প্লেনফিল্ডের কসাই
.................
গায়েব!
একজন জলজ্যান্ত মহিলা খটখটে দিনের আলোতে আচমকা ভ্যানিশ হয়ে গেলেন…
১৯৫৭ সালের ১৬ নভেম্বরের কথা। আমেরিকার প্লেনফিল্ডে ছোট্ট হার্ডওয়ারের দোকান ছিল বেনিস ওয়ার্ডেনের। বৃদ্ধা বেনিসের বয়স প্রায় ষাট। পায়ে গেঁটে বাত। স্বামী মারা গেছেন। কাছের লোক বলতে ছেলে ফ্র্যাঙ্ক। সে আবার এই ছোট্ট শহরের ডেপুটি শেরিফ। ঘটনার দিন সকাল থেকে খদ্দের বিশেষ ছিল না। স্বাভাবিক। তখন ওপেন সিজন চলছে। সবাই হরিণ শিকারে মত্ত। তাই দোকানে কে আসছে-যাচ্ছে দেখার ফুরসৎ কারও ছিল না। রোজকার মত ভোরে বেনিস দোকান খোলেন। সন্ধে পাঁচটা নাগাদ ছেলে ফ্র্যাঙ্ক দোকানে কি একটা কাজে এসে দেখেন দোকান ফাঁকা, মা নেই, ক্যাশ রেজিস্টার খোলা। ক্লু বলতে মেঝেতে জমাট বাঁধা রক্ত।
শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ। বুড়ির কোনও শত্রু ছিল না। ছেলেকেও ভালবাসতেন প্রাণ দিয়ে। তাঁর ক্ষতি কে চাইবে? কথায় কথায় ফ্র্যাঙ্ক জানালেন আগেরদিন বেনিস ছেলেকে বলছিলেন আজ সকালে এক গ্যালন অ্যান্টিফ্রিজ নিয়ে এড গেইনের আসার কথা। এড গেইন একটু দূরেই থাকেন। এক বড় ফার্মের মালিক। একটা মুদিখানার দোকানও আছে তাঁর। সে মাঝেমাঝেই বেনিসদের দোকানে নানা টুকিটাকি জিনিস সাপ্লাই দেয়। এই একটামাত্র লিড নিয়ে পুলিশ এবার দোকানের সেলস স্লিপ খোঁজা শুরু করল। বেশি খুঁজতে হল না। একেবারে উপরেই রাখা সেই এক গ্যালনের অ্যান্টিফ্রিজের স্লিপ। তাতে গেইনের সই। সেদিনের তারিখে। তাহলে হয়তো গেইনই শেষবারের মত বেনিসকে দেখেছেন। পুলিশ ছুটল গেইনের মুদিখানার দোকানে। শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ। গেইন পুলিশের চোখের দিকে তাকাচ্ছিল না। কথা বলছিল আমতা আমতা করে। পুলিশ কিছুতেই বুঝতে পারছিল না একেবারে শান্ত, ভীতু এই লোকটা এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন? ঠিক করা হল দোকান না একবার গেইনের বাড়ি সার্চ করে দেখতে হবে।
ওয়াউসারা কাউন্টির শেরিফের অনুমতিতে প্রথমবার গেইনের ফার্ম হাউস সার্চ করা হল। প্রথমেই গেইনের রান্নাঘরে বেনিসকে পাওয়া গেল। মুন্ডুহীন। দেহে একটা সুতো-ও নেই, একটা ক্রসবারে উলটো করে ঝোলানো, হাত দড়ি দিয়ে বাঁধা। কিন্তু এসব কিচ্ছু না। পুলিশ চমকে গেল মহিলার বুক-পিঠ দেখে। কেউ যেন নিপুণ হাতে হরিণের চামড়া ছাড়ানোর মত মহিলার গোটা দেহের চামড়া ছাড়িয়ে নিয়েছে। বুকে একটা ক্ষতর দাগ। .২২ ক্যালিবারের বন্দুক দিয়ে গুলি করে প্রথমে ভবযন্ত্রণা ঘুচিয়ে তারপর এই কাজ করেছে অপরাধী।
পুলিশ ভেবেছিল এটুকুই একদিনের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তখনও তাঁদের জন্য আরো অনেক বিস্ময় বাকি ছিল। গেইনের ঘরভর্তি নানা অদ্ভুত আসবাব। করোটি, হাতের হাড় দিয়ে তৈরি ফুলদানি, মানুষের মুখের তৈরি ল্যাম্পশেড, মানুষের চামড়ায় ঢাকা চেয়ারের গদি। কেন খুন করলে বেনিসকে? উত্তরে একেবারে শান্ত এড জানালো “আমার মাকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে। মায়ের জন্য একটা চামড়ার পোশাক বানাবো ভেবেছিলাম। আপনারা তো সেটা করতেই দিলেন না।”
