নিবন্ধ

মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস: রবীন্দ্র-প্রতিবাদের ধরন-ধারণ

সরোজ দরবার May 9, 2021 at 10:11 am নিবন্ধ

রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট প্রবণতা যখন স্পষ্টতর হচ্ছে, আমরা বেশি করে আঁকড়ে ধরছি রবীন্দ্রনাথকে। আমরা, অর্থাৎ, দেশের সাধারণ মানুষ। এ-কথা অনস্বীকার্য যে, এই সংকটের দিনে আমাদের সামনে অনুসরণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতায় যিনি সবথেকে এগিয়ে তিনি কোনও রাজনীতিবিদ নন, প্রধানত কবি। প্রচ্ছন্ন রাষ্ট্রীয় অনুমোদনে যখন গোষ্ঠীবিদ্বেষের ছাইচাপা আগুন সংঘর্ষের দাবানল হয়ে ওঠে, যেমনটা আমরা দেখেছি সম্প্রতি বেশ কয়েকবার, তখন আমাদের আশ্রয় হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ। আর-কিছু না হোক, জাতীয় সংগীত অবলম্বন করে আমরা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি, রাষ্ট্রের গুলি-বন্দুক-লাঠি-সোঁটার বাইরেই এখনও আছে গণমানুষের দেশ। এইখানেই আমাদের পথের সাথি হয়ে যান রবীন্দ্রনাথ।

দেশের এই ব্যাপ্ত মানবিক ধারণা, ভাবলে অবাকই হতে হয়, আমাদের কাছে যত না পৌঁছে দিতে পেরেছেন আমাদের অগ্রগণ্য রাজনীতিবিদরা, সন্দেহাতীতভাবে তার থেকে বেশি পেরেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই, দেশ নিয়ে আমাদের উচ্চারণ, আমাদের ভাবনা, আমাদের সমবেত প্রতিবাদে অনিবার্য থেকে যান রবীন্দ্রনাথ। তিনি শুধু বহুমুখে উদ্ধৃত হয়ে আমাদের বলবার কথা জোগান তাই তো নয়, তিনি আমাদের রসদ জোগান ভাবনার। যে-ভাবনায় সংকটের মোকাবিলা করা সম্ভব। বিপদে ভয় না-পাওয়া সম্ভব। রাষ্ট্রীয় বহুবিধ আক্রমণের মুখে প্রচলিত পদ্ধতির প্রতিরোধের ব্যর্থতায় মুখ থুবড়ে পড়ার আগে, একরকমের পলায়নবৃত্তি থেকে আমাদের উদ্ধার করে তুলে ফের দাঁড় করিয়ে দিয়ে যান রবীন্দ্রনাথ। কেন তিনি আমাদের দাঁড়াবার সাহস হয়ে ওঠেন, সেই দিকটি নিয়ে আলোচকরা কম আলোচনা করেননি। তবু সময় যখন অন্ধকার ঘনীভূত করে আমাদের বারেবারে আলোর কাছে ফিরতেই হয়। আমরা তাই আরও একবার খুঁটিয়ে দেখতে পারি সেই আলোটিকে।

