থিয়েটার করতেন চারু মজুমদার
গত শতাব্দীর তিনের দশকের মাঝামাঝি সময়। মাও-জে-দং-এর নেতৃত্বে চিনে তখন লং-মার্চ চলছে। একদিন ভোরে হুই-চাং পাহাড়ের কোলে সূর্যোদয় দেখে মাও-জে-দং থমকে গেলেন। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন সেই অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে। যেন তখন আর তিনি কোনো বিপ্লবী নন, এক সামান্য কবি মাত্র। সাতের দশকের বাংলা। নকশাল আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা চারু মজুমদার তখন আত্মগোপনে। একান্তে থাকার সুযোগ পেলেই তিনি অপটু কণ্ঠে বড়ে গোলাম আলীর ‘বাজুবন্ধ খলু খলু যায়...’ গুনগুনিয়ে উঠতেন। না, তখন আর যেন তিনি বিপ্লবী নন। সোনালি ফ্রেমের চশমা আঁটা এক সামান্য সংস্কৃতি-সচেতন মানুষ মাত্র।
যার ডাকে হাজারো হাজারো যুবক-যুবতী রাস্তায় নামত, যার উচ্চকিত স্লোগানে কৃষকদের মধ্যে অধিকার বুঝে নেওয়ার শিহরণ খেলে যেত, তিনিই আবার জেলবন্দী অবস্থায় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কবিতা নিয়ে তীব্র বিতর্কে মেতে উঠতেন। যিনি ভোটপ্রচারে সদর্পে সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলতেন আর হারের পরেও বিজয়মিছিল বের করতেন, আবার তিনিই আবার প্রবল উৎসাহে থিয়েটারে মেতে উঠতেন। সেই চারু মজুমদার রাজনীতির মতো সংস্কৃতিকেও জীবনের অঙ্গ বলেই মনে করতেন। তাঁর নিজের জীবনেও ছড়িয়েছিল একাধিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিচয়।
অত্যন্ত কম বয়স থেকেই তাঁর রাজনীতি আর সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ। ১৯৩৯-এ মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তিনি জলপাইগুড়ি জেলায় সদ্যপ্রতিষ্ঠিত সিপিআই-এর ইউনিটে যোগদান করেন। জেলা সম্পাদক শচীন দাশগুপ্তের সঙ্গে তিনি ডুয়ার্সের গ্রাম-গ্রামাঞ্চলে ঘুরতেন, দরিদ্র কৃষকদের সঙ্গে মিশতেন, তাঁদের দুঃখ-কষ্টের কথা শুনতেন। ফিরে আসার পর তিনি প্রায়ই চলে যেতেন শহরের প্রাচীনতম সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আর্য নাট্যসমাজে। সেখানে তিনি নির্দ্বিধায় ঘন্টার পর ঘন্টা নাটক নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। আবার শিলিগুড়ির বাড়িতে ফিরে এলেই তাঁর অত্যন্ত প্রিয় স্থান ছিল মিত্র সম্মিলনী। চারের দশকে মিত্র সম্মিলনীর অনেক নাট্যানুষ্ঠানেই চারু মজুমদারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল। এমনকি তাদের তরফ থেকে শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় রচিত ‘বন্ধু’ নাটকের প্রযোজনায় তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ও করেন।
চারের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সমগ্র উত্তরবঙ্গে তেভাগার হাওয়া তীব্র হতে থাকে। ভাগচাষি আর আধিয়ারদের একত্রিত করে ফসলের প্রাপ্য মর্যাদা বুঝে নেওয়ার লড়াই শুরু হয়। ১৯৪৮-এ জলপাইগুড়ি থেকে চারু মজুমদারকে গ্রেপ্তার করার পর প্রথমে জলপাইগুড়ি জেল, তারপর দমদম জেল, তারপর আরও বহু ‘কমরেড’-এর সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বক্সার জেলে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও সেখানে বন্দি হন। ১৯৫০-৫১ সাল নাগাদ দুজনে প্রায়ই কবিতার আলোচনায় মেতে উঠতেন। উত্তরবঙ্গের এক কৃষক নেতার সাংস্কৃতিক উপলব্ধিতে অবাক হয়েছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১৯৫২ সালে তিনি লীলা সেনগুপ্তকে বিবাহ করেন। দুজনেই তখন পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী। পার্টি সদস্যপদ জলপাইগুড়ি থেকে বদলি করে নিয়ে এলেন দার্জিলিং-এ। একদিকে চা-বাগান শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক কাজকর্ম, অন্যদিকে ফাঁক পেলেই মিত্র সম্মিলনীতে গিয়ে নাটক, গান, সমবেত নৃত্যের মহলায় গিয়ে উৎসাহ দেওয়া। প্রথমে সাধারণ সদস্য ও পরে তিনি মিত্র সম্মিলনীর কার্যকরী সমিতির সদস্যও হয়েছিলেন। নববর্ষ, রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলিতে তিনি অংশগ্রহণ করতেন। নিজে দুয়েকবার আবৃত্তিও করেছিলেন। আবৃত্তির সময়ে তাঁর কণ্ঠে গর্জে উঠত নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। আর সময়ে-অসময়ে একান্তে আউড়ে যেতেন রবীন্দ্রনাথের ‘মৃত্যুঞ্জয়’ কবিতার পংক্তি।
