ক্যাপ্টেন হ্যাডকের হুইস্কি বদল
‘The Crab With The Golden Claws’ বা ‘কাঁকড়া রহস্য’ – ১৯৪১ সালে এই গল্পের হাত ধরেই টিনটিনের জীবনে প্রবেশ করেন ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড হ্যাডক। মেজাজি, মদ্যপ নাবিকমশাই প্রকৃত অর্থেই দিলখোলা এবং বন্ধুবৎসল। টিনটিনের সঙ্গে যতই মতের অমিল হোক, ক্যালকুলাসের উপর যতই খাপ্পা থাকুন, বিপদে-আপদে বন্ধুর স্বার্থরক্ষাকেই হ্যাডক বরাবর স্বধর্ম বলে মেনে এসেছেন। দোষের মধ্যে শুধু তাঁর মাত্রাতিরিক্ত সুরাপ্রীতি। যেমন-তেমন নয়, খাঁটি হাইল্যান্ড স্কচ হুইস্কি! আর টিনটিন-প্রেমী মাত্রেই জানেন, ক্যাপ্টেনের পছন্দের ব্র্যান্ড – লখ লোমন্ড। কিন্তু এত রকমফের থাকতে হঠাৎ এই বিশেষ ব্র্যান্ডের প্রতি অ্যার্জে পক্ষপাত করলেন কেন? তবে কি স্রষ্টার পছন্দ এসে মিশেছে সৃষ্টির পাত্রে? খুঁজলে পাওয়া যাবে এক অদ্ভুত তথ্য। স্কটল্যান্ডের অ্যালেজান্দ্রিয়ায় লখ লোমন্ড হুইস্কির উৎপাদন শুরুই হয় ১৯৬৫ সালে! সমসাময়িক অনেক কিছুই টিনটিনের গল্পে তুলে ধরেছেন অ্যার্জে। তাই বলে পঁচিশ বছর পরের ভবিষ্যৎ বলে দেবেন এতটা ভাবা বাড়াবাড়ি। তবে কী করে এমনটা হল?
সাদাকালোতে পথচলা শুরু করলেও পরবর্তীকালে টিনটিন আবার আত্মপ্রকাশ করে রঙিন অবতারে, মাপা কলেবরে; দু’বারই গল্পে প্রথম যে হুইস্কির উল্লেখ পাওয়া যায় তা মোটেই লখ লোমন্ড নয়, বরং বহুল পরিচিত জনি ওয়াকার। ১৯৩৭ সালের ‘The Black Island’ (কৃষ্ণদ্বীপের রহস্য) কমিক্সে ডঃ মুলারের পিছু ধাওয়া করে টিনটিন আর কুট্টুস উঠে বসে এক চলন্ত মালগাড়িতে, যাতে রয়েছে জনি ওয়াকারের বিশাল ট্যাঙ্কার। আবার কয়েক পাতা পরে, স্কটিশ পোশাক পরিহিত টিনটিনের পাবে ঢোকার দৃশ্যে জায়গা করে নেয় জন হেইগ হুইস্কির পোস্টার। ১৯৪৩ সালের রঙিন সংস্করণেও সে ব্র্যান্ডিং অক্ষত। এর মাঝে হ্যাডক এসেছেন, ওল্ড স্কচ হুইস্কি সঙ্গে করে। আর তার পরের বছর, ‘The Shooting Star’ (আশ্চর্য উল্কা) গল্পে ক্যাপ্টেন হ্যাডকের সংবর্ধনায় বাক্স-বাক্স জন হেইগ এসে হাজির। এমনকি ‘The Red Sea Sharks’ (লোহিত সাগরের হাঙ্গর)-এ হ্যাডককে লোভ দেখাতে অ্যালান তাঁর কেবিনে রেখে দেয় জন হেইগের বোতল। দিব্যি চলছিল হ্যাডকের সুরাপান, গোলমালটা পাকাল টিনটিনের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা।
বেলজিয়ামের ঘরের ছেলেকে ব্রিটেনের হৃদয়ে জায়গা দিতে এগিয়ে এল মেথুয়েন প্রকাশনা। তারা অ্যার্জের কাছে আবদার জানাল, ‘The Black Island’ গল্পটা যেহেতু স্কটল্যান্ড-কেন্দ্রিক তাই সেই অনুযায়ী বেশ কিছু বদল করতে হবে সেখানকার পাঠকদের জন্য। অ্যার্জেও সেইভাবে আবার আঁকলেন; শোনা যায় তাঁর সহকারী কার্টুনিস্ট বব দে মুর টানা দশদিন স্কটল্যান্ডের জায়গায়-জায়গায় ঘুরে গুচ্ছখানেক স্কেচ আর ফোটোগ্রাফে ঝুলি ভরিয়ে ফিরেছিলেন। শিশু-কিশোরদের জগতে আসল হুইস্কি ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন করতে আপত্তি ছিল মেথুয়ানের। তাই বাধ্য হয়েই অ্যার্জে বেছে নেন দক্ষিণ স্কটল্যান্ডের এক বিখ্যাত ভ্রমণস্থলের নাম, লখ লোমন্ড হ্রদ। আর এই করতে গিয়েই বাদ পড়ল জনি ওয়াকার ও জন হেইগ। পরবর্তীকালে ‘The Shooting Star’-এও জন হেইগের নামটুকু মুছে দেওয়া হয়। এরপর আর দু’টোমাত্র গল্পে লখ লোমন্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়, ‘Flight 714’ (ফ্লাইট ৭১৪) আর ‘Tintin And The Picaros’ (বিপ্লবীদের দঙ্গলে), এবং এই দ্বিতীয় গল্পে (যা কিনা অ্যার্জের লেখা শেষ টিনটিন-অভিযান) ক্যাপ্টেন হ্যাডককে প্রথম ও শেষবারের মতো লখ লোমন্ডের বোতল খুলতে দেখা যায়।
প্রকাশকরা বোধহয় ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি ‘The Black Island’ প্রকাশিত হওয়ার পরে পরেই অ্যার্জের কল্পনা বাস্তব রূপ নেবে, না চাইতেও শিশুপাঠ্যে চলে আসবে ব্র্যান্ড প্রোমোশন। কাকতালীয় ঘটনা ঠিকই, তবে একটা নয়, একজোড়া। অ্যার্জে স্টুডিও বা মেথুয়ান, কেউ জানত না যে লখ লোমন্ড বলে একটি হুইস্কি সত্যিই ছিল! ১৮১৪ সালে তার গোড়াপত্তন হয়, কিন্তু জনপ্রিয়তার অভাবে বেশিদিন চলেনি। এরপর টিনটিনের আবেদনকে পুঁজি করে লখ লোমন্ড ডিস্টিলারি ১৯৬৫-তে সেই যে যাত্রা শুরু করল, মাঝে ১৯৮০-৮৭ বন্ধ থাকা বাদ দিয়ে, এখনও রমরমিয়ে চলছে। ব্যক্তিগত পছন্দ যা-ই হোক, লখ লোমন্ডকে যারা ভালোবাসেনি তাদের গায়ে “কোটি কোটি পোড়া নীল ফোস্কা”!
................................
তথ্যসূত্র: www.scotchwhisky.com/captain-haddock; www.tintinologist.org; www.tintin.com; www.tintin.fandom.com