প্রসঙ্গ : পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় 'বাদুড় বিভীষিকা' কমিক্স
'Metamorphosis' বা রূপান্তর (অর্থাৎ মানবদেহের অ-মানব শরীরে বদলে যাওয়া কিংবা তার বিপরীত) নামক প্রক্রিয়াটি সত্যজিৎ রায়ের হরেক গল্পে বারে বারে ফিরে ফিরে আসা একটি মোটিফ। কখনও এই রূপবদলের কারণ অলৌকিক - যেমন 'খগম' গল্পে ধূর্জটিবাবুর সর্পত্বপ্রাপ্তি কিংবা 'রতন আর লক্ষ্মী' গল্পে রতনের রাক্ষসদেহ লাভ। এই দুই ক্ষেত্রেই রূপবদলের কারণ হচ্ছে সাধুবাবার অভিশাপ। আবার কখনও, এই রূপান্তরের কারণ বৈজ্ঞানিক - যেমন 'ডন ক্রিস্টোবাল্ডির ভবিষ্যদ্বাণী' গল্পের জনৈক ভিনগ্রহীর মানবরূপ ধারণ।
যখন ব্যক্তির শরীর বদলাচ্ছে না, বদলাচ্ছে কেবল স্বভাব, তখন সেই পরিবর্তনকে 'Lycanthropy' নামক মানসিক বিকারের আওতায় ফেলা চলে। এই অবস্থায় মানুষ আর নিজেকে মানুষ ভাবে না, ভাবে কোনও পশু- আর তার আচরণও হয় সেইরকম। যেমন, 'মৃগাঙ্কবাবুর ঘটনা' গল্পের নামচরিত্র নিজেকে ক্রমাগত বাঁদর ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি বাঁদুরে স্বভাবের মধ্যে ডুবে যান, কিংবা 'প্রোফেসর শঙ্কু ও গোরিলা' গল্পে এক অদ্ভুত শিরস্ত্রাণের প্রভাবে শঙ্কু গোরিলাদের দলে ভিড়ে গিয়ে তাদের মতো আচরণ আরম্ভ করেন। পরে অবশ্য তাঁর এই বিপর্যস্ত দশা থেকে মুক্তি ঘটে।
কিন্তু, 'বাদুড় বিভীষিকা' (প্রথম প্রকাশ- সন্দেশ পত্রিকায়, মাঘ ১৩১৪) গল্পের জগদীশ মুখুজ্যে চরিত্রটিকে মেটামরফোসিস নাকি লাইক্যানথ্রপি- কোন আওতায় ফেলা যাবে, সেই ব্যাপারটা বেজায় ধোঁয়াটে। কেউ কেউ হয়তো 'Multiple Personality Disorder' নামক মনোবিকারের আওতাতেও তাঁকে ফেলতে চাইবেন। আসলে গল্পকার সত্যজিৎ রায় নিজেই যখন জেনে-বুঝে, ইচ্ছে করে এই ধোঁয়াশা ঘনিয়ে তোলেন, তখন পাঠক বেচারা আর করেন কী!
এই বছর, ২০২১ সালের পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় এই গল্প অবলম্বনে প্রকাশিত হয়েছে একটি সম্পূর্ণ কমিক্স - 'বাদুড় বিভীষিকা'। সত্যজিতের জন্মশতবর্ষে তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের এ এক অসাধারণ প্রয়াস। এর চিত্রনাট্য পরিকল্পনা করেছেন প্রসেনজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, ছবি এঁকেছেন সুমন্ত গুহ।
এ গল্পের কথক ওরফে নায়ক যে মনোবিকারে আক্রান্ত, বিজ্ঞানের পরিভাষায় তার নাম 'Chiroptophobia’। 'বাদুড় বিভীষিকা' শিরোনামটি এই পারিভাষিক শব্দটিরই বঙ্গীকরণ। গল্পে ভূমিকা হিসাবে কথকের এই মনোবিকার একটি অনুচ্ছেদে ব্যক্ত হয়েছিল, কমিক্সে তা বেশ কয়েকটি পাতা জুড়ে জায়গা নিয়েছে। এই ভয় যে নিছক জুগুপ্সা নয়, সেটি সত্যজিৎ রায় বুঝিয়েছিলেন একটি ছোট্ট সংকেতে - ঘরে চামচিকে ঢুকে পড়লে পাখার ব্লেডে ধাক্কা লেগে তার আহত হওয়ার সম্ভাবনা কথা ভেবে কথকের আশঙ্কা। কমিক্সের ভাষায় এই সহানুভূতি অনূদিত হয়েছে নতুন সংযোজিত একটি ঘটনায় - কথকের ভৃত্য বিনোদের হাতে ব্যাডমিন্টনের বাড়ি খেয়ে একটি চামচিকে সোজা এসে পড়েছে কথকের ইজেলের উপরে; সেখানে সদ্য আঁকা