেক হয়ে পরে থাকে। একজন ভাবছে সূর্যটাকে ধরে রাখতে পারলেই সব উজ্জ্বল হয়ে যাবে। আরেকজন ভাবে নকশা মিলে গেলেও বেঁকে যাওয়া রঙের দাগ আর কখনও সোজা হবে না।
দুজন পাশাপাশি বসে রং করছে। ওদের পাশে আরও একজন বসে আছে। কিন্তু সে ছবি আঁকছে না। সে ভালো ছবি আঁকতে পারে না। পরীক্ষার খাতায় ১০-এ ৪/৫ পাওয়ার মত এঁকে ফেলতে পারে মাত্র, তবে রং করতে ভালোবাসে। হাত পা ছড়িয়ে বসে সারা ঘর জুড়ে রং করে ফেলতে পারলে তার প্রাণ জুড়োয়। তবুও সে ওদের থেকে একটাও রং চেয়ে নিতে পারছে না। খালি ভাবছে ওদের ভাগে কম পরে যাবে। দু-একবার ভেবেও ফেলছে ওরা অন্যমনস্ক হলেই তুলে নেবে একটা-দুটো ভাঙা রং। সেই ভাঙা রং জমাতে জমাতে একটা গোটা পাহাড় তৈরি হবে আর তারপর ঐ পাহাড়ে বেড়াতে যাবে ওরা তিনজনায়।
সেইখানে গিয়ে যে সূর্য আঁকছিল সে দেখবে সূর্যের সত্যিই অনেকগুলো রং - অনেকরকম হাসি। যে নকশা কেটেছিল সে দেখবে বেঁকেতেড়ে রং করলেও নকশা ঠিক মিলে যায় দিগন্তে। আর যে রং চুরি করেছিল সে ওদের দুজনের সব হিসেব মিলে যেতে দেখে ভাববে, এর চেয়ে বুঝি এক মনে নিষ্পলকে ওদের রং করা দেখে গেলেই ভালো হত।
[২]
পাথরের প্রকারভেদ পড়তে হয়েছিল ইস্কুলে। কতরকমের শিলা হয়, কার কেমন আচার-ব্যবহার - ভূগোলের পরীক্ষার জন্য সব পড়েছিলাম সেই সময়। সেই দুলে দুলে মুখস্থ করা জ্ঞানের ঝুলি যে কখন ফুটো হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। এক-কণা দু-কণা করে সব ফেলতে ফেলতে অনেকটা পথ হাঁটা হয়ে গেল। এখন আবার পিছন ফিরে কুড়োতে গেলে সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয়। তাই একেবারে নতুন করে শুরু করি। এককুচি ধুলো, দু-চারটে বালির কণা, ইয়াব্বড়ো একটা গোলাপি রঙের কী জানি কী একটা পাথর - যা পাই ঝোলায় পুরি। ঝোলাটা খুব পোক্ত করে সেলাই করেছি, পাছে এদিক থেকে কুড়োই আর ওদিক থেকে হারাই। একটু একটু করে ঝোলা ভরে ওঠে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে ভাবনার গাড়ি স্টেশনের পর স্টেশন পার হয়ে যায়। একখানা পাথর হাতে নিয়ে মনে পরে গেল একজনাকে। বুকের ভিতর উত্তাপ চাপতে চাপতে সে হয়ে উঠেছে আগুন পাথরের মত, অসম্ভব কঠিন। তেমন কোনও সাংঘাতিক কষ্ট পাওয়ার মত কিছুই হয়নি তার জীবনে। মানে সমাজের মাপকাঠিতে বিশাল কোনো ঘটনার ঘনঘটা নেই আর কী! ঐ ছোটো থেকে আঁকা নাচ গান কিছুই শেখা হলো না কোনওদিন, পছন্দের কাজ ছেড়ে চাকরি করতে হল কারণ কাঁধের দায়িত্বটা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে সবার কাছে, পোষা বেড়ালটা গাড়ির তলায় চাপা পড়ে গেল, বন্ধুরা সব অনেকদূরে এগিয়ে গেল। আর যাকে ভালোবেসেছিল খুব, সে একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করে বসল মানুষটা ভীষণ ছাপোষা। আর কী! এই সবই। কিন্তু এই ছোটো ছোটো নগণ্য সব ফুলকিই বুকের ভিতর চাপতে চাপতেই ওর সবটা হয়ে গেল কঠিন, ভীষণ কঠিন। এখন আর ওকে সহজে দুঃখ দেওয়া যায় না। বাইরে থেকে দেখলে ওর ক্ষয় নেই একটুও। আর অন্তরের কথা? কী হবে তা জেনে?