১৯৫৬-র সিপিআই-এর পালঘাট সম্মেলনে চারু মজুমদার ছিলেন অন্যতম প্রতিনিধি। এই সম্মেলন থেকেই পার্টির মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ ক্রমে ভাঙনের রূপ নিতে শুরু করে। তিনি নিজেও কেন্দ্রীয় কমিটির লাইনের সঙ্গে একমত ছিলেন না। পার্টি তাঁকে কলকাতায় এসে রাজ্যস্তরে কৃষক-সংগঠনের দায়িত্ব দিতে চাইলেও তিনি অসম্মতি জানান। ভবিষ্যতে কৃষক-সংগ্রামের পদ্ধতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে সিপিআই(এম)-এর পার্থক্যের আঁচ তখন থেকেই পাওয়া যায়। অথচ একই সময়ে এই মানুষটিকেই দেখা যায় উত্তরবঙ্গের গণনাট্য সংঘের অনুষ্ঠানের মূল পরিকল্পনাকারী রূপে। ১৯৫৬-এর এপ্রিলে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে তিনি পর্দার আড়ালে রবীন্দ্রনাথের ছায়ামূর্তি তৈরি করে কবিতা পাঠ করেছিলেন। ১৯৬২-তে নকশালবাড়ি আন্দোলনের খসড়া নিয়ে একটি দলিল লেখেন। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি তাঁর সমর্থনে ভীত কমিউনিস্ট পার্টি চারু মজুমদারকে দল থেকে বহিষ্কারের কথাও ভেবেছিল। আর সেই সালেই তিনি প্রবল উৎসাহে মিত্র সম্মিলনীর থিয়েটারের কাজে মেতে উঠছেন। এমনকি সেখানে তিনি একটি নাটক পরিচালনাও করেছিলেন।
১৯৬৪-তে পার্টি ভাগের পরে তিনি সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু এই সংযোগ নেহাতই ক্ষণিকের। রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ নিয়ে পার্টির সঙ্গে তাঁর যেমন মতবিরোধ বাড়তে থাকে, তেমনই সাংস্কৃতিক আন্দোলন নিয়েও তিনি ভিন্নমত পোষণ করতেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা নিয়ে তাঁর প্রবল আপত্তি ছিল। ১৯৬৫-তে গণনাট্য সরাসরি পার্টি-সংগঠনে পরিণত হওয়ায় তাঁর মনে সংশয় জেগেছিল গণনাট্যের নাট্যচর্চার পরিধি আরও সংকীর্ণ হয়ে যেতে পারে। কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় তাঁর আশঙ্কা একেবারে মিথ্যে হয়নি।
১৯৬৯ সালে সিপিআই(এমএল) গঠিত হওয়ার পর চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল প্রমুখের নেতৃত্বে নকশালবাড়ি আন্দোলন তখন তুঙ্গে। শুরু হয় রাষ্ট্রীয় অত্যাচার। তারপরের ইতিহাস প্রবল রাজনৈতিক ইতিহাস, প্রবল বিতর্কের ইতিহাস। পড়ে রইল পরিবার, পড়ে রইল মিত্র সম্মিলনীর মঞ্চ। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে চারু মজুমদার গ্রেপ্তার হন এবং ওই মাসেই লক-আপে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যুও রহস্যাবৃত। তাঁর মৃতদেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। প্রবেশের অনুমতি ছিল না সংবাদপত্রের। পুলিশি পাহারায় তাঁর সৎকার সমাপ্ত হয়।
কারোর কাছে তিনি বিপ্লবী, কারোর কাছে সন্ত্রাসবাদী; রাষ্ট্রের কাছে এক আতঙ্কের নাম। চারু মজুমদারের অনেকগুলি সত্তার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল তাঁর শিল্পপ্রেমী পরিচয়টি। যিনি প্রকাশ্যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো নটরাজ, সাইক্লোন, মহাভয়, পৃথিবীর অভিশাপ। আর অন্তরে নিজেকে মৃত্যুর চেয়ে বড়ো কল্পনা করে শেষ পথের দিকে এগিয়ে যান।
তথ্যঋণ- অভিনয় পত্রিকা
#চারু মজুদার #অর্পণ দাস #থিয়েটার #সিলি পয়েন্ট #ফিচার #পোর্টাল #ওয়েবজিন