নিবন্ধ

বঙ্গভূমে রক্ততৃষা

চয়ন সমাদ্দার Oct 22, 2021 at 7:32 pm নিবন্ধ

মেরি শেলির ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’-এর মতো ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ গথিক সাহিত্যের এক আইকন। স্টোকারের বইয়ের প্রভাব এতটাই বেশি যে, রক্তপায়ী, না-মৃত, ভ্যাম্পায়ার আর ‘ড্রাকুলা’ শব্দটি সমার্থক হয়ে গেছে, ১৮৯৭ সালে, এই বই প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে। পাঠকসমাজ ভুলেই গেছে, ব্রাম স্টোকারের আগেও, ভ্যাম্পায়ার নিয়ে লেখা হয়েছে। অষ্টাদশ শতক থেকে, পাশ্চাত্যে ভ্যাম্পায়ারদের নিয়ে রচিত কাহিনির প্রতি আগ্রহ দেখা যায় এবং রোমান্টিক যুগে, ১৮১৯ সালে, জন পলিডরির ‘দ্য ভ্যাম্পাইয়ার’ বিভিন্ন রকম ভ্যাম্পায়ার লোর-কে ন্যারেটিভের সুতোয় গেঁথে, অনেক সমালোচকের মতে, সর্বকালের সেরা ও প্রভাবশালী হরর সাহিত্য রূপে আত্মপ্রকাশ করে।

তবু, আজ, ভ্যাম্পায়ার বললেই, পলিডরির সৃষ্টির বদলে, ব্রাম স্টোকারের রচনা মাথা তুলে দাঁড়ায় কেন? কারণ, স্টোকার ভ্যাম্পায়ারের গল্পের সঙ্গে, তাঁর সমকালীন আধুনিকতাকে, বিজ্ঞানের জয়যাত্রা আর ধর্মের অবক্ষয়কে, ব্রিটেনে নারীর অবস্থান এবং শ্বেতদ্বীপ ও অপর সংস্কৃতির মধ্যে সম্পর্ককে, এমনভাবে জুড়ে দিয়েছেন; এমনভাবে হাজির করেছেন পাগলামি, যৌনতা, ভিন্ন শ্রেণী ও জাতির সঙ্গে তাঁর স্বদেশের সম্পর্ক, যে, ‘ড্রাকুলা’ উপন্যাস রাজনীতি আর প্রসঙ্গ বা কনটেক্সট নির্ধারিত, এক আধুনিক মিথ হয়ে দাঁড়িয়েছে : যাকে  বিভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ভিন্ন কালে, নিজের মতো করে কাজে লাগাতে পেরেছে। তাই, এর আবেদন এতটা সর্বকালীন। 

আমরা মনে করতে পারি, ‘ড্রাকুলা’ তে কেমনভাবে ডাইরি, খবরের কাগজের রিপোর্ট, ফোনোগ্রাফের ট্রানস্ক্রিপশন, লগবুক আর অন্য ডাটা ব্যবহার করা হয়েছে। নব্য নারী মিনা হার্কারের কথাও মনে করতে পারি। টাইপরাইটিং আর ফাইলিং-এ দক্ষ মিনা, জাহাজ ছাড়ার সময় আর ট্রেনের টাইম টেবল্‌ যার নখদর্পণে, নিজেই যেন মূর্তিমতী সার্চইঞ্জিন হয়ে ওঠে। সম্মোহনের প্রভাবে সে হয় এক অকাল্ট টেলিফোন। ড্রাকুলার সাইকিক নাম্বার ডায়াল করে, তার খবর নেয় সে। আবহাওয়ার আপডেট তার জানা, ট্র্যাভেল রিপোর্টের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল, এবং ‘অপরাধী মন’ সম্বন্ধে আধুনিকতম তথ্য তার আয়ত্তে। অনেক সমালোচক বলেন, উন্নততর যোগাযোগ ব্যবস্থাই আসলে হারিয়ে দেয় রক্তশোষা কাউন্টকে, যে পুরনো দিনের ব্লু-বুক আর সিভিল লিস্টের ভরসায় ব্রিটিশ রাজের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে চিনে, তার ওপর ভেতর থেকে হামলা করতে চায়।

