ক্রোমোজোমের ত্রুটি - আক্রান্ত শৈশব পেরিয়ে ক্রোমোজোম গবেষণাতেই নোবেল জয়
............
স্কুলে পড়ার সময় নিজেকে ‘মূর্খ’ বলে ভেবে নিয়েছিল ক্যারোল, ঘিরে ধরেছিল হীনমন্যতার অসুখ। “I thought of myself as ‘stupid’ because I needed remedial help” – এমন ধারণা হওয়ার কারণও ছিল যথেষ্ট। তখন ক্যালিফোর্নিয়ায় এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ে ক্যারোল, কোনো শব্দ বানান করে সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারত না। একটা শব্দের সঙ্গে অন্য শব্দ জড়িয়ে যেত। শিক্ষকরা বিশেষ ভাবে সক্ষমদের সঙ্গে আলাদা করে পড়াতেন। সেইসময় শব্দ বা সংখ্যার ক্রম মনে রাখার জন্যে নিজের মতো করে নানান কৌশল বের করত ক্যারোল। সে যে আর পাঁচজন সমবয়সী ছাত্রছাত্রীদের মতো নয়, তা সে বুঝত। স্কুলের রেজাল্টে কখনোই ‘ডি’ আর ‘এফ’ গ্রেডের বেশি কিছু জোটেনি। কোনোরকম ভাবে টেনেটুনে উঁচু ক্লাসে উঠেছে। পরবর্তী সময়ে ক্যারোল নিজেই বলেছেন, “প্রাথমিক স্কুলে পড়া আমার কাছে মোটেই সহজ ছিল না। … আমি তখন নিজেকে ভাবতাম বোকার হদ্দ, যাকে রেমিডিয়াল স্কুলে পড়তে হচ্ছে”। নিজের সম্পর্কে যাঁর এমন মূল্যায়ন, তিনিই ক্যারোল গ্রেইডার, ফিজিয়োলজি ও মেডিসিনে নোবেলজয়ী।
ক্যারোলের পড়াশোনায় অসুবিধার পেছনে ছিল ডিসলেক্সিয়া (Dyslexia), যদিও তখন তা জানার উপায় ছিল না। কয়েক বছর আগে আমির খানের ‘তারে জমিন পর’ সিনেমার কথা মনে আছে? যেখানে আট বছরের ঈশানের ডিসলেক্সিয়া ছিল। এই অসুখটি বংশবাহিত এবং একধরনের স্নায়ুঘটিত সমস্যা। অন্যদের মতো দৃষ্টিশক্তি কিংবা মেধা থাকলেও নতুন শব্দ বলা কিংবা লেখার ক্ষেত্রে ভীষণ অসুবিধা হয়, কারণ মস্তিষ্কের ভাষা-নিয়ন্ত্রক অংশটিই আক্রান্ত হয়ে থাকে। তবে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত অভ্যাসে এই সমস্যা দূরও হয়। এক্ষেত্রে সঠিক শিক্ষাপদ্ধতি এবং সহমর্মিতার গুরুত্ব অপরিসীম। ঈশান অবস্তীর জীবনে তার মায়ের ভালোবাসা ছিল, আর ছিল একজন নিকুম্ভ স্যার। আহা, বাস্তব যদি হুবহু সিনেমার মতোই হত? সাত বছর বয়সেই মাতৃহারা ক্যারোল সেই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। উপরন্তু তার বছর তিনেকের মাথায় পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক বাবা গবেষণার প্রয়োজনে পাড়ি দিলেন জার্মানিতে। ক্যারোল ও তাঁর দাদাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করলেন হাইডেলবার্গের এক স্কুলে। সেখানে ইংরেজিতে খুব খারাপ রেজাল্ট হলেও প্রখর স্মৃতিশক্তির জন্যে ইতিহাস ও জীববিজ্ঞানে ঠিকঠাক নম্বর পেল ক্যারোল। নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে শেষ হল জুনিয়র হাই স্কুল এবং হাই স্কুলের পড়া। এরপর সান্তা-বারবারায় ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়ার অন্তর্গত ‘কলেজ অফ ক্রিয়েটিভ স্টাডিজ’ থেকে জীববিদ্যাতেই বিএ পাশ করলেন। কলেজে পড়ার সময় ক্যারোল বুঝতে পারলেন যে বিজ্ঞান তাঁর ভালো লাগছে। যদিও বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে কী করবেন সে সম্বন্ধে তাঁর সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না । সেসময় একজন শিক্ষক পরামর্শে ক্যারোল ভাবেন, “... পিএইচডি-র জন্যে কোনো গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে যাব”। কিন্তু কলেজের গ্রেড খুব ভালো হলেও, তাঁর জি.