কলকাতায় সাইকেল-আগমন ও জগদীশচন্দ্র
ভোরবেলার গড়ের মাঠ। অল্প অল্প ঠাণ্ডা হাওয়া হচ্ছে, পরিবেশ খুবই মনোরম। এত সকালে এখানে লোকসমাগম নেই বিশেষ, তাই খুব বেশি কেউ দেখতে পাচ্ছেন না যে তিন যুবক মাঠের মধ্যে অদ্ভুতদর্শন এক জিনিসে চেপে চক্কর কাটছেন অনেকক্ষণ ধরেই। চেহারা-পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে যে এঁরা বাঙালি। কিন্তু এত সকালে ওঁরা মর্নিং ওয়াক না করে কেন এক বিশেষ যানে চেপে ঘুরছেন? আসলে ওই যানটির সঙ্গে কলকাতার পরিচয় গড়ে উঠেছে হালেই। তবে এই তিন যুবকের পরিচয় দেওয়ার আগে কলকাতায় সদ্য-আগত ওই যানটির ব্যাপারে কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার।
যানটির নাম সাইকেল। তবে এখন আমরা সাইকেল বলতে যে জিনিসটিকে চিনি, তার সঙ্গে এই যানের প্রভেদ অনেক। আধুনিক যে দুই-চাকাযুক্ত চেহারার সঙ্গে আমরা অভ্যস্ত, সেটা ইউরোপের বাজারে আসে ১৮৮৫-৮৬ সালের দিকে। তবে এর কয়েক বছর আগে থেকেই ব্রিটিশদের দৌলতে কলকাতায় তথা ভারতে আসতে শুরু করেছিল নানা আদি-রূপের সাইকেল। এইসব সাইকেলের পূর্বপুরুষ যে, তার নাম ‘ভেলোসিপেড’। তাতে ছিল না কোনো চেন বা প্যাডেল। সিট-এ চেপে পা দিয়ে মাটিতে ঠেলা দিলে তবে সে সাইকেল এগোত। ওইভাবেই কত মানুষ রাস্তা দিয়ে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এগিয়ে যেতেন; তবু ও সাইকেল মানুষের হৃদয় হরণ করতে পারেনি কারণ ওর চাকায় এখনকার মতো ছিল না কোনো বাতাসভর্তি টিউব, স্রেফ নিরেট রবারের তৈরি টায়ারের ওপর ভর করে চালাতে হত বলে ও সাইকেলে চেপে সহজে চলাই ছিল দুষ্কর। পরে যখন বাতাস ভর্তি টিউব প্রচলিত হল, তখন আবার আর এক সমস্যা। কলকাতার রাস্তায় তখন চলতে-ফিরতে ঘোড়ার নাল, নানা ধরনের পেরেক, ফলে সাইকেল প্রায়ই যেত পাংচার হয়ে। আরও আশ্চর্যের, ওই আমলে কলকাতায় পাংচার হয়ে যাওয়া টিউব সারানোর ব্যবস্থা ছিল গোটা কলকাতায় মাত্র একটা জায়গাতেই— গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের একজন বিদেশি রাঁধুনি সারাতেন, তিনি আবার লিক পিছু সারাবার মজুরি নিতেন ‘মাত্র’ পাঁচ টাকা! একটা লিক সারাতেই যদি একজন সাধারণ কর্মচারীর মাস মাইনের চার ভাগের এক ভাগ খরচ হয়ে যায়, কে সখ করে সাইকেল কিনতে যাবে?