এর আগে এমন অদ্ভুত খুনের মোটিভ কেউ শোনেনি। বোঝা গেল এই খুন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। দীর্ঘদিন চলতে থাকা কোন মানসিক বিকারের ফলমাত্র। এগিয়ে এলেন মনোবিদরা। উঁকি মারতে চাইলেন গেইনের মনের অন্ধকারে আর খুঁজে পেলেন এমন সব তথ্য যা তাঁদের মত ইস্পাতদৃঢ় মানুষদেরও হাড়হিম করে দিল।
গেইনের গল্প
এড গেইনের জন্ম উইসকনসিনে। ১৯০৬ সালের ২৭ অক্টোবর। মা ছিলেন পরম ধার্মিক ক্যাথলিক খ্রিস্টান। ছোটো থেকেই গেইন আর তাঁর দাদা হেনরির জীবনে মা ছাড়া আর কেউ নেই। বাবা মদ্যপ। আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। মা তাঁদের শিক্ষা দিতেন। শিক্ষা দিতেন বাবাকে ঘৃণা করার। বলতেন এই দুনিয়া বড্ড পঙ্কিল আর সেই পঙ্কিলতার দ্বার হল মেয়েরা। মেয়েরা নরকে নিয়ে যায়। তাই ওদের থেকে দূরে থাকিস বাছা। আর হ্যাঁ। জীবনে কোনোদিন মদ খাবি না। দুইবেলা মন দিয়ে পড়তে হত বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট আর বুক অফ রেভেলেশন। পড়তে হত মৃত্যু আর মরা মানুষের বেঁচে ওঠার কথা।
যখনই মা অগাস্টার মনে হত কোনও ছেলে তাঁর কথার অবাধ্য হচ্ছে, তিনি শাস্তি দিতেন। বন্ধ ঘরে আটকে রাখা, চাবুক, সব চলত। অগাস্টা এবার স্বামীকে জোর করতে শুরু করলেন। উইসকনসিন পাপের আড়ত। এখানে থাকলে ছেলেরা নষ্ট হয়ে যাবে। স্ত্রীর কথা ফেলতে পারলেন না জর্জ। নিজের দোকানটা বেচে দিয়ে বড় একটা ফার্ম হাউস কিনলেন প্লেনফিল্ডে। আশেপাশে কেউ নেই। এতদিনে অগাস্টা যা চাইছিলেন, তা হল। দুই ছেলে একেবারে নিজের আয়ত্তে। প্রথমে তাঁদের স্কুলে দিলেন। পরে বুঝলেন এভাবেও ছেলেরা হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। ফলে স্কুল বন্ধ হল। তিনি নিজেই ছেলেদের শিক্ষিকা হয়ে উঠলেন। ছেলেরা কোনও বন্ধু বানানোর চেষ্টা করলেই নেমে আসত শাস্তির খাঁড়া। হেনরি মাঝেমাঝে প্রতিবাদ করত। কিন্তু এডের চোখে মা-ই সব। মায়ের জন্য সে সব কিছু করতে রাজি, এমনকি খুন-ও। আর মায়ের জন্যেই সে দাদাকে খুন করল। সেই তাঁর প্রথম খুন।
১৯৪৪ সালের শুরু থেকেই হেনরি এমন এক কাজ শুরু করল যার ক্ষমা নেই। হেনরি ডেটিং শুরু করল। তাও এমন এক মহিলার সঙ্গে যে ডিভোর্সি, দুই বাচ্চার মা। অগাস্টা না জানলেও এড জানত, হেনরি ওই মহিলাকে নিয়ে ভেগে যাবার পরিকল্পনায় আছে। বারবার ওকে অনুরোধ করত এমন না করার। মা দুঃখ পাবেন। হেনরি শোনে নি। মহিলার সঙ্গে হেনরির সম্পর্কের কথা সে মাকে বলতে বাধ্য হয়। তারপরেই প্রায় রোজ হেনরির সঙ্গে মায়ের তুমুল ঝগড়া বাঁধত। বাবা বছর চারেক আগে মারা গেছেন। সুতরাং গোটা বাড়িতে ধীরে ধীরে হেনরি একা হয়ে যেতে লাগল।
১৬ মে দুইভাই মিলে ঠিক করল খামারের শুকনো পাতা ডাল পুড়িয়ে দেবে। এডের কথা অনুযায়ী সেদিন শুরু থেকেই হেনরি মায়ের নামে যা তা বলছিল। তাকেও মায়ের পা-চাটা কুকুর বলে গাল পাড়ছিল। এক সময় পর এড আর সহ্য করতে পারেনি। বেলচার ঘা মেরে দাদাকে খুন করে। তারপর সব শুকনো খড়-পাতা জ্বালিয়ে দেয়। আগুন এতটাই বেড়ে গেল যে দমকল ডাকতে হল। দমকল এসে আগুন নেভায়। সেই আগুনে আধপোড়া অবস্থায় হেনরির দেহ পাওয়া যায়। সবাই ভেবেছিল নেহাত দুর্ঘটনা। এডের কাছে চরম আনন্দের দিন। এতদিনে আর কোনও বাধা নেই। সে আর তার মা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে।
এক বছর ঘুরতে না ঘুরতে কার্ডিয়াক স্ট্রোকে অগাস্টার দেহের এক অংশে প্যারালাইসিস হয়ে যায়। তিনি চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েন। অতি যত্নে মায়ের সেবা করতে থাকেন এড। এর মধ্যে এক ঘটনা ঘটে। পাশেই স্মিথ নামে এক ভদ্রলোক একদিন এক কুকুরকে নিষ্ঠুরভাবে পেটাচ্ছিল। এক মহিলা নাকি বারবার মানা করা সত্ত্বেও স্মিথ শুনছিল না। অগাস্টা এই দৃশ্য দেখে ভয়ানক আপসেট হয়ে পড়েন। স্মিথ কুকুরকে মারছিল দেখে না। ওই মহিলাকে চিৎকার করতে দেখে। “মেয়েছেলেটা স্মিথের রক্ষিতা। এক বেবুশ্যে মাগী। তার এতবড় সাহস, স্মিথের মুখে মুখ করে! কী দিন এল!!” এডের কথায় এই ঘটনার পরেই অগাস্টার দ্বিতীয় স্ট্রোক হয়। সাতষট্টি বছর বয়েসে অগাস্টা মারা যান। একেবারে একা। তাঁর একমাত্র বন্ধু, সত্যিকারের ভালবাসাকে হারিয়ে এই গোটা দুনিয়ায় এড একেবারে একা হয়ে যায়। এড ঠিক করে মাকে মরতে দেওয়া যাবে না। বাঁচিয়ে রাখতে হবে চিরকালের মত।
মায়ের মন্দির
এড যতবার নিজের বাড়ির কথা বলেছে, প্রতিবার বাড়িকে মায়ের মন্দির (Mother’s shrine) নামে উল্লেখ করেছে। মা মারা যাবার সময় গোটা বাড়ি ঠিক যেমন ছিল তেমন ভাবে রেখে সে নিজে ছোট্ট একটা বাথরুমে থাকতে শুরু করে। এবার তার অবসর বিনোদনের অন্যতম উপায় হয় এতকালের নিষিদ্ধ সব বই। নাৎসিদের বীভৎস সব পরীক্ষা, মানুষের অ্যানাটমি, হরর স্টোরি এবং… হ্যাঁ, পর্নোগ্রাফি। যদিও কোন জীবন্ত মহিলাকে সে ভোগ করতে পারত না। মায়ের বারণ ছিল। প্রায় তিন বছর ধরে এই অদ্ভুত ফ্যান্টাসির জগতে থাকার পর সে ঠিক করল এতদিনে সে নিজের স্বপ্নকে রূপ দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। এবার তাকে কাজে নামতে হবে। মায়ের মন্দিরকে সম্পূর্ণ করার কাজ।
এক ঘোরের মধ্যে, সে হানা দিতে শুরু করল আশেপাশের কবরখানাগুলোতে। তুলে আনতে লাগল মহিলাদের দেহ। সেই সব মহিলাদের, যাদের বয়স তার মায়ের কাছাকাছি ছিল। সে চেয়েছিল নতুন চেহারায়, নতুন ভাবে মাকে বাঁচিয়ে তুলতে। কারও হাত, কারও পা, যার যেটা নিজের মায়ের মতো মনে হত, সে জমিয়ে রাখত। বাকি অংশ দিয়ে বানাত চেয়ারের ঢাকনা, টেবিল ল্যাম্প, পেপারওয়েট। নাৎসিরা যেমন করত। যখন কবরখানায় মনমতো দেহ পাওয়া যেত না, তখন সে