নিবন্ধ

ব্রিটিশ জবানিতে কলকাতা

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য Aug 21, 2020 at 6:32 am নিবন্ধ

একথা অনস্বীকার্য যে, সঙ্গত কারণেই ব্রিটিশদের সঙ্গে কলকাতার সম্পর্ক গভীর। ১৮৮৯ সালে কলকাতা সম্বন্ধে রুডিয়ার্ড কিপলিঙের বক্তব্য, “কলকাতা সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশদের সৃষ্টি, তার অস্তিত্ব ইংল্যান্ডের জন্যই, এবং প্রতি মুহূর্তে সে ইংল্যান্ডের উপর নির্ভরশীল।” ব্রিটিশ আমলে অসংখ্য ইংরেজ কর্মসূত্রে ও অন্যান্য কারণে কলকাতায় এসে থেকে গেছেন, অনেকেই তাঁদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন কবিতায়, বইয়ের পাতায়, ডায়রিতে। মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল গুস্তাভ য়্যুং তাঁর ‘দ্য ড্রিমলাইক ওয়ার্ল্ড অফ ইন্ডিয়া’ বইতে সখেদে জানাচ্ছেন, ভারতে বসবাসকারী কোনো ইউরোপীয়ই আদতে ভারতে থাকে না, তাদের ইউরোপীয় আচার বিচার সংস্কৃতি দিয়ে গড়া কাচের দেওয়াল ভেদ করে স্থানীয় প্রভাব পৌঁছতে পারে না বললেই চলে। কলকাতায় বসবাসকারী ব্রিটিশদের সম্বন্ধে অন্তত এ অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে সত্যি নয়। ব্রিটিশ আমলের প্রথমদিকে কলকাতায় আসার পর তার নতুনত্বে কিঞ্চিৎ বিহ্বল হয়ে পড়লেও পরবর্তীকালে বেশ কিছু ইংরেজ ব্যক্তি তাঁদের সংকীর্ণ পরিমণ্ডলের বাইরে বেরিয়ে কলকাতাকে বুঝতে চেয়েছেন, বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন তার চরিত্র, সমাজ, জীবনযাত্রা। অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ অবধি কলকাতার অপরায়িত চরিত্রটি তাদের লেখায় প্রাধান্য পেলেও ধীরে ধীরে তার চরিত্র বদলেছে, বর্ণনায় এসেছে দক্ষতা, স্থানীয় নেটিভদের সম্পর্কে বেড়েছে আগ্রহ, শোনা গিয়েছে প্রশংসা।

১৭৫৪ সালে এডওয়ার্ড আইভসের কলমে কলকাতার হাড়গিলে পাখির বর্ণনা পড়লে মনে হয়, এ যেন কোনো বিজাতীয় রহস্যময় প্রাণী:
আমরা এখানে মাঝেমধ্যেই একটি কিম্ভূত জাতের পাখি দেখতে পাই, যাকে কলকাতার নেটিভরা ‘আর্গিল’ বা ‘হার্গিল’ বলে। এদের বিরাট চেহারা দেখে আমরা প্রথমে এদের নগ্নদেহ ভারতীয় মানুষ ভেবে ভুল করেছিলাম। পাখি জানতে পারার পর আমরা কৌতূহল নিবৃত্ত করবার জন্য একটাকে গুলি করবার তোড়জোড় শুরু করলাম, কিন্তু আমাদের মধ্যে বেশ কিছু পাকা শিকারি থাকা সত্ত্বেও নিশানা বারবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে লাগল। আমাদের দুর্গতি দেখে আমাদের পালকির বেহারাদের ভারী আমোদ হচ্ছিল, অবশেষে তাদের মধ্যে একজন গম্ভীরভাবে বলল আমরা সারাজীবন চেষ্টা করলেও এই পাখিগুলোকে মারতে পারব না, কারণ ওদের দেহে নাকি ব্রাহ্মণদের আত্মা ভর করে থাকে।