‘ড্রাকুলা’ উপন্যাসে প্রযুক্তির গথিকায়ন ঘটে। টাইপরাইটিং, টাইম টেবল্‌, ফোনোগ্রাফ, টেলিগ্রাম, সংবাদপত্র, আধুনিক ওষুধপত্র, ব্লাড ট্রানসফিউশন, ব্রেইন সার্জারি- সবই ভ্যাম্পায়ারের মতো অশুভ, জীবন্ত প্রেতের সঙ্গে যুদ্ধের আয়ুধ হয়ে ওঠে। যন্ত্রপাতিও অকাল্ট হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেতার যোগাযোগ, মিনার হিস্টিরিয়া‍, লুসির স্লীপ ওয়াকিং, রেনফিল্ডের বিচিত্র পাগলামি- সবই সমান দুর্বোধ্য রূপে উপস্থাপিত হয়। ভ্যান হেলসিং বলেন, বিদ্যুৎ আবিষ্কর্তারা নিজেরাই নিজেদের আবিষ্কারকে কিছুদিন আগে নারকীয় বা কালা জাদুর অপত্য বলে ডাকতেন। সত্যি বলতে, অতিলৌকিক আর লৌকিকের মধ্যে কোনও তফাৎ করে না ‘ড্রাকুলা’। সর্বগ্রাসী ভিক্টোরিয়ান, বাজারি ভোগবাদ আর ভ্যাম্পায়ারের রক্ততৃষা এখানে এক হয়ে যায়। কাউন্ট ড্রাকুলা দেওয়াল বেয়ে সরীসৃপের মতো চলে, শ্বদন্ত বিঁধিয়ে রক্ত চোষে; আবার সেই আধুনিক মানুষের মতো আইন আর ব্যবসাতে আগ্রহ দেখায়। আজকালকার ভাষায় প্রপার্টি পোর্টফোলিও বানায়, নিজের বিনিয়োগের জন্য, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখে। 

ভ্যাম্পায়ারদের কাছে মানুষ জিনিসপত্তর। ভোগবাদী সমাজের কাছেও তাই। ভ্যাম্পায়ার তার শিকারকে দেহে-মনে-সত্তায় গ্রাস করে। বাজারি অর্থনীতিও তাই করে। এবং এই গ্রাস করাটাকে খুব উত্তেজক, অসম্ভব রতিউদ্দীপকভাবে আখ্যায়িত করে ব্রাম স্টোকারের কাহিনি। তিন পিশাচী যখন জোনাথন হার্কারের রক্ত চুষতে আসে, তখন তাদের কামুকতা, ফাঁক হওয়া ঠোঁট চাটা, তাদের বেঁকে যাওয়া শরীর, আর গলায় ঠোঁট ছোঁওয়ানোর বর্ণনা থেকে যদি যৌনতাকে আমরা নাও চিনি, ১৯৯০ সালে নির্মিত, ফ্রান্সিস ফোর্ড কাপোলার, ‘ব্রাম স্টোকারস্‌ ড্রাকুলা’ ছবিতে এই অংশের চিত্রভাষ্য দেখলে কোনও সংশয়ই থাকে না। আমরা মনে করতে পারি সেই দৃশ্য, যেখানে, মিনার খাটের পাশে ড্রাকুলা দাঁড়ানো। নিজের নগ্ন বুক থেকে ঝরা রক্তের দিকে মিনার মুখটাকে টেনে আনছে, মিনার সাদা রাত পোশাক রক্তে ভেজা, ঠোঁট ফাঁক, বুক ছুঁল বলে। মধ্যবিত্ত গৃহবধূকে ধর্ষণ করতে যাচ্ছে, এক বুভুক্ষা : ক্ষমতাশালী অভিজাতর অথবা সর্বগ্রাসী বাজারের। 