আরেকটা পাথরের রঙ দেখে আর একজনের কথা মনে পড়ল। তার জীবনটা আবার আগাগোড়াই তালে তালে মাপা। আর পাঁচটা ছেলেবেলা যেমন হয়, তেমনই। তালের সঙ্গে সুর, লয় সব ছিল। ভালোবাসার মানুষটা হাত ধরেছিল ভীষণ শক্তিতে। কিন্তু একদিন কেউ যা ভাবেনি তাই হল। ছোটো চারা থেকে নিজে হাতে লালন পালন করে বাড়িয়ে তুলেছিল একটা গাছকে, একদিন একখন্ড উল্কাপিন্ড বিদ্যুৎবেগে এসে উপড়ে দিল সেটাকে। আর তারপর থেকেই সব পাল্টে গেল। ঐ ধাক্কা ওকে ভাঙতে শুরু করল। রোজই ভাঙছে একটু একটু করে। এ ভাঙন থামায় সাধ্য কার!
রোজ রোজ, হাঁটতে হাঁটতে, দৌড়াতে দৌড়াতে এমন কত মানুষের সাথেই না ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যায়। কেউ ভাঙছে, কেউ গড়ছে, কেউ চাপে আর তাপে নিজেকে পাল্টে নিচ্ছে। কারোর মনের ভিতরটা খুঁড়লে পাওয়া যাবে সেই কবেকার ছোট্ট একটুকরো মুহূর্তের জীবাশ্ম। কেউ কেউ নিজেকে একটুও পাল্টাতে পারে না। অনড়, কঠিন, শীতল হয়ে যুগের পর যুগ পরে থাকে পাহাড়ের খাদে। কেউ নিজেকে এতটাই দামি করে তুলতে পারে যে অন্ধকার গহ্বর ছেড়ে উঠে আসে হাতের আঙুলে কিংবা জড়িয়ে ধরতে পারে গলা। কারোর অবস্থা অবিকল রাস্তার নুড়িপাথরটার মত। শুধু ধুলোবালি জমে, পায়ে পায়ে ঠোকর খেতে খেতে জীবন কেটে যায়। আর কেউ নিজেকে পাল্টে নিতে পারে সময় বুঝে। তাতে পায়ের তলা থেকে একেবারে মাথায় উঠতে না পারলেও রঙিন মাছেদের জলের ঘরে জায়গা অন্তত করে নেওয়া যায়। যেতে আসতে একটিবার হলেও তো নজর কাড়ে তারা।
এই তো, এইসবই। আবার নতুন করে শিখছি, জানছি, বুঝছি। কাঁধের ঝোলাটা ভারী হচ্ছে। অল্প অল্প করে প্রতিদিন আরেকটু ভারী হচ্ছে। সস্তা-দামি-নিটোল-ভাঙাচোরা পাথরে। আরো ভারী হোক। যেদিন মনে হবে এইবার আবার সেলাই ছিঁড়ে যেতে পারে, তখন বেছে বেছে খালি করব অল্প। নুড়িগুলোকে রেখে দেব শুধু, বাকিদের কোনো এক রাস্তার ধারে সাজিয়ে রেখে আসব। ওদের মূল্য বুঝে সযত্নে নিয়ে যাবে এরা বা ওরা। নুড়িগুলো নাহয় আমার ঝোলাতেই থেকে যাবে। দাম না পাক, নিরাপদ আশ্রয়টুকু যদি দিতে পারি।
[চলবে]
..............................
অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র