ফিচার

ফ্যানি পার্কসের কলকাতা

সুদেব বোস Dec 9, 2020 at 9:28 am ফিচার

একটি বই। প্রবেশক পত্রে একটি বিশাল, বহুবর্ণের গণেশমূর্তির ছবি। বইয়ের সূচনাতেই সুদীর্ঘ গণেশবন্দনা। মহাভারতলেখক গণেশের আশীর্বাণী চেয়েছেন লেখিকা। আর ভূমিকা অংশে মহাদেব, পার্বতী প্রমুখ দেবদেবীর জয়গান। ১৮৫০ সালে বেরিয়েছিল বইটি। কোনো সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত লিখেছেন? না কোনো পণ্ডিত মারাঠি?

না বইটি লিখেছেন এক ইংরেজ মহিলা। এদেশে ‘রাইটার’ স্বামীর সঙ্গে এসে। 

রাইটার হল কোম্পানি আমলের সেই বিদেশাগত ছোকরা সাহেবরা যাঁদের বাসভূমি হিসেবে ১৭৭৪ সালে টমাস লিয়ন বিখ্যাত বাড়িটা বানিয়েছিলেন। ছ সাত বছর আগে অবধি ‘রাইটার্সে আছি’ বলতে কলার উঠত আমবাঙালির, কিন্তু রাইটার শব্দের তখনকার অর্থ শুধু কেরাণী। মাইনে সাকুল্যে শ তিনেক টাকা। এমন মাইনের একটি চাকরি নিয়েই এদেশে এসেছিলেন চার্লস ক্রফোর্ড পার্কস, সঙ্গে তিনবছরের বড় নবপরিণীতা স্ত্রী। নামটি বড় আদুরে, ফ্যানি। এক, দুই নয়, গুণে গুণে চব্বিশটি বছর কাটালেন তাঁরা এদেশে। তারপর ফিরে গিয়ে যে বইটি লিখলেন তার নাম- “Wanderings of a Pilgrim : In search of a picturesque” তাঁর ভাষায় Pilgrim শব্দটি রয়েছে মানে কী এদেশ তাঁর কাছে তীর্থস্থান? সে প্রশ্নে আপাতত যাচ্ছি না। শুধু এটুকুই বলার যে তাঁর লেখা দুখণ্ডের বইটা কিন্তু উনিশ শতকের গোড়ার ভারতকে চেনার নির্ভরযোগ্য সহায়িকা হতে পারে। 

সুবিশাল বই, সবটুকু না নিয়ে ‘দ্বিতীয় লন্ডন’ কলকাতা নগরীর ছবিটাই দেখা যাক। ১৮২২ এর নভেম্বর নাগাদ এসে আঠাশ বছরের যুবতী তাঁর স্বামীর সঙ্গে থাকতে শুরু করলেন  ৩২৫ টাকা বাড়িভাড়া দিয়ে চৌরঙ্গির একটি বাড়িতে। নিজেকে তিনি বলেন এক নবাগতা ‘গ্রিফিন’, সদ্য ইউরোপ থেকে এসেছেন বলে। তাঁর যৌবনের চোখে বাংলার জীবন ও সমাজ ধরা দিতে লাগল বহুবর্ণ রঙে। 