‘ওরে ভীতু, মার এড়াবার জন্য তোরা হয় মরতে নয় পালাতে থাকিস, দুটো একই কথা। দুটোতেই পশুর দলে ভেড়ায়, পশুপতির দেখা মেলে না’ – ধনঞ্জয় বৈরাগীর এই কথাখানা রবীন্দ্রনাথের সমস্ত প্রতিবাদের একটা সার কথা হয়ে থাকে। আমাদের তো ধনঞ্জয়কে দেখে বিস্ময়ই জাগে। মারের মুখের উপর কেমন অবলীলায় কথা শুনিয়ে দিতে পারে সে। রণজিৎ জিজ্ঞেস করল– ‘তুমি এই সমস্ত প্রজাদের খেপিয়েছ?’, ধনঞ্জয়ের দ্বিধাহীন উত্তর, ‘খ্যাপাই বৈকি, নিজেও খেপি।’ রাজার উদ্দেশে সটান সে বলতে পারে, ‘ভুল করছ এই, যে, ভাবছ জগৎটাকে কেড়ে নিলেই জগৎ তোমার হল। ছেড়ে রাখলেই যাকে পাও, মুঠোর মধ্যে চাপতে গেলেই দেখবে সে ফসকে গেছে।’ এই যে রাজার মুখের উপর তার ভুলটাকে দ্ব্যর্থহীন বলে দেওয়া, আমরা কে না জানি, কাজটা মোটেও সহজ নয়। কেন-না রাজার রোষে পড়ার সম্ভাবনা সেখানে ষোলো আনা। তবু, রবীন্দ্রনাথের কিশোর মারের মুখের উপর দিয়েই ফুল এনে দেবে নন্দিনীকে। এমনকি, নন্দিনী যেভাবে রাজার সঙ্গে কথা বলে, তা-ও বিস্ময়কর। এই অংশটুকুই দেখা যাক – নেপথ্যে – মিছিমিছি ভয়? জান না, আমি ভয়ংকর? নন্দিনী – হঠাৎ তোমার এ কী ভাব! লোকে তোমাকে ভয় করে এইটেই দেখতে ভালোবাস? আমাদের গাঁইয়ের শ্রীকণ্ঠ যাত্রার রাক্ষস সাজে– সে যখন আসরে নামে তখন ছেলেরা আঁতকে উঠলে সে ভারি খুশি হয়। তোমারও যে সেই দশা। আমার কী মনে হয় সত্যি বলব? রাগ করবে না? নেপথ্যে – কী বলো দেখি। নন্দিনী – ভয় দেখাবার ব্যাবসা এখানকার মানুষের। তোমাকে তাই তারা জাল দিয়ে ঘিরে অদ্ভুত সাজিয়ে রেখেছে। এই জুজুর পুতুল সেজে থাকতে লজ্জা করে না!

প্রবল ক্ষমতাধারী শাসককে এই যে প্রায় হাস্যকর করে তোলা, সে যে একটা জুজুর পুতুল তা তার মুখের ওপরেই বলে দেওয়া, এ আসলে প্রতিবাদের এমন একটা ধরন যা শাসককে ভিতর থেকে, অন্তরের দিক থেকে ক্ষইয়ে দেয়। যে-ক্ষমতা তার একমাত্র জোর, সেটিকেই মস্ত ‘নেই’ করে তুললে ক্ষমতাধারীর নিজের প্রতিই সন্দেহ জাগে। এই ধরনের প্রতিবাদ শাসককে নিজের প্রতিই সন্দিহান করে তোলে। খেয়াল করলে দেখব, স্বাভাবিক প্রতিবাদের যে সমস্ত ধরন-ধারণ আমাদের চোখে ভাসে, রাজনৈতিক দলগুলোর অবলম্বন যেসব পদ্ধতি, রবীন্দ্রনাথের আদল সেখানে স্বতন্ত্র। তিনি গোড়ায় সংলাপের মাধ্যমেই শাসকের ভাবনাজগৎকে এলোমেলো করে দেন। বুঝিয়ে দেন, ক্ষমতার ভয় পায় না এমন কেউ আছে। চিরকালই থাকে। আর বড়ো কথা এই যে, ক্ষমতার একটা বিপরীত আধারও আছে। সে হল মানুষ। ফলে, ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে এক এবং একমাত্র শাসকের খুশি হওয়ার কিছু নেই। ঠিক এই জায়গাটায় এসে শাসক যেন আর ক্ষমতার চাঁই নয়, বরং ক্ষমতা নিয়ে তার জারিজুরি এবং সেই হেতু তার সমস্ত কাজকর্ম একটা হাস্যকর গোছের কিছু হয়ে ওঠে। আমাদের অবধারিত মনে পড়ে যায় সত্যজিৎ কীভাবে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর হীরক রাজাকে, সেই উদাহরণটুকু।