যূপকাষ্ঠের ছবির উপরে পড়ে আহত, রক্তাক্ত হয়েছে সে। কথক চিৎকার করে উঠেছেন, "ওটা কী করলি!" কথকের মনোবিকারের ফলে একটি নির্দোষ প্রাণীর সম্ভাব্য মৃত্যুর ফলে তিনিও যে মনে মনে আহত, এ বিষয়টি এই ছোট্টো ইঙ্গিতে কমিক্সে ধরা পড়েছে। এছাড়াও, পথচলতি কিশোরের টিশার্টে বাদুড়ের সিল্যুয়েট ছবি দেখে কথকের আতঙ্ক, কিংবা গাড়িতে রাখা শোপিসকে উড়ন্ত বাদুড় ভেবে তাঁর আশঙ্কা- এই সবই কমিক্সে নতুন সংযোজন। এবং, এই সংযোজনগুলি অনবদ্য।
গল্প এগোয়। সিউড়িতে গিয়ে তাঁর বসবাসের ঘরে একখানি বাদুড় ঝোলায়মান দেখে কথক বিরক্ত হন। সন্ধ্যা নামলে বাদুড়টি অবশ্য নিজে থেকেই উড়ে চলে যায়। আর হাঁটতে হাঁটতে পুরনো গির্জার পাশে পরিত্যক্ত কবরখানায় গিয়ে কথকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে এক ছিটগ্রস্ত মানুষের- জগদীশ পার্সিভ্যাল মুখার্জী। জগদীশবাবুর কালো পোশাক, রাতবিরেতে ঘোরাফেরা করার অভ্যেস, বাদুড়ের পাশাপাশি ভ্যাম্পায়ারের প্রসঙ্গ টেনে আনা - এইসবই কথকের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে তোলে। বিক্ষুব্ধ কথক রাত্রে স্বপ্ন দেখেন, জানালায় দাঁড়িয়ে জগদীশবাবু হাসছেন, তাঁর চোখদুটো জ্বলজ্বলে সবুজ, দাঁতগুলো কেমন যেন সরু আর ধারালো। এই অস্বস্তিকর স্বপ্নের পর তিনি যখন সকালে শোনেন, ভৃত্য মধুসূদনের বাছুরটা গলায় সাপের কামড় খেয়ে মারা গেছে, তখন তাঁর অস্বস্তি আরও বেড়ে যায়। তিনি নিজেকে নিজে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করেন, মধুসূদনের কথা অনুযায়ী জগদীশবাবুকে উন্মাদ ভেবে সান্ত্বনা পেতে চান। কিন্তু ততক্ষণে তাঁর মনে বাদুড়-ভীতির পাশাপাশি এসে হাজির হয়েছে ভ্যাম্পায়ার-ভীতি, যার পোশাকি নাম 'Sanguivoriphobia'। ১৮৯৭ সালে ব্রাম স্টোকারের 'ড্রাকুলা' উপন্যাস প্রকাশের সাথে সাথে বিশ্ব জুড়ে এই ভ্যাম্পায়ার-ভীতির সূচনা, তারপরে অজস্র কমিক্স, ফিল্ম ও লেখালেখি আবিশ্ব এই আতঙ্ককে আরও পাকাপোক্ত করে তুলেছে। কথক নিজে এখন সেই আতঙ্কের শিকার।
এই আতঙ্ক বহুগুণে বেড়ে যায় সেইদিন সন্ধেবেলা জগদীশবাবুর অদ্ভুত কথাবার্তায়। দিনের বেলা ঘুম আর রাতের বেলা ঘোরাফেরা করার স্বভাব, বাদুড়ের মতো তীক্ষ্ণ চোখ আর কান, বিশেষ করে গোরস্থানে মাটির নিচে আটকা পড়ে থাকা মৃতদের শোকোচ্ছ্বাস শুনতে পাওয়ার গপ্পো - এই সবকিছুই জগদীশবাবুর প্রতি কথককে প্রকাশ্যে বিরক্ত, এবং গোপনে আতঙ্কিত করে তোলে। বাদুড় যখন নেই, জগদীশবাবু আছেন; আর বাদুড় যখন আছে, জগদীশবাবু নেই - এই সমীকরণের পাশাপাশি জগদীশবাবু নিজেই যখন একটার পর একটা সম্ভাব্য-ভ্যাম্পায়ার-সুলভ স্বভাবের কথা বলে চলেন, তখন কথকের মনের অবস্থা বুঝে নিতে আমাদের অসুবিধা হবার কথা নয়।