নানা মজার ঘটনায় ভরা তাঁর স্মৃতিকথা। কখনো উঠে আসে ভৃত্যবিভ্রাট। কমপক্ষে দশজন ভৃত্য ছাড়া চলা সম্ভব নয়, আর এদের সামলানোও মহা সমস্যা। কলকাতাবাসীর জীবনে এই সমস্যা দু শতাব্দী পরেও স্বমহিমায় বিরাজমান। কখনো দেখা মেলে এক মুনশীর, উনিশ শতকীয় কলকাতায় যে শ্রেণিটি ঔপনিবেশিক শাসনের ফসল। তিনি চালপড়ার পদ্ধতি প্রয়োগ করে চোর ধরে ফেলেন স্বচ্ছন্দে। ইউরোপীয় সমাজের চোখে সেসময়ের ভারত কুখ্যাত ছিল এই তুকতাক বা আধিভৌতিক কাজের জন্য। পার্কসগিন্নী স্পষ্ট বলেন যে তিনি চালপড়ায় বিশ্বাস করে ফেলেছেন। আবার পার্কসের স্মৃতিতে ভেসে আসে বাড়ির সর্বময় কর্তা সরকারমশাই এবং দস্তুরি খাওয়ার প্রচলিত অভ্যাস। এই দস্তুরি আজকের কমিশন তো বটেই, কুলোকে আবার কাটমানিও বলতে পারে। ঘটনাগুলো শুধু কয়েকটা ছবি নয়, বরংবার কলকাতা চেনার এক স্বচ্ছ আয়না। 

কলকাতা তো বটেই তবে প্রধানত উচ্চবিত্তের কলকাতা। আঠারো শতকের শেষ বা উনিশ শতকের গোড়ায় যেসব কমবয়সী সাহেবের দল এদেশের বন্দরে নোঙর ফেলত, তাদের অধিকাংশই ছিল জাতে রাইটার নয় সিভিলিয়ান।  বিলাসিতার চরম নেশা, হাতের সামনে রকমারি পশরা,  অথচ সীমিত মাইনে। কলকাতা বিশারদ শ্রীপান্থ হিসেব দিচ্ছেন পঞ্চাশ টাকা বাড়িভাড়া দিয়ে বাস করা সাহেব ছোকরার মাস গেলে খরচ প্রায়  তিন হাজার টাকা। তারা সবাই পেশায় রাইটার, আর তাদের এই উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন ঠেকাতেই নাকী রাইটার্স বিল্ডিং এ থাকার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে তারা কোম্পানির থেকে অতিরিক্ত খরচ না চাইতে পারে। এই হাতখোলা কুমার বাহাদুরদের একজনের কথা শুনিয়েছেন ফ্যানি। বেচারা এ দেশে এসেই পড়েছিলেন এক সুদখোরের হাতে। পনের হাজার টাকা ধার করেছিলেন এক সুদখোর মহাজনের থেকে যাঁদের লেখিকা চিহ্নিত করেন richest dogs নামে। সকৌতুকে ভয়ার্ত  ফ্যানি বলেন যে এদেশে যাঁরা নতুন আসেন তাঁদের বুঝতে বেশ সময় লাগে যে টাকা ধার করলে সুদ আর আসল মিলে এক আর এক মিলে এগার হয়ে যায়।  

পার্কস গৃহিণীর কলকাতাদর্শন কী ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে ? সম্ভবত না। ওয়েলসের সুশিক্ষিতা, কর্মঠ রমণী তাঁর ডায়েরির শুরুতেই জানিয়ে দেন এদেশের মানুষজন চূড়ান্ত অলস। খাওয়া আর ঘুমানো এছাড়া এদেশের ধনী লোকেদের কোনো কাজই নেই। তীব্র গরম মার্চ মাসে, সঙ্গে রয়েছে মশা নামক এক ভয়ানক প্রাণীর উৎপাত। তার কামড় একবার যে না খেয়েছে তাকে বলে বোঝানো কঠিন। আবহাওয়া আর মশা এই দুয়ের জোড়া ফলায় তিনশো সৈন্য কেল্লার হাসপাতালে ভর্তি, লিখছেন ফ্যানি। 