আর.ই স্কোর খুব কম থাকায় বেশিরভাগ জায়গা থেকেই আবেদনপত্র নাকচ হয়ে গেল।
তেরোটি জায়গায় আবেদনপত্র পাঠানোর পরে শুধুমাত্র ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি এবং ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া (বার্কলে)-তে নাম ওঠে। কলেজে ক্যারোলের উচ্চমানের নম্বরেই বেশি জোর দিয়েছিল ওই দুটি ক্ষেত্র। দু’জায়গাতেই সাক্ষাৎকার পরীক্ষায় কৃতকার্য হলেন ক্যারোল, বেছে নিলেন বার্কলে। সেখানে এলিজাবেথ ব্লাকবার্নের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হল, যা তাঁকে ভবিষ্যতে বিশ্বখ্যাত করবে। কেমন ছিল সেই কাজ?
আমরা জানি কোশের নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকে ক্রোমোজোম যার এক একটি আসলে একজোড়া সরলরৈখিক ডিএনএ তন্তু আর কিছু প্রোটিনের সমাহার। কোশ বিভাজনের সময় ক্রোমোজোমের সম্পূর্ণ ডিএনএ অংশটির সঠিক প্রতিলিপি তৈরি হয়। ডিএনএ-র একটি নির্দিষ্ট প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দিকে এই প্রতিলিপিকরণ চলতে থাকে। কিন্তু এই পদ্ধতিতে এগোলে প্রতিবার প্রান্ত থেকে কিছুটা করে ডিএনএ ক্ষয়ে যেতে থাকবে। প্রোক্যারিওটিক কোশে ডিএনএ তন্তু বৃত্তাকার, তার কোনো প্রান্ত নেই। তাই এই সমস্যাও নেই। ইউক্যারিওটিক কোশের ক্রোমোজোমগুলির শেষ প্রান্তে ডিএনএ-র একটি বিশেষ পুনরাবৃত্ত অংশ থাকে, তা টুপির মতো সুরক্ষা দেওয়ার কাজ করে। এই বিশেষ অংশটিকেই ‘টেলোমিয়ার’ বলে। গ্রিক শব্দ Telos মানে হল end বা প্রান্ত, আর Meros মানে Part বা অংশ। কোশ বিভাজনে ক্রোমোজোমের দুটি প্রান্ত যাতে জুড়ে বা ক্ষয়ে না যেতে পারে, সেই সুরক্ষা দেওয়ার কাজ করে টেলোমিয়ার। এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ঠিক কী ভাবে হয়? একটি নতুন উৎসেচকের সন্ধান পেলেন গ্রেইডার। এইসময় ইউসি বার্কলে-তে তাঁর পিএইচডি রিসার্চের প্রথম বছর, ল্যাবরেটরিতেই কেটে যেত দিন-রাত। বস্তুত নয়-দশ মাসের মধ্যেই সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলেন তিনি। পরীক্ষার ফলাফল থেকে বুঝতে পারলেন যে টেলোমারেজ নামের এক অজানা উৎসেচকের অস্ত্বিত্বের কথা। ১৯৮৪ সালে সুবিখ্যাত ‘সেল’ গবেষণাপত্রে প্রকাশ পেল তাঁদের সেই যুগান্তকারী কাজ। এই আবিষ্কারের সময় ক্যারোল গ্রাইডারের বয়স ছিল মাত্র তেইশ বছর। এর ফলে গবেষণার একটি নতুন ক্ষেত্র খুলে গেল যা মানুষের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, বার্ধক্যজনিত অসুখ প্রতিরোধ, ক্যানসার বায়োলজি, বায়োটেকনোলজি ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকরী হয়ে উঠল। এই আবিষ্কারের জন্যে ২০০৯ সালে ফিজিয়োলজি ও মেডিসিনে নোবেল প্রাইজ পান ক্যারোল গ্রেইডার, তাঁর মেন্টর এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্ন এবং জ্যাক সসট্যাক।
পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়ার পরে টেলোমিয়ার ও টেলোমারেজ নিয়ে ক্যারোলের গবেষণা চলল আরও পঁচিশটা বছর। গবেষণা থেকে ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে মানুষের বার্ধক্য, বার্ধক্যজনিত রোগ এবং স্টেম কোশের ক্ষেত্রে টেলোমারেজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা। কিছুদিন আগে ১৫ এপ্রিল ষাট বছরে পা দিয়েছেন এই বিজ্ঞানী। একদম সরল অনাড়ম্বর জীবন তাঁর। কাপড়কাচা থেকে রান্না, ছেলেমেয়ের জন্যে টিফিন তৈরি করা থেকে স্কুলে পৌঁছনো – সব কিছু নিজে হাতে করেন ক্যারোল। যখন নোবেল পুরস্কার পান তখন ক্যারোলের বয়স আটচল্লিশ বছর। ছেলেমেয়েদের একজন দশ আর একজন তেরো। দিনটি ছিল অক্টোবরের পাঁচ তারিখ। খুব ভোরে বাড়ির ফোনটি যখন বেজে উঠেছিল ক্যারোল তখন কাপড় ধুচ্ছিলেন। প্রথমে যথেষ্ট বিরক্ত হলেন, পরে ফোন ধরে জানতে পারলেন যে ফোনটি স্টকহোম থেকে। অন্য প্রান্তে আছে নোবেল কমিটির লোক। পরে প্রেস কনফারেন্সে সঙ্গে নিয়ে গেলেন ছেলে-মেয়েকেও। একদিকে সন্তান প্রতিপালন অন্যদিকে পুরো সময়ের গবেষণাগারের দায়িত্ব। একজন মহিলার পক্ষে সব কিছু সামাল দিয়ে নিরলসভাবে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া যে যথেষ্ট কঠিন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্যারোল বলেন “My lab knows that I’m a mom first”। তিনি এটাও উল্লেখ করেন, প্রতিষ্ঠানের নিয়মে সময়ের নমনীয়তা থাকায় তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে একদিকে পরিবার অন্যদিকে গবেষণা সামাল দেওয়া। সন্তানসম্ভবা থাকাকালীন তিনি কোল্ডস্প্রিং হারবার ল্যাবরেটরির কর্মকর্তাদের বলে চাইল্ড কেয়ার ফেসিলিটির ব্যবস্থা করিয়েছিলেন যাতে গবেষণায় সময় দিতে পারেন। ক্যারোল মনে করেন কাজের পরিবেশ নমনীয় হলে চাপ অনেকটাই হাল্কা হয়ে যায়।
আরও পড়ুন : নক্ষত্রপুঞ্জের বিভা হয়ে আছেন প্রথম ভারতীয় মহিলা পদার্থবিদ / অনিন্দ্য পাল
শৈশবে ডিসলেক্সিয়ার বিরুদ্ধে মোকাবিলা করে অতিক্রম করেছেন অজস্র বাধা। পরবর্তী সময়ে আগ্রহ, হাল ছেড়ে না-দেওয়া মানসিকতা আর নিরলস পরিশ্রম তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের দরজায়। ক্যারোল গ্রেইডারের জীবন আমাদের শেখায় মেধা আর সৎ পরিশ্রমের কাছে শারীরিক বা মানসিক যেকোনো বাধাই তুচ্ছ।
আরও পড়ুন : হিরের দুল ছেড়ে চেয়েছিলেন বই - শতবর্ষে বিস্মৃত বিজ্ঞানী আন্না মনি / সিদ্ধার্থ মজুমদার
..................................
[সিরিজ পোস্টার : অর্পণ দাস]
#Science #বিজ্ঞান #প্রযুক্তি #series #বিজ্ঞান BY নারী #Carol W. Greider #molecular biologist #Nobel laureate #সিদ্ধার্থ মজুমদার #সিলি পয়েন্ট #Web Portal #silly পয়েন্ট