ধনঞ্জয়, বিশু, নন্দিনীদের এই যে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের ধরণ, এটিকে আমরা রবীন্দ্র-প্রতিরোধের একটি বিশেষত্ব হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। রাজনৈতিক দলগত যে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ কর্মসূচি, সে তো আলাদা কথা। রাজনীতির লোকেরা সে নিয়ে কম ভাবেননি! কখনও সফল হয়েছেন, কখনও ব্যর্থ। যত লোক খেপিয়েছেন, তত বোঝাতে পারেননি। কিন্তু এসব থেকে খানিক দূরত্বে থেকে রবীন্দ্র-প্রতিবাদ একটা বিশেষ শরীর ধারণ করছে। যেখানে, শাসক ও শোষিতের মধ্যে প্রত্যাশিতভাবেই দূরত্ব আছে, কিন্তু সেইসঙ্গে আছে একরকমের মোকাবিলাও। একরকম মুখোমুখি হওয়া, সংলাপ বিনিময়ের মাধ্যমে প্রতিস্পর্ধী দুই অবস্থানের নিরিখে তৃতীয় কোনও বাস্তবতার দিকে যাওয়া। অর্থাৎ, পুরোটা মিলে একটাই পদ্ধতি। সেখানে শাসকের ক্ষমতাপ্রয়োগ যেমন একটা দিক, তেমন শোষিতের এই যে সটান প্রতিবাদ, শাসকের মূল জোর যে-ক্ষমতা তাকেই প্রশ্ন করা, সে হল গিয়ে আর-একটা দিক। এই দুটো দিককে তিনি মুখোমুখি বসিয়ে দিতে পছন্দ করেন। এইসব চরিত্ররা আসলে আর কেউ কাহিনির চরিত্র তো থাকে না। এ-পিঠ, ও-পিঠ দুয়ে মিলে একরকমের সন্দর্ভ সম্ভাবনা জেগে ওঠে; ভয়ের সঙ্গে ভয়হীনতার, ক্ষমতাদর্পীর সঙ্গে ক্ষমতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা প্রতিরোধীর মুখোমুখি মোকাবিলা। আমাদের মনে হতে থাকে, এই সন্দর্ভ-সম্ভাবনাই রবীন্দ্র-প্রতিবাদের নিজস্ব ধরন।

যদিও সৃষ্টি থেকে ব্যক্তির দিকে ফিরে তাকিয়ে এই আদলের স্বীকৃতি না খোঁজাই ভালো, তবু মানুষটা যখন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, তখন তাঁর ব্যক্তিক প্রতিবাদের ধরনটিও তাঁর সৃষ্টির আদলের সঙ্গে একবার মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা যায়। কিন্তু সেখানে একটা ঝুঁকি থেকে যায়। সেটা এই যে, মিলিয়ে দেখতে গিয়ে মিলিয়ে দেখাটাই জোরজবরদস্তি হয়ে না দাঁড়ায় শেষে। দুয়ে দুয়ে মিল দেওয়ার চেয়ে তাই আমরা আলগোছে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদের দিকে নজর দিই, এবং তাঁর আঙ্গিকটি বোঝার চেষ্টা করি।