বাধ্য হয়ে খুন করত। যেমন দুই বছর আগে মেরি হোগানকে করেছিল। পুলিশ খুনির কোনও হদিশ পায়নি। তার কথা উঠতেই হাসিমুখে হোগান বলেছিল “She isn't missing. She's at the farm right now.” মায়ের দেহটা তৈরি প্রায় শেষ হয়েই গেছিল। বাকি ছিল সেই দেহকে চামড়া দিয়ে ঢাকা। এই চামড়াটুকুর জন্যেই বেনিস ওয়ার্ডেনের দরকার। বেনিস দেখতেও অনেকটা অগাস্টার মত, বিধবা। আর বয়সও অনেকটা মিলে যায়। এডের কাছে অন্য উপায় ছিল না। মায়ের মন্দিরে মায়ের মূর্তি শেষ করতেই হত।
শিশুর মতো
যতজন গোয়েন্দা বা পুলিশ এডকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, সবাই প্রায় একবাক্যে জানিয়েছেন মিডিয়া যতই তাঁকে “বুচার অফ দ্য প্লেইনফিল্ড” বলুক এড আসলে একটা ছোট্ট বাচ্চার মত। সে যা করছে, তা যে আসলে অপরাধ, সেটা বোঝার ক্ষমতা অবধি তাঁর নেই। অদ্ভুত হাসিখুশি, নিজের মজায় নিজেই হাসছে, আলাপ করছে। যেন যা যা ঘটেছে, এর একটাও হয়নি। তখনও আমেরিকায় অপরাধের ক্ষেত্রে মনোবিদদের তেমন সাহায্য নেওয়া হত না। কিন্তু এবার নেওয়া হল। মনোবিদরা তাঁকে পরীক্ষা করলেন। জানালেন স্কিৎজোফ্রেনিয়ার একেবারে টিপিক্যাল কেস ঘটেছে এখানে। মা অগাস্টার ব্যক্তিত্বে এডের নিজের ব্যক্তিত্ব একেবারেই গড়ে উঠতে পারেনি। মানসিকভাবে সে এখনও বছর পাঁচেকের এক শিশু, মায়ের সাহায্য ছাড়া এই অকরুণ পৃথিবীতে যে নিতান্তই অসহায়। এই সবকিছু আসলে তার নিজের মাকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা। আর কিছু না।
১৯৫৭ সালে শুধুমাত্র বেনিসের খুনের দায়ে এডকে সোপর্দ করা হয়। পুলিশ আগেই বুঝেছিল, এ শাস্তি পাবে না। তাই বাকি খুনগুলির দায়ে তাকে আর অভিযুক্ত করেনি। যথারীতি গেইনকে মানসিকভাবে অসুস্থ ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৪ সালে ফুসফুসের ক্যান্সারে মারা যাবার আগে অবধি গেইনের জীবন কেটেছিল মেন্ডোটার পাগলাগারদে। “অত্যন্ত ভদ্র, শান্ত আর বাধ্য রোগী। এমনটা পাওয়া যায় না” বলেছিলেন হাসপাতালেরই এক ডাক্তার। “ঠিক যেমন বাধ্য বাচ্চারা হয়।”
সাইকো
১৯৫৭-র এই আশ্চর্য ঘটনাকে উপন্যাসে নিয়ে আসেন রবার্ট ব্লচ। লেখেন তাঁর বেস্টসেলিং নভেল “সাইকো”। দেনার দায়ে গলা অবধি ডুবে থাকা আলফ্রেড হিচকক এই বইটাকেই বেছে নেন তাঁর শেষ অবলম্বন হিসেবে। জানতেন এই ছবি হিট না করলে, তাঁর ক্যারিয়ার শেষ। সিনেমায় এড গেইন বদলে গেলেন নর্মান বেটসে। ফার্ম হাউস হয়ে গেল মোটেল। বাকিটা ইতিহাস। এর পরেও ‘টেক্সাস চেন স ম্যাসাকার’ কিংবা ‘সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্বস’-এ নানারূপে ফিরে ফিরে এসেছেন এড গেইন। নতুন নামে। নতুন চেহারায়। ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যান আসল লোকটা, যে লোকটা বারবার বলত “If the skin fits, just wear it”
.....................
#Butcher of Plainfield #Ed Gein #Serial Killer