কলকাতায় মূলত সাহেবদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল ‘পেনি-ফার্দিং’ নামে এক ধরনের সাইকেল। এর সামনের চাকাটি পেছনের চাকার আকারের তুলনায় প্রায় চার গুণ বড়, তাই এইরকম নাম। ‘পেনি-ফার্দিং’-এর পরের ধাপে আসে তিন চাকা-বিশিষ্ট সাইকেল বা ট্রাই-সাইকেল। সে যান বঙ্গদেশে আসে ১৮৬৭-৬৮ সাল নাগাদ। বর্ধমানের মহারাজা প্রথম কিনেছিলেন সেই সাইকেল, সে খবর প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদপত্রের পাতাতেও। কলকাতায় ওইরকম তিন চাকার সাইকেলে চেপে প্রকাশ্যে ঘুরতে বেরিয়ে বেশ শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ। তিনি রোজ সকালে গায়ে পুরোদস্তুর চোগাচাপকান আর মাথায় পাগড়ি বেঁধে একটা সাইকেলে চেপে জোড়াসাঁকো থেকে যেতেন চৌরঙ্গী পেরিয়ে পার্ক স্ট্রিটে, বাবার সঙ্গে দেখা করতে। শহরবাসী অবাক হয়ে দেখত আত্মভোলা এই ধাবমান মানুষটিকে।
এরপরে কলকাতায় আসে আরও কয়েক ধরনের সাইকেল। ১৮৯৭ সালের দিকে সাঁতরাগাছির এক ব্যক্তি প্রসন্নকুমার ঘোষ বিস্তর বুদ্ধি খাটিয়ে তৈরি করেন এমন এক ট্রাই-সাইকেল, যাতে বসতে পারত তিনজন। সামনে একজন আর পিছনে দু-জন বসে পা দিয়ে চাকা ঘোরালে সে সাইকেল বেশ চলত। এই ধরনের সাইকেলকে বলা হত ‘ট্যান্ডেম’, অনেকে মনে করেন ভারতে প্রথম এই ধরনের সাইকেল তৈরির কৃতিত্ব ওই প্রসন্নকুমারেরই প্রাপ্য।
পরের দিকে প্যাডেল-লাগানো সাইকেলও এ দেশে আসে। এরকম সাইকেলে চেপে রাস্তায় বেরোতে শুরু করেন বেশ কয়েকজন শহরবাসী। তবে তাঁদেরও প্রায় সকলেই ছিলেন ইংরেজসমাজের মানুষ। তখন তাঁদের উদ্যোগে কলকাতায় বেঙ্গল সাইক্লিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অবধি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল উনিশ শতকের শেষ দিকেই।
২/
সাল ১৮৮৯। জগদীশচন্দ্র তখন সস্ত্রীক থাকেন মেছুয়াবাজারে এক তলা একটি বাড়িতে। এই বাড়ির সামনে বাগান, একদিকে খেলার মাঠ আর পুকুর।
এখানেই কাছাকছি থাকেন ডাক্তার নীলরতন সরকারও। তিনিও ততদিনে এমবি ডিগ্রি পেয়ে গিয়েছেন।
বিয়েও করেছেন সম্প্রতি, ব্রাহ্মসমাজের নেতা গিরিশচন্দ্র মজুমদারের কন্যা নির্মলা দেবীকে। আরও একজন থাকেন কাছেই। তিনিও বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছেন সম্প্রতি, এখনও অধ্যাপনা-জগতে প্রবেশ করেননি। প্রায় রোজই তিনি আসেন জগদীশচন্দ্রের বাসায়, এখানেই খাওয়াদাওয়া সেরে ফেরেন। তিনি প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
আত্মচরিত-এ লিখেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র: ‘১৮৮৮ সালের আগস্ট হইতে ১৮৮৯ সালের জুনের শেষ পর্যন্ত আমার কোন কাজ ছিল না। ঐ সময় আমার বড় অস্বস্তি বোধ হইয়াছিল। আমি টনীকে বলিয়াছিলাম স্যামসনের চুলের অভাবে যে দশা হইয়াছিল, লেবরেটরি না থাকিলে রসায়নবিদেরও ঠিক সেই দশা হয়, তাহার কোনই ক্ষমতা থাকে না এই সময়ে আমি প্রায়ই ডাঃ জগদীশচন্দ্র বসু এবং তাহার পত্নীর আতিথ্য গ্রহণ করিতাম।’
আর এটাই সেই সময় যখন এক-একদিন ভোরের দিকে মেছুয়াবাজারে চলে আসতেন হেমেন্দ্রমোহন বোস। মামা জগদীশচন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন গড়ের মাঠের দিকে। ওই সময়ে মাঠে বিশেষ লোক সমাগম হয় না, সাইকেল শিক্ষার পক্ষে প্রশস্ত সময়। সঙ্গে থাকেন প্রফুল্লচন্দ্র, তাঁর অতটা উৎসাহ নেই সাইকেল চালাবার ব্যাপারে, তিনি দর্শক হিসেবেই খুশি। জগদীশচন্দ্র যখন সাইকেলে চেপে এগিয়ে যায়, সতর্ক প্রফুল্লচন্দ্র সেদিকে কড়া নজর রাখেন যাতে তিনি সাইকেলভ্রষ্ট না হয়ে পড়েন। মাঝেমধ্যে আসতেন নীলরতন সরকারও।