রবি ঠাকুর যে সময়ে ছিলেন, তাঁর সময়কার রাষ্ট্রনীতি বা ক্ষমতাধারীদের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে তিনি এক মুহূর্ত দ্বিধা করেননি। এই ক্ষেত্রে তিনি, এমনকি বহুবার রাজনীতিকদের থেকেও এগিয়ে। একেবারে তাঁর ধনঞ্জয় বৈরাগী, নন্দিনীদের মতোই দ্বিধাহীন। সপাট ও সটান। প্রধানত যিনি কবি, তিনি বরং চাইলেই গা বাঁচিয়ে চলতে পারতেন। সে সুযোগ তাঁর কম ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই কারণেই বুঝি সংকটের দিনে আমাদের কাছে এমন সর্বোত্তমভাবে গ্রহণযোগ্য যে, তিনি যেখানে প্রতিবাদ করা উচিত সেখানে তা করতে বিন্দুমাত্র সময় নেননি। আমরা ১৯০৩ সালে ফিরতে পারি এই প্রেক্ষিতে। ইউনিভার্সিটি বিল নিয়ে চলছে আন্দোলন। এমন সময় কার্জন আনলেন ‘বঙ্গবিভাগ’ বিল। উদ্দেশ্য স্পষ্ট। যে-বাংলা থেকে একের পর এক রাজনৈতিক আন্দোলন জন্ম নিচ্ছে এবং যা গোটা দেশের ভাবনাজগৎকে প্রভাবিত করছে, তাকে অক্ষম করে দাও। ভিতর থেকে ভেঙে দাও। সেইসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল সম্প্রদায়গত বিভাজন। পূর্ববঙ্গে মুসলমানরা সুনিশ্চিত আধিপত্যে থাকবে, এই আশ্বাস দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলমানদের এই বিলের পক্ষে প্ররোচিত করার কাজও চলল। এখন, বিলের বিপদ বুঝতে দেরি কারও হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এর বিপক্ষে। সারা বাংলায় এর ফলে যে স্বাদেশিকতার একটা নতুন সুর বাজবে তা বুঝতে তাঁর সময় লাগেনি। এবং তিনি খেয়াল করলেন, লিখলেনও যে, এইবার অন্তত লোকে স্পষ্ট কথা স্পষ্ট করে বলতে পারছে। কিন্তু সেইসঙ্গে এ-ও উল্লেখ থাকল যে, তখনও কিছু নেতা দোনামোনায় ভুগছিলেন। বিরোধিতার পারা যতটা তোলার কথা তা যেন তুলতে পারছিলেন না। তাঁদের ভাবখানা যেন এইরকম ছিল, রবি ঠাকুরের ভাষাতেই, ‘তোমরা যাহা সংকল্প করিয়াছ তাহাতে আমরা নষ্ট হইব, অতএব নিরস্ত হও।’ এর প্রেক্ষিতেই তাঁর শ্লেষ, “বলিহারি এই ‘অতএব’!” অর্থাৎ, এত দ্বিধা কীসের। যদি সত্যিই মনে হয় এই-ই প্রতিবাদের সময়, যদি মনের কোণে অবিশ্বাস না থাকে, তাহলে সোচ্চারে সে-কথা বলতে বাধা কোথায়! বঙ্গভঙ্গ রোধে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে ব্রতী হয়েছিলেন, তা আমরা জানি। সেখানেও আমরা খেয়াল করলে দেখব, তিনি যে সরাসরি সংগ্রামে নেমেছিলেন তা কিন্তু নয়। তাঁর জোরটা ছিল, মানুষে মানুষের গড়ে তোলা বন্ধনে। যাকে তিনি বলছেন ‘নিজেদের মধ্যে ঐক্য’। এই মানুষের জোট গড়াকে আমরা উত্তরকালে তাঁর আজীবনের একটি প্রকল্প হিসেবেই দেখতে পাব।

শুধু এই একটি ক্ষেত্র নয়। ওই সময়কালের ইতিহাস বহু সাক্ষ্য দেবে যে, যেখানে নেতারাও দ্বিধান্বিত, পিছিয়ে গিয়েছেন, সেখানে সবার আগে প্রতিবাদী কণ্ঠ হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা তো আমরা প্রায় সকলেই জানি। আর-একবার শুধু এইখানে মনে করে নেব যে, এই অত্যাচার ঘটার পর গান্ধিজি একরকম দেশবাসীকেই তিরস্কৃত করেছিলেন। তার বৃহত্তর তাৎপর্য যা-ই থাক না কেন, সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকার সেইসব বিবৃতির সদ্ব্যববহার করতে দ্বিধা করেনি। রবীন্দ্রনাথের কাছে খবরটি আসে বেশ দেরি করেই। তার আগে ভাসা ভাসা সংবাদ এসেছিল মাত্র। যখন খবর পেলেন, শান্তিনিকেতনে নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন। প্রতিবাদ সভা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ঠিক তখনই কোনও নেতার সদর্থক সাড়া মেলেনি। এরপর ঘটনাপ্রকৃতি বিভিন্নদিকে গড়ায়, কিন্তু এখানে বলার কথা এই যে, প্রতিবাদ যেখানে করা উচিত, সেখানে রবীন্দ্রনাথ দ্বিধাহীন এবং তৎপর।