একই সুর শোনা যায় ১৭৪৭-৪৮ সালে জেমস মিশেলের হুগলি নদীর বর্ণনায়:
এখানে মুহুর্মুহু বিরাট আকারের কুমির দেখতে পাওয়া যায়; মাঝেমধ্যেই তাদের বিশ থেকে ত্রিশ ফুট লম্বা দেহ আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল, কিন্তু আমরা বারবার গুলি ছুঁড়েও কিছু করতে পারছিলাম না, কুমিরগুলো তৎক্ষণাৎ জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ভারতের স্থানীয় সমাজ ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে ইংরেজদের আগ্রহ বিশেষভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, জন শোরের রচনা, রবার্ট সাউদির কবিতা ইত্যাদি তার সাক্ষ্য বহন করে। টমাস মেকলে থেকে উইলিয়াম উইলবারফোর্স বার্ড, গণ্যমান্য সাহেবদের সবার মুখেই উঠে আসছিল ভারতবর্ষের কথা, বাংলাদেশের কথা। ১৮৩৬ সালে ভারতের তৎকালীন কমান্ডার-ইন-চিফ স্যার হেনরি ফেনের কন্যা ইজাবেলা কলকাতার চড়ক পূজা সম্বন্ধে একটি উল্লেখযোগ্য বিবরণ দিয়েছেন:
এই উৎসব তিনদিন ধরে চলে: প্রথমদিন কিছু হতভাগ্য ব্যক্তি দেহের বিভিন্ন স্থানে ধারালো শিক গুঁজে দেয়। এরা বেশিরভাগই নিচু জাতের, এবং উঁচুজাতের লোকেরা এসব করার জন্য তাদের টাকা দেয়। আমরা এই বেচারিদের একটা শোভাযাত্রা দেখলাম, কারও কারও জিভে ছয় বা সাত ফুট লম্বা লোহার শিক ঢোকানো, তারা ওই অবস্থাতেই লাফঝাঁপ করছে। আমার যদিও এত কৌতূহল দেখাতে লজ্জা করছিল, কিন্তু আমি তবুও ঠিক করলাম এই দৃশ্য কিছুতেই ছাড়া যাবে না, তাই একটা পোক বনেট এবং ভেল চাপিয়ে মার্ক বেরেসফোর্ডের সঙ্গে একখানা ছ্যাকড়া গাড়িতে বিকেল পাঁচটায় রওনা দিলাম। সৌভাগ্যক্রমে আমরা খুব কাছ থেকে দু-জন স্থানীয় পুরুষকে দেখতে পেলাম।

ইজাবেলা ফেনের বিশ্লেষণে স্থানীয় জীবনকে কাছ থেকে দেখবার, তার খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করবার আগ্রহ লক্ষ করা যায়, যা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া স্থানীয় পুরুষদের নগ্নদেহ দর্শন করতে গিয়ে তাঁর লজ্জা, কিন্তু তা সত্ত্বেও আবার সেই পুরুষদের দেখতে ছুটে যাওয়া কি অপরায়িত পুরুষদেহের প্রতি কোনো যৌন আকর্ষণের ইঙ্গিত বহন করে? বিষয়টি অবশ্যই ভেবে দেখার মত।

শতাব্দীর শেষভাগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সম্বন্ধে একাধিক বুদ্ধিজীবীর মনে ধীরে ধীরে উদয় হতে থাকে এক আত্মসমালোচনার ভাব, যা পরিলক্ষিত হয় হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড, গায় বুথবি, জোসেফ কনরাড প্রমুখ সাহিত্যিকদের লেখায়। এই মনোভাবের প্রভাব দেখা যায় কলকাতা সম্বন্ধে বর্ণনাতেও। ১৮৯৯ সালের ১৭ আগস্ট হেনরি বেভেরিজ লিখছেন:
আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে বম্বে, মাদ্রাজ ও কলকাতার মত আমাদের নেটিভ শহরগুলি অত্যন্ত লজ্জাজনক মানসিকতার দৃষ্টান্ত বহন করে। আমরা সুন্দর সুন্দর জায়গা বাছাই করি, তারপর সেখানে জমকালো কয়েকটি বাড়ি তৈরি করে বাকি সবকিছু যেমন তেমনভাবে ফেলে রাখি। যেন দারিদ্র্য আর জঞ্জালের সঙ্গে সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধির সম্পর্ক সমানুপাতিক। ইউরোপীয় কোয়ার্টারগুলি হল বিজলি বাতির মত, তা বাকি শহরের দৈন্যদশাকে আরও নগ্নভাবে তুলে ধরে।

বিংশ শতাব্দীর আগমনের সঙ্গে বাংলার নবজাগরণ পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হলে ব্রিটিশদের গলাতেও স্থানীয় বাঙালিদের সম্পর্কে শোনা যেতে থাকে প্রশংসার সুর। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এর আগেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড ভ্রমণ করতে গিয়ে ব্রিটিশদের সম্ভ্রম আদায় করেছিলেন রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেন। কেশবের জনপ্রিয়তায় ক্ষুব্ধ হয়ে লন্ডনের বিখ্যাত পত্রিকা ‘পাঞ্চ’ তাঁকে নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক ছড়া অবধি প্রকাশ করে। ১৯১১ সালে ঠাকুর পরিবার সম্পর্কে লিখছেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী উইলিয়াম রোদেনস্টাইন:
অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর ভাই গগনেন্দ্রনাথ আমাকে তাঁদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিয়ে গেলেন: অপূর্ব একখানি বাড়ি, সুন্দর সুন্দর ছবি, মূর্তি ও বাদ্যযন্ত্রে ভর্তি। গগনেন্দ্রনাথ যেন ভারতীয় রিকেটস, তিনি সবকিছু পড়েছেন, সমস্ত কিছুই যেন তাঁর নখদর্পণে। তবে আমি যতবারই সেই বাড়িতে যেতাম, তাঁদের কাকাটি আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করতেন। সাদা ধুতি ও চাদর পরা শান্ত সৌম্য চেহারা, চুপ করে বসে তিনি আমাদের কথা শুনতেন। তিনি যে সেই সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের একজন, এ সম্বন্ধে কেউ আমাকে কিছুই বলেননি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যামিনী রায় সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শোনা যায় ব্রিটিশ নন্দনতাত্ত্বিক ও ‘ব্রাইট ইয়ং থিংস’ দলের সদস্য হ্যারল্ড অ্যাক্টনের বিবরণে:
যামিনী রায় জীবনে কোনোদিন ইউরোপে না গিয়েও ফরাসি প্রতীতিবাদের ধারা অনুসরণ করে যেসব নিসর্গদৃশ্য এঁকেছেন সেগুলি দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমার মনে হল হুইস্টলার সম্ভবত ঠিকই বলেছিলেন, শিল্পের কোন জাত হয় না। উত্তর কলকাতার এক অজানা গলিতে বসে তিনি কী সাবলীলভাবে তুলির টানে প্রোভেন্সের অলিভ গাছ ও নর্ম্যান্ডির আপেলগাছগুলিকে ফুটিয়ে তুলেছেন!

এডওয়ার্ড আইভস ও জেমস মিশেলের বর্ণনায় গড়ে-ওঠা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, স্ব ও অপরের মধ্যে দ্বন্দ্বগুলিই যেন ভেঙে যেতে থাকে অ্যাক্টনের লেখায়। আমরা বুঝতে পারি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে ব্রিটিশদের দৃষ্টিভঙ্গি। তাদের চোখে বদলে গেছে কলকাতা শহর, তার জীবনযাত্রা, তার সমাজ, তার মানুষজন।

[ঋণস্বীকার: ক্যালকাটা থ্রু ব্রিটিশ আইজ ১৬৯০-১৯৯০, সংকলন ও সম্পাদনা: লরা সাইকস, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯২]



[পোস্টার : অর্পণ দাস।]

আরও পড়ুন

#কলকাতা #ব্রিটিশ কলকাতা #কলোনিয়াল কলকাতা #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

219122