সাইকেল সম্বন্ধে কী ভাবতেন জগদীশচন্দ্র? সে প্রমাণও এসেছে আমাদের হাতে। ‘দেশ’ পত্রিকার ১৯৮১ সালের ২২ আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত তার একটি লেখায় পাই:
‘…যে জিনিসটাকে এক মুহূর্ত খাড়া রাখা যায় না একজন মানুষ তাহার উপর উঠিয়া বায়ুবেগে গমন করিতেছে ইহাতে লোকের কৌতূহল হইবার কথা নয়ত কি? অল্পদিন হইল এ দেশে বাইসিকেল প্রচলিত হইয়াছে তাহাতেই এত লোকের সখ হইয়াছে। বিলাতে তা হইলে ব্যাপারখানা কি তা বোঝা কঠিন হইবে না। সে দেশে বাইসিকেলের এত ব্যবহার যে বিলাতে ও আমেরিকাতে কোটী-কোটী টাকার কারবার চলিতেছে। পৃথিবীর মধ্যে আর কোন জিনিসের এত কারবার নাই। … কেবল সখ ছাড়া ইহাতে কাজের অনেক সুবিধা হয়। বিলাতে অনেক রকম কাজে বাইসিকেল ব্যবহার হয়। … ডাকপিয়নেরা বাইসিকেলে চড়িয়া চিঠি বিলি করে, দাসীরা বাজার করিয়া আনে। এইরূপ বাইসিকেলে লোকের কত সুবিধা করিয়া দিয়াছে। আমাদের দেশেও… অফিসে লোকেরা বাইসিকেলে চড়িয়া তাড়াতাড়ি কাজ সারিয়া আসে। …আজকাল বাইসিকেল আমাদের পুষ্পক রথ।’ [আমি এই উদ্ধৃতিটি নিয়েছি সূত্র ১ থেকে]
জগদীশচন্দ্রের আর এক ভাগ্নে দেবেন্দ্রমোহন বসুর লেখা থেকে জানা যায় জগদীশচন্দ্রের বাসার সামনের ছোট্ট একটু গলির মধ্যে এর কয়েক বছর পর ইউরোপ যাওয়ার আগে সাইকেল চালানো শিখে নেন অবলা বসু এবং নির্মলা দেবীও। তাঁদেরকে শেখাবার কাজে মূল উদ্যোগ নিয়েছিলেন হেমেন্দ্রমোহনই।
অন্যদিকে আরও হরেক ব্যবসার মতোই এই সাইকেল তৈরি আর বিক্রির ব্যবসাতেও এগিয়ে এসেছিলেন সেই হেমেন্দ্রমোহনই। উনিশ শতকের শেষ দিকে হেমেন্দ্রমোহন শুরু করেন সাইকেলের ব্যবসা। বাঙালিদের মধ্যে তিনিই প্রথম সাইকেল বিক্রির দোকান খুলেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন ‘এইচ বোস সাইকেল কোম্পানী’। ব্যবসার পার্টনার হিসেবে নিলেন ভাই যতীন্দ্রমোহনকে। তাঁদের এই দোকানটি তৈরি হয় হ্যারিসন রোডে (এখনকার এমজি রোড) প্রেসিডেন্সি কলেজের কাছে। দোকানের পিছনে গড়ে উঠেছিল সাইকেল তৈরির কারখানাও। বিলেত থেকে ‘রোভার’ আর ডারকাপ সাইকেল বিক্রির একমাত্র অধিকার অর্জন করেছিলেন এঁরাই।
আরও পড়ুন : সমকাল ও জগদীশচন্দ্র : প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ / অর্পণ পাল
কলকাতায় সাইকেল নামক দ্বিচক্রযানটির আবির্ভাবের পর যে বিশিষ্ট বাঙালিরা একে আপন করে নিয়েছিলেন, সেই তালিকায় প্রথম নামটি অবশ্যই জগদীশচন্দ্র বসুর। যিনি এক কালে গড়ের মাঠে সাইকেল চালিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন; তিনিই কয়েক বছর পরে ইউরোপ-অভিযান সেরে আসবার পর হয়ে ওঠেন সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী। বাঙালির সাইকেল-যাত্রার সঙ্গে তাই জগদীশচন্দ্রের নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গিয়েছে।
……………………………………
বইপত্র :
1/ কলের শহর কলকাতা, সিদ্ধার্থ ঘোষ, আনন্দ, ১৯৯১।
2/ বাংলার কলকারখানা ও কারিগরিবিদ্যার ইতিহাস সমগ্র, জিতেন্দ্রনাথ রায়, রাজকৃষ্ণ পুস্তকালয়, ২০১০।