দেশের মান্য নেতাদের থেকে এখানে তিনি অনেকটাই এগিয়ে। এমনকি আসন্ন বিপদ বোঝার ক্ষেত্রেও। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিপদ যখন তিনি টের পাচ্ছেন, তখনও আমাদের নেতারা তা অনুমান করেননি। যে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের কারণে ইউরোপীয় শক্তির ঐক্য, রবীন্দ্রনাথ অভ্রান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, পুঁজির বিকাশ এবং সেই সংক্রান্ত স্বার্থের কারণেই এই রাষ্ট্র বা নেশনের উৎপত্তি। রবীন্দ্রনাথের নেশন বা জাতির ধারণা তখন থেকেই একেবারে স্বতন্ত্র পথ ধরতে শুরু করে। তিনি স্পষ্টই অনুমান করেছিলেন, যে ইউরোপীয় রাষ্ট্রভাবনার ভিতর এই পুঁজিবাদী স্বার্থ লুকিয়ে আছে, সেখানে বিরোধ অবধারিত। তিনি জানতেন, ‘পৃথিবী লইয়া ঠেলাঠেলি কাড়াকাড়ি পড়িবে।’ অনেক আগে থেকেই তিনি তাই বলার চেষ্টা করছিলেন, ‘জাতিধর্মের অতীত একটি শ্রেষ্ঠ ধর্ম আছে, তাহা মানবসাধারণের।...’ কিন্তু যে সময় তিনি এই কথা বলছিলেন, সে সময়ের রাজনীতিকরা সাম্রাজ্যবাদের বিপদ বোঝেননি। এমনকি স্বয়ং গান্ধিও নন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ক্লান্তিহীন এই বিপদের কথা বলে গিয়েছেন। দেশের রাজনীতি যদি সেদিন এই সমস্ত বিপদকে বিপদ জ্ঞান করত, তাহলে হয়তো দেশের ইতিহাস অন্যরকম হত। ইউরোপীয় নেশনকে রবীন্দ্রনাথ কোনোদিনই আমাদের জন্য উপযুক্ত মনে করেননি। তাঁর ধারণাবিশ্ব এতখানি স্বতন্ত্র যে ভারতের রাজনীতির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ঘনিয়ে ওঠা প্রায় অবশ্যম্ভাবীই ছিল বলে আজ মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ সরাসরি রাজনীতিতে থাকেননি নয়, আজ বরং আমাদের বলা উচিত, দেশের রাজনীতি রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ ও ধারণ করতে পারেনি। ইউরোপীয় ন্যাশনালিজমের যে বিপদ এবং তা যে আমাদের দেশের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়, এই কথাটি তিনি জোর দিয়েই বলেছিলেন। তাঁর মত এই যে, ‘মিথ্যার দ্বারাই হউক, ভ্রমের দ্বারাই হউক, নিজের কাছে নিজেকে বড়ো করিয়া প্রমাণ করিতেই হইবে এবং সেই উপলক্ষ্যে অন্য নেশনকে ক্ষুদ্র করিতেই হইবে, ইহা নেশনের ধর্ম, ইহা প্যাট্রিয়টিজমের প্রধান অবলম্বন।’ এর সামনাসামনি তিনি বসিয়ে দিতে চাইছিলেন আমাদের দেশেরর গভীর ধর্মবোধকে। এখানে ধর্ম অর্থে আমাদের ন্যায়-নীতির কথাই বলছিলেন তিনি, যে অর্থে মহাভারতের যুদ্ধকে আমরা ধর্মযুদ্ধ বলে থাকি। অধর্মের উদাহরণ সেখানে কম নেই। কিন্তু আমাদের শিক্ষণীয় এই যে, অধর্ম অনুষ্ঠিত হলে তার প্রতিবিধান কীভাবে হয়েছে সমাজে। কীরকম যুক্তি-তর্ক অন্তে মীমাংসায় পৌঁছানো গিয়েছে। এই ধর্ম, বা নীতিবোধ একটা সমাজকে সজীব করে রাখে। রবীন্দ্রনাথের কাছে এই সজীব সত্তার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। তাই তাঁর সিদ্ধান্ত, ‘আমাদের দেশে সমাজ সকলের বড়ো’। এই সমাজ, যাকে কোথাও কোথাও তিনি বলেছেন সমাজলক্ষ্মী, তাকে তিনি মহত্তম আসনটি দিয়েছেন। কেন-না তার মূলে আছে মানুষে মানুষে বন্ধন। তার সুতোয় আছে সাধুতা, নৈতিকতা, ভদ্রতা, মনুষ্যত্ব। এই সমাজই রাজারাজড়া এড়িয়ে একটা সজীব সত্তা হয়ে থাকে। যুদ্ধবিগ্রহ, সংকট ইত্যাদি রাজা সামলাক। কিন্তু পাশের মানুষটির বিপদে যে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, তৃষ্ণার্তকে জল দিতে হবে, এই মিলে থাকার ধর্মটি সমাজই শিখিয়ে দেয়। শিখিয়ে দেয় সামাজিক নীতিবোধ বা ধর্মবোধ। রবীন্দ্রনাথের জোর এইখানটায়। এবং, আজ আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি, যদি এমন একটা সামাজিক জোর সত্যিই আমাদের হাতে থাকে, তবে ক্ষমতাদর্পী শাসক আসলে জুজুর পুতুলই বটে। কেন-না মানুষকে হাতের মুঠোয় রাখার ক্ষমতাই তাহলে আর তার থাকে না। যত বাঁধতে যাবে, তত ফসকাবে। বরং এই সমাজকে ছেড়ে দিলে, সে তার নিজের মতো করে ভালো থাকে। সেই সমাজটাকে বাঁচিয়ে রাখা বা গড়ে তোলা রবীন্দ্রনাথের কাঙ্ক্ষিত ছিল। তিনি প্রত্যাশী ছিলেন ‘বৃহৎ নিঃস্বার্থ কল্যাণবন্ধনে’র, যা কিনা সমাজকে নিচ থেকে উপর পর্যন্ত বেঁধে রাখবে। অসহযোগ আন্দোলনের অনেক আগেই স্বদেশি সমাজভাবনায় তাই মূলত যা চাইছিলেন তিনি, তা একটি বিকল্প সরকার ঠিক নয়, বরং তা হল ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ পালটা সমাজ-নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা’। আজ হয়তো আক্ষেপই করতে হবে যে, আমাদের মূলধারার রাজনীতি এ-পথ তেমন করে ধরেনি। ফলে সমাজের এই বন্ধন আজ শতচ্ছিন্ন, আর সেই বিভাজনের সুযোগ নিয়েই ফ্যাসিস্ট শক্তির আত্মপ্রকাশ ও বিকাশলাভ। এমন সংকটের দিনে আমরা রবীন্দ্রনাথকেই যে জড়িয়ে ধরব, তাতে আর আশ্চর্য কী!

এই প্রসঙ্গেই আর-একটা কথা আসে যে, এই সমাজের ভাবনা যখন রবীন্দ্রনাথ ভাবছেন, তখন হিন্দুসভ্যতার ঐতিহ্য তাঁর চিন্তায় ছিল। দেখা যাবে, মজারই খানিকটা যে, কট্টর হিন্দুত্ববাদী কেউ কেউ তাই রবীন্দ্রনাথকে আপন মনে করে বসে থাকেন আর সোচ্চারে সে-কথা বলতে থাকেন। প্রসঙ্গটিকে আর-একটু নাড়াচাড়া করলে আমরা রবীন্দ্র-প্রতিবাদের আরও একটু বিশেষতা খুঁজে পাব।

সন্দেহ নেই যে, হিন্দুসভ্যতার কথা বলেছেন তিনি। তাঁর সেই সময়কার স্বাদেশিকতার ভাবনা একেবারে ধর্মবিযুক্ত ছিল না, সময়ের কারণেই তা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তাকে বর্তমান হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা কখনোই উচিত হবে না, কেন-না, এই ধরনের হিন্দুত্ববাদের আভাস রবীন্দ্রনাথ যখনই পেয়েছেন, তখনই তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। হিন্দুসভ্যতার মধ্যে যে ঐক্যের সূত্র, সেইটিকেই তিনি আকর্ষণের কেন্দ্র ভাবতেন। ফলে, আমরা দেখব যে, শিবাজি উৎসবের ক্ষেত্রে তিনি কবিতা লিখেছিলেন। সেখানেও ঘুরে ফিরে এসেছে শিবাজি মহারাজের ঐক্যসাধনের কথা। কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদ তাঁর লক্ষ্য নয়। তাই যখন এই উৎসবে যখন ‘ভবানীপূজা’ যুক্ত হল, তখন এর থেকে তিনি দূরত্ব বজায় রাখলেন। এমন উদাহরণ বঙ্গভঙ্গ রোধের সময়ও দেখা যায়।

আর-একটি ঘটনার দিকে ফিরে তাকানো যাক। হিঁদুয়ানি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব কেমন ছিল, তা জলের মতোই স্বচ্ছ সেখানে। সহবাস সম্মতি বিল বিরোধী যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, এবং যা প্রবলতর হয়েছিল বাংলায়, তার প্রায় চার বছর আগেই হিন্দুবিবাহ নিয়ে চন্দ্রনাথ বসুর প্রবন্ধের যুক্তি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সহবাস সম্মতি বিলের বিরোধিতার মূল কারণ তো ছিল এই যে, হিন্দুদের রীতিনীতি জলাঞ্জলি যেতে বসেছে, এবং হিন্দুদের ধর্মে হস্তক্ষেপ করছে বিদেশি সরকার। মূলত এই ভাবনা থেকেই বিরোধিতা দানা বাঁধে। যদিও এখানে মনে রাখা ভালো, এই একই প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিরোধিতার কারণ ছিল একটু অন্যরকম। মহারানির কাছে আবেদন-নিবেদনের যে আইনি বয়ান, তাতে তাঁর আপত্তি ছিল। ফলত তাঁকেও একই হিন্দুত্ববাদের বন্ধনীভুক্ত করা অসংগত হবে। খেয়াল করলে দেখা যায়, এই হিন্দু পুনরুত্থানের সলতে পাকানো হচ্ছিল অনেক আগে থেকেই, তা একেবারে আকস্মিক প্রতিক্রিয়া নয়। সেই নিরিখেই চন্দ্রনাথের প্রবন্ধ ও রবীন্দ্রনাথের উত্তর গুরুত্ব বহন করে। হিন্দুবিবাহ সংক্রান্ত প্রবন্ধে চন্দ্রনাথ বসু হিন্দুদের বিবাহের পবিত্রতা, বিবাহের বয়স, স্ত্রীদের কর্তব্য ইত্যাদি শাস্ত্রসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। বলা বাহুল্য, নিজের যুক্তির প্রয়োজনে শাস্ত্রের যতটুকু দরকার ততটুকুই ছেনে এনেছিলেন চন্দ্রনাথ। তাঁর বিচার সম্পূর্ণ ছিল না। পালটা কলম ধরলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি যে কেবল যুক্তির কথা বলেই চন্দ্রনাথকে খণ্ডন করলেন তাই নয়, সেই যুক্তি তিনি সংগ্রহ করলেন শাস্ত্র থেকেই। যে মনু মহারাজ হিঁদুয়ানির প্রবক্তাদের ভারী আপনার জন, সেই মনুকেই অবলম্বন করলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রাচীন শাস্ত্র ঘেঁটে তুলে আনলেন একের পর এক যুক্তি। এইটে খেয়াল করার মতো। এমনকি আজকেও যখন মনুবাদী চিন্তাচেতনাকে প্রত্যাখ্যান জরুরি হয়ে পড়ে, তখন আমরা সেই প্রত্যাখ্যানটিকে অনেকাংশেই স্লোগান করে তুলি। মনুবাদ থেকে মুক্তি মনুবাদের ভিতর ঢুকেই খুঁজতে হবে, কেবল স্লোগানে নয়। রবীন্দ্রনাথের থেকে শিক্ষণীয় যে, তিনি শাস্ত্রের ভিতর ঢুকেই, সমসময়ের প্রেক্ষিতে কোথায় তার অসারতা এবং কোনটা যুক্তিযুক্ত তা প্রমাণ করে দেন। এতে বিরোধিতার যে জমি তৈরি হয়, বলা বাহুল্য, স্লোগাননির্ভর বিরোধিতার থেকে তা সর্বাংশে পোক্ত। ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন বিদ্যাসাগর। বিধবাবিবাহ নিয়ে তাঁর মোক্ষম যুক্তি সাজিয়েছিলেন শাস্ত্র থেকে উদাহরণ টেনেই। রবীন্দ্রনাথও একই পদ্ধতিতে হিন্দু রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াপন্থীদের ফালাফালা করেছিলেন।

এখানে আজ আমরা মনে রাখব যে, আয়রনি হলেও, এই সহবাস সম্মতি বিল বিরোধিতা ক্রমে ব্রিটিশ বিরোধিতার একটা শক্ত জমি তৈরি করে দিয়েছিল। সেটা কতখানি সংগত ছিল, সে প্রশ্ন পরে, কিন্তু এই হিন্দু পুনরুত্থান এমন এক রাজনীতির জন্ম দিল যা পরবর্তীকালের স্বদেশী আন্দোলনে রসদ জোগাবে। সেইসঙ্গে আমরা এ-ও মনে রাখব যে বাঙালি জাতিসত্তা সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়গুলিও পাশাপাশি ক্রিয়াশীল ছিল। কিন্তু এখানে এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করার কারণ এই যে, হিন্দু পুনরুত্থান ব্রিটিশ বিরোধিতায় ঐক্যের পথ খুলে দিতে পারে এমন সম্ভাবনার কথা থাক বা না-থাক, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু যা যুক্তিযুক্ত নয়, যা কুসংস্কার, সমাজের প্রগতির পরিপন্থী, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দ্বিধা করেননি। এবং তাঁর প্রতিবাদের বিশেষতা এই যে, তিনি কেবল প্রতিবাদী যুক্তিই সাজাননি, সাজিয়েছেন শাস্ত্রকে অবলম্বন করেই। রবীন্দ্রনাথ এই নিবন্ধটি পড়েছিলেন সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন হলে, সেখানে সভাপতিত্ব করেছিলেন ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার।

রবীন্দ্র-প্রতিবাদের এই আদলটুকুই আজকের দিনে নতুন করে মনে করার। স্ববিরোধিতাও কখনও তাঁর মধ্যে দেখা দিয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। তবে যখনই প্রয়োজন পড়েছে, তখনই বিপদের মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস তিনি দেখিয়েছেন। সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছে তাঁর বিকল্প প্রস্তাব। প্রতিবাদের নিজস্ব ধরন। বাইরে থেকে নয়, একরকমের অন্তর্ভুক্তি বা অংশগ্রহণ রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাব করেন, যা ঢাল-তলোয়ার না ঝনঝনিয়েও ক্ষমতাকে ক্ষইয়ে দিতে পারে। ধনঞ্জয়ের কথা দিয়েই প্রসঙ্গটিকে গুটিয়ে ফেলা যাক আপাতত। ধনঞ্জয় যখন সাধারণ নাগরিককে বলে, রাজার কাছে ‘রাজত্ব চাইবি নে?’ তখন তাদের কানে কথাটা ঠাট্টার মতো শোনায়। ধনঞ্জয় তখন বলে, ‘ঠাট্টা কেন করব? এক পায়ে চলার মতো কি দুঃখ আছে? রাজত্ব একলা যদি রাজারই হয়, প্রজার না হয়, তাহলে সেই খোঁড়া রাজত্বের লাফানি দেখে তোরা চমকে উঠতে পারিস কিন্তু দেবতার চোখে জল আসে।...’

অর্থাৎ, খোঁড়া রাজত্বের লাফানি বা এই পঙ্গুত্ব অতিক্রম করতে হলে ব্যক্তির সমাজনির্দিষ্ট কিছু ভূমিকা থাকে যা পালন করতেই হবে। রবীন্দ্র-প্রতিবাদ– ব্যক্তিজীবনে বা সৃষ্টির ভিতর– বারবার সেই জায়গাটির কথাই ধরিয়ে দেয় আমাদের। সময় গড়িয়ে যায়। শাসকের রূপ পালটে যায়। একসময় বোঝা যায় অস্ত্রে নয়, লড়াইয়ের মূল স্থান মগজে। ঠিক সেইখানেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিবাদের স্বতন্ত্র ভাবনায় আমাদের আশ্রয় হয়ে দাঁড়ান। সময়ের অতীত তিনিই তাই হয়ে ওঠেন আমাদের ঘুরে দাঁড়াবার সাহস ও অর্জন।

আরও পড়ুন : কবির হাত শিকলে বাঁধা পড়ে না / সৃজিতা সান্যাল

...................................

[চিত্র ঋণ : প্রণবেশ মাইতি] 

#সিলি পয়েন্ট #Web Portal #Webzine #রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর #প্রতিবাদ #রক্তকরবী #মুক্তধারা #রথের রশি #নন্দিনী #Rabindranath Thakur #সরোজ দরবার #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

74

Unique Visitors

183285