ড্রাকুলা একাধারে দুই-ই। এবং আরও কিছু। এমনি এমনিই তার বাসভূমি ট্রানসিলভেনিয়া নয়। ব্রাম স্টোকার প্রথমে ড্রাকুলার দুর্গ-প্রাসাদ স্টিরিয়াতে দেখাতে চেয়েছিলেন। পরে সচেতনভাবে পূর্ব ইওরোপে নিয়ে আসেন। এবং এতে ‘ড্রাকুলা’ বইটির ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপট স্পষ্ট হয়। ১৮৮০ থেকে ১৮৯০ পর্যন্ত এই অঞ্চলে নিজেদের অপরজাতিবৈরিতা থেকে সৃষ্টি হওয়া টেনশন ব্রিটিশ সরকারের যথেষ্ট শিরঃপীড়ার কারণ হয়েছিল। কাউন্ট ড্রাকুলা, জোনাথনকে বলে, ‘এই অঞ্চলে, এক ফুট জমিও নেই, যা মানুষ, দেশপ্রেমী বা হানাদারের রক্তে সমৃদ্ধ হয়নি।’ ড্রাকুলা এই রক্তে ভেজা মাটির কায়ারূপ, যে নিজেকে ইংরেজের রক্তে সমৃদ্ধ করতে চায়। বিজিত জাতির প্রতিনিধি, এই ভ্যাম্পায়ারের বিজেতা ইংল্যন্ডে রক্তবর্ণ বিজয় ধ্বজা ওড়ানোর ইচ্ছেকে, অনেক তত্ত্ববিদ ‘উল্টো ঔপনিবেশিকতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে, শেষ বিচারে, রুল ব্রিটানিয়া বলতেই হয় লেখককে, ড্রাকুলা পরাস্তও হয়। কিন্তু, ঔপনিবেশক বয়ানটা সমস্ত কথাশরীর জুড়ে বজায় থাকে। 

আর, এইখান থেকেই, আমার আসলে যা বলার, তা শুরু করতে পারি আমি। ব্রিটিশ কলোনিয়াল সাবজেক্ট হিসেবে, আপনার, আমার পূর্বপুরুষরা, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে, যে শিক্ষাব্যবস্থার ‘সুফল’ ভোগ করতে থাকেন, তার প্রাণপুরুষ ছিলেন, টমাস ব্যাবিংটন মেকলে, ফার্স্ট ব্যারন অফ মেকলে। আমাদের সভ্য করতে চেয়েছিলেন তিনি, ঠিক যেমনভাবে রাশিয়ানরা সভ্য হয়েছিলেন, তেমনভাবে। অসীম আত্মপ্রত্যয় নিয়ে বলেছিলেন, আমাদের পাশ্চাত্য শিক্ষা দরকার, কারণ, 

‘…all the historical information which has been collected from all the books written in the Sanskrit language is less valuable than what may be found in the most paltry abridgements used at preparatory schools in England.’

অর্থাৎ, সংস্কৃত ভাষায় লেখা, আমাদের পাঁচ হাজার বছরের জ্ঞানচর্চা, ইংল্যন্ডের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীভুক্ত সংক্ষিপ্তসারের তুলনায়ও কম মূল্যবান। 

সাহেবটিকে নীরেট উজবুক ঠাওরালে ভুল হবে। তিনি, আমাদের সভ্যতা সম্বন্ধে মোটেই অনবহিত ছিলেন না। না। আসলে, তাঁর একটা আলাদা অ্যাজেন্ডা ছিল। ১৮৩৬ সালের, ১২ অক্টোবর, নিজের বাবাকে লেখা এক চিঠিতে মেকলে বলেন, 

 ‘No Hindoo who has received an English education ever continues to be sincerely attached to his religion. …It is my firm belief that, if our plans of education are followed up, there will not be a single idolater among the respectable classes in Bengal thirty years hence.’  

মেকলের স্বপ্ন সত্যি হয়নি। তবে, পুরোপুরি মিথ্যেও হয়নি। ক্রমাগত মগজধোলাইয়ের ফলে, ভদ্রলোক বাঙালির মধ্যে একটা বিচিত্র মিশ্র মানসিকতা গড়ে ওঠে। উড়িষ্যা, আসাম, দার্জিলিং, মধুপুর, গিরিডি, ভাগলপুর… প্রভৃতি স্থানে একটা