ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

রুটি, অপেক্ষা, পুরুষতন্ত্র : মণি কওলের 'উসকি রোটি'

টিম সিলি পয়েন্ট Oct 2, 2020 at 5:59 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

ফিল্ম : উসকি রোটি
পরিচালক : মণি কওল
মুক্তি : ১৯৬৯
কাহিনি ও সংলাপ : মোহন রাকেশ
অভিনয় : গুরদীপ সিংহ, গরিমা, রিচা ব্যাস, সবিতা বজাজ
মিউজিক : রতন লাল
সিনেমাটোগ্রাফি : কে. কে. মহাজন

ছয়-সাতের দশকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে নবীন একদল চলচ্চিত্র-নির্মাতা ভাবনা ও স্টাইলের দিক থেকে একটা বড়সড় পালাবদল আনার চেষ্টা করেছিলেন। এঁরা ছিলেন প্রখরভাবে সমাজ-সচেতন। ফলে এঁদের ছবিগুলি ছিল জনতোষিণী গল্প বা উপাদান পরিবেশন থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। এই মোড় ঘোরানোর চেষ্টাকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে ‘নিউ ওয়েভ’ বলে চিহ্নিত করা হয়। শ্যাম বেনেগল, গোবিন্দ নিহালনি, মণি কওল, এম এস সথ্যু, রাজিন্দর বেদী, সত্যপাল দুবে প্রমুখ এক ঝাঁক নতুন মুখ নতুন ভাবনা, নতুন স্টাইল নিয়ে ছবি বানাতে চলে এলেন। সব দিক থেকে যে এঁদের মিল ছিল তা নয়। এঁদের কেউ কেউ বক্তব্য-প্রধান ছবি বানিয়েছেন, কেউ আঙ্গিককে গুরুত্ব দিয়েছেন। কেউ প্রায় সরাসরি সমাজ-বিপ্লবকে সমর্থন করে ফেলেছেন, কারো অস্ত্র শিল্পিত প্রতিবাদ। মিল একটাই। এঁরা কেউই ফিল্মকে নিছক বিনোদনের সামগ্রী বলে ভাবেননি।  

মণি কওলের এই ছবিকে ‘নিউ ওয়েভ’ চলচ্চিত্র-ধারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনগুলির মধ্যে একটি বলে মনে করা হয়। পুনে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনসটিটিউটের ছাত্র হিসেবে কাউল ঋত্বিক ঘটকের মতো ব্যক্তিত্বকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন। তাঁর প্রভাব অস্বীকার না করলেও কওল নিজে অবশ্য ভারতীয় চলচ্চিত্রে কাউকেই নিজের পূর্বসূরি বলে মানতে চান না। ফরাসি চলচ্চিত্রকার রবার্ট ব্রেসনের প্রতি অকুণ্ঠ ঋণ স্বীকার করেছেন একাধিকবার। ‘উসকি রোটি’ তাঁর প্রথম ছবি, আর প্রথম ছবি থেকেই তিনি যেন নিজের আঙ্গিক বা স্টাইল নিয়ে মোটের ওপর নিশ্চিত। কাহিনিকার হিন্দি সাহিত্যের নতুন ধারার মহারথী মোহন রাকেশ। কোনও তারকা অভিনেতাকে কওল এ ছবিতে তিনি নেননি। 

এ ছবি এক নারীর গল্প। ন্যারেটিভে রিয়ালিস্টিক ভঙ্গি মণি কওল একেবারে ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন। দৃশ্যায়নে ধারাবাহিকতা রাখেননি একেবারেই। নারীটি কাপড়ে বাঁধা রুটি তরকারি নিয়ে বাসস্টপে অপেক্ষা করে। রুটি নিয়ে অপেক্ষা করা এবং পুরুষটির হাতে তা তুলে দেওয়া- মূলত এই নিয়েই গোটা একটা ছবি বুনে তোলেন পরিচালক। নারীর অপেক্ষা দিয়ে দর্শকেরও ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেন তিনি। পুরুষ, অর্থাৎ ট্রাক-ড্রাইভার সূচা সিং কিন্তু নিজের মতো করে রঙিন জীবন কাটায়। বন্ধুদের সঙ্গে তাস খেলে, মৌজ করে, উপপত্নীর সঙ্গে সময় উপভোগ করে আর সপ্তাহে একবার মাত্র বাড়ি ফেরে। কিন্তু মেয়েটি, অর্থাৎ তার স্ত্রী বালো, আটকে থাকে ওই রুটি নিয়ে অপেক্ষার রুটিনেই। স্ত্রী বা ‘মেয়েমানুষের’ বাধ্যতামূলক ছক। একদিন নিজের বোনকে এক লোভী পুরুষের খপ্পর থেকে বাঁচাতে গিয়ে খাবার নিয়ে যথাসময়ে পৌঁছতে পারে না বালো। সূচা সিং রাগ করে খাবার না নিয়েই চলে যায়। ওদিকে বালো দাঁড়িয়ে থাকে অনন্ত অপেক্ষায়। রাত নেমে আসে। পরিচালকের রাগ, অস্থিরতা এ ছবির সর্বাঙ্গে। রাগ, বলাই বাহুল্য, পুরুষতন্ত্রের প্রতি। তবু সুতো বেরিয়ে যায়নি তাঁর হাত থেকে। তার জন্য অনেকটা সাধুবাদ প্রাপ্য সিনেমাটোগ্রাফার কে. কে. মহাজনেরও। এক-একটা ফ্রেম এতই অনবদ্য যে, খুব রাগী কবিতার মতো লাগে এ ছবিকে। সে সময় ‘উসকি রোটি’ বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পায়নি, কারণ পরিবেশকরা নিশ্চিত ছিলেন এ ছবির দর্শক জুটবে না। তবে কওল এই ছবির জন্য ১৯৭০ সালের ফিল্মফেয়ার ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। 

ইউটিউবে ছবিটি রয়েছে। ফিল্ম যদি আপনি বিনোদনের জন্য দেখেন তবে এ ছবি আপনার জন্য নয়। কওলের ন্যারেটিভ আপনাকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লান্ত করে দেবে। ফিল্ম নামক শিল্পমাধ্যমটির প্রতি আপনার ভালোবাসা বা আন্তরিক আগ্রহ থাকলে, ‘উসকি রোটি’ অবশ্যই দেখুন। মণি কওলকে পাঠ করুন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ‘নিউ ওয়েভ’ কেন ‘নিউ ওয়েভ’, তা বোঝার ‘মেড ইজি’ হতে পারে এ ছবি।     

#Uski Roti #Mani Kaul #Hindi film #Filmfare Critics Award for Best Movie #Mohan Rakesh #Indian New Wave #Garima # K. K. Mahajan #আর্ট ফিল্ম #নিউ ওয়েভ ফিল্ম #মণি কওল #মোহন রাকেশ #টিম সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

48

Unique Visitors

219191