এইখানে এসে, উল্লেখ করতেই হবে চিত্রনাট্যকার এবং চিত্রকারের মুন্সিয়ানার কথা। জগদীশবাবু বলছেন, "মাঝরাত্তিরে যখন চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়, শেয়াল যখন ঘুমিয়ে পড়ে, ঝিঁঝিঁপোকা যখন ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন যাদের শ্রবণশক্তি খুব তীক্ষ্ণ- এই যেমন আমার- তারা এইসব মাটির নীচে কাঠের বাক্সে বন্দি প্রাণীদের শোকোচ্ছ্বাস শুনতে পায়।" আর এই সংলাপের সঙ্গে, পাতা জোড়া ইলাস্ট্রেশনে দেখা যাচ্ছে, একদম ওপরে অতি অল্প জায়গা জুড়ে চেনা জগৎ, ভব্য কালের জগৎ, জীবিতদের জগৎ। আর নিচে, সুবিশাল, অন্ধকার, ভূত কালের জগৎ, মৃতদের জগৎ। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ভাঙাচোরা কফিন থেকে বেরিয়ে এসেছে অস্থিসর্বস্ব মৃত হাত, বিদীর্ণ মাথা, বিস্ফারিত চোখ। এখানে মজাটা এই যে, মৃত্যুলোকের এই ছবিটি কমিক্স হওয়ার কারণেই স্থির, অচল। তাই এখানে একইসঙ্গে তৈরি হচ্ছে দুরকম সম্ভাবনা, দুরকম অর্থ। এক, প্রাকৃতিক নিয়মেই দেহগুলি এইভাবে দুমড়ে মুচড়ে বেরিয়ে এসেছে। দুই, এই সরণ কোনও এক অনির্দেশ্য অলৌকিক গতির ফল - যা কিনা জগদীশবাবুর বিশ্বাস। পাঠকের সামনে এই দুটো পথই খোলা রইল। মাত্র একটি ছবির মাধ্যমে এমন দ্বিধাবিভিক্ত মায়ালোক তৈরির ক্ষমতাকে তো কুর্নিশ জানাতেই হয়।
গল্পের ক্লাইম্যাক্স এগিয়ে আসে। রাতদুপুরে ঘরের মধ্যে উড়ন্ত বাদুড়কে নিজের শরীরের দিকে নেমে আসতে দেখে শক্ত, বাঁধানো খাতা দিয়ে তার মাথায় সজোরে আঘাত করেন কথক। বাদুড় ছিটকে পড়ে ঘরের বাইরে, পরমুহূর্তেই একটা খচমচ শব্দে মনে হয় - কেউ যেন দৌড়ে পালাল। পরেরদিন সকালে দেখা যায়, অচেতন রক্তাক্ত জগদীশবাবুকে ধরাধরি করে নিয়ে আসছে একদল লোক। লেখকের প্রশ্নের উত্তরে তারা জানায়, এ লোক বদ্ধ পাগল, বোধ হয় গাছ থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে চেতনা হারিয়েছে। সন্ধে হলেই এ-গাছে সে-গাছে উঠে এ মাথা নীচু করে ঝুলে থাকত, ঠিক বাদুড়ের মতো।
আরও পড়ুন: সত্যজিতের জাদু দুনিয়া/রণিতা চট্টোপাধ্যায়
এতক্ষণ লেখকের অনুসরণে কমিক্সও কেবল কথকের চিন্তাপথকে কেন্দ্র করেই এগোচ্ছিল। একেবারে শেষের পাতায়, এক মুহূর্তের জন্য সামনে এলো আহত জগদীশবাবুর চোখে দেখা দৃশ্য। এই দৃশ্যটি সাধারণ মানুষের দেখার সাপেক্ষে উল্টো- এই দৃশ্যে আকাশ নীচে, ভূমি উপরে। এই দেখাটা, তাঁর মাথা তাৎক্ষণিক ঝুলে থাকার ফল অবশ্যই। কিন্তু সেইসঙ্গে রয়ে গিয়েছে নিহিতার্থ। তিনি আমাদের চেনা দুনিয়াটাকে আমাদের মতো করে দেখেন না। তাঁর দেখার ভঙ্গিটা চিরকালই উল্টোরকম। সেটা গাছ থেকে ঝুলে থাকার ফলেই হোক, অথবা আহত হয়ে মাথা ঝুলে থাকার ফলে। তিনি কি সত্যিই নিশাচর ভ্যাম্পায়ার, তিনি কি সত্যিই নিজেকে ইচ্ছেমতো বাদুড়ে পরিণত করতে পারেন? নাকি তিনি নেহাতই এক মনোরোগী, যিনি লাইক্যানথ্রপির বশে বাদুড়বৎ আচরণ করেন, আর মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের ফলে নিজেকে ভাবেন ভ্যাম্পায়ার? এর স্পষ্ট উত্তর মেলে না। শুধু এটুকুই বলা চলে, জগদীশ পার্সিভ্যাল মুখার্জী আমাদের চেনা দুনিয়াটাকে দেখেন অন্যভাবে। তাই, তাঁকে যে মানুষ পাগল ভাববে, তাঁকে যে মানুষ ভয় পাবে, এ আর বিচিত্র কী! আঘাত তো তাঁকে পেতে হবেই!
চিত্রঋণ : পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা, ২০২১ / লেখকের সূত্রে প্রাপ্ত