কেল্লাটি যে ফোর্ট উইলিয়াম তাতে সন্দেহ নেই। আর ফ্যানির লেখাটিকেও সেই ইউরোপীয়দের দলেই ফেলে দেওয়া যেত যাঁদের উন্নতনাসার গর্বের কাছে উনিশ শতকের ইন্ডিয়া মানে সাপ, ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রতন্ত্র আর মহামারীর দেশ। কোম্পানির শাসনের শুরুর দিকে সে কথার সত্যতাও অনেকটাই ছিল, এমনকী ইউরোপীয়ানদের রোগের হাত থেকে বাঁচাতে  কমিটি গড়ে ফিভার হসপিটাল অবধি বানাতে হয়েছিল শাসকদের। কিন্তু লেখিকার বিবরণ তো এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে যে কলকাতাকে সেই দুশো বছর আগেই তিনি দেখেছেন ‘সিটি অব জয়’ হিসেবে। 

 মুগ্ধ হন তিনি দরিদ্র চাকর বেয়ারাদের দেওয়া ক্রিসমাসের উপহারে। রেকাবির ওপর নানা খাদ্যদ্রব্য সাজিয়ে ফুলসহ মালকিনের হাতে তুলে দিয়ে বিনিময়ে ইনাম চায় বেয়ারারা। হাসিমুখে তাঁদের দাবি মেটান পার্কস দম্পতি। নিয়মিত আমন্ত্রণ আসে লাটভবন থেকে, কখনো হেস্টিংস অব মার্কুইসের ভোজসভা, কখনো লর্ড আমহার্স্টের নিমন্ত্রণ। বোঝা যায় ক্রফোর্ড মার্কস ততদিনে আরো উঁচু পদে অধিষ্ঠিত। 

আবার কখনো হাজির হয়ে যান ধনীগৃহের দুর্গোৎসবে। মহাসমারোহে দুর্গোৎসব করতে ধনী বাঙালিরা কত খরচ করেন সে ধারণা করতে লেখিকা অপারগ।  ১৭৫৮ এর  নবকৃষ্ণ দেব ক্লাইভের সাফল্যে দুর্গাপুজোয় একলক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন। তাহলে ১৮২৪ এর রাজা সমাজপতি রাধাকান্তের দৌড় নিশ্চয় আরো দূরপাল্লার। তবে যা সবচেয়ে বেশি যা নজর কেড়েছিল তা হল বাঈজী নাচ।  এমনি এক দেশীয় ধনী বাবুর বাড়ি আমন্ত্রণে গিয়ে দেখলেন বহুমূল্য পোশাকে সুশোভিত বাইজির দল, মাদকতাময় কটাক্ষ আর অতিথি আপ্যায়নের ঢালাও ব্যবস্থা। সেরা বাঈজীর নাম নিকী, তাঁর দর্শন পাওয়া মহার্ঘ্য সৌভাগ্য। সেখানে থরে থরে সাজানো বিদেশী মদ্য ও রকমারি বিলাসসামগ্রী। ইনি নেটিভ হলেও কলকাতার সমাজে রীতিমত সম্মানিত এবং সাহেবরাও তাঁকে যথেষ্ট সমীহ করেন। বাবুটির নাম রাজা রামমোহন রায়।

একা রামমোহন নন, তাঁর সহযোগী দ্বারকানাথও যে এক্ষেত্রে বিখ্যাত তা সর্বজনবিদিত।  কিন্তু পার্কসের এই মুগ্ধতার পাশাপাশি মনে রাখার কথা এটাই যে চৌরঙ্গিকেন্দ্রিক হোয়াইটটাউন আর ধনী বাবুদের সীমানার বাইরে তাঁর দৃষ্টি সেভাবে পৌঁছাল না। কালীঘাট মন্দির দেখতে গিয়ে পিঠে বাণ ফুঁড়ে চড়কে ঘোরা দেখে তিনি শিহরিত। এই বীভৎস দৃশ্য দেখেও হাজার হাজার লোক উল্লাস করছে, এ দৃশ্য নারকীয় ঠেকেছে তাঁর চোখে। কিন্তু যদি তাঁর সীমানার মধ্যে পটলডাঙা, চিৎপুর বা হাড়কাটার মত দেশী পাড়া আসত তাহলে হয়তো প্রকৃত নরকে বসবাসের ছবিটা দেখতে পেতেন তিনি। ঘোড়ার গাড়ি, ভোজসভা আর গির্জার বাইরে তাঁর দৃষ্টি সেভাবে পৌঁছাল না এ দুঃখ পাঠকেরও। কাজেই তাঁর লেখা অসাধারণ ট্র্যাভেলগ, কিন্তু কলকাতার শ্রেণিবিভক্ত সমাজকে চেনার দলিল নয়। সেজন্য আমাদের নেটিভদের লেখার উপরই নির্ভর করতে হবে, আরো বছর চল্লিশেক বাদে হুতোমের হাতে সেই ছবিটা আঁকা হবে। 

কলকাতার পালা সাঙ্গ করে ক্রফোর্ড পার্কস গিয়েছিলেন এলাহাবাদ ও বারাণসী, আগ্রা ইত্যাদি নানা শহরে। শ্রীমতী পার্কস সেসব শহরে কোথাও দেখেছেন ঠগীদের দাপট, ধরা পড়ার পর শুনেছেন তাঁদের আশ্চর্য জীবনের কথা, কোথাও বা কলেরার ধ্বংসলীলা। সবচেয়ে বেশি তাঁকে প্রভাবিত করেছিল তাজমহলের সৌন্দর্য। আর বিস্ফারিত চোখে দেখেন এলাহাবাদের জেনানামহল। সে অধ্যায়ে তাঁর শিরোনাম plurality of wives. ব. আমাদের বর্তমান আলোচ্য কলকাতা তাই দীর্ঘায়িত না করে এটুকু বলে রাখা ভালো সতীদাহের ভয়াবহতা বহির্বঙ্গেই দেখেছিলেন পার্কস। অনিচ্ছুক মহিলাকে জোর করে দাহ, পৈশাচিক উল্লাস এবং মুসলিমদের দূর থেকে মজা দেখা পার্কসের চোখে নেটিভ স্টেটের সংজ্ঞাটা পরিষ্কার করে দিয়েছিল। 


এখানেই চলে আসে আরো একটা প্রশ্ন। সতীদাহ কী বাংলাতেও হত না? সেখানে তো তা দেখতে পাননি পার্কস। কারণ তাঁর কলিকাতা দর্শন ব্রিটিশ নগরীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ১৮১৫ থেকেই সতীদাহ বিরোধী পদক্ষেপ শুরু হয় কলকাতায় তাই ১৮২২ এর পরে সে প্রকোপ বেশি ছিল গ্রামবাংলা ও জেলায়। পার্কসের ভারতবর্ষ মূলত শহরকেন্দ্রিক, সেখানে বাংলা বলতে কলকাতা-ই। বইটি অনেকটা H.E.Busteed এর বইটির মত(Echoes from old Calcutta). সে বইটি আসলে কোম্পানির প্রথম যুগের কলকাতার এক রমণীয় আখ্যান। জনজীবনের কোনো জায়গা সেখানে নেই। পার্কসের কলকাতা তথা ভারতদর্শনও প্রধানত উপরমহল থেকে। ক্লেদাক্ত, অত্যাচারিত দেশীয় সমাজ সেখানে অপ্রধান। 

অবশ্য ইতিহাসলেখিকা হতে চাননি ফ্যানি।  প্রবেশকপত্রের(Invocation) শিরোনামটি দেবনাগরী অক্ষরে। শেষ করছেন যে লাইনে তা হল- “May it be said, “Ah! She writes like Ganesha”. সমাপ্তিতে রয়েছে ইংরেজি অক্ষরে লেখা ‘সালাম’। 

সার্থক pilgrimage হিসেবে এদেশকে না ভাবলে কী এই ভূমিকা লিখতে পারেন একজন শ্বেতাঙ্গিনী?


#কলকাতা #উনিশ শতক #বিদেশিনী #উপনিবেশ #ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি #গোরা নেটিভ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

83

Unique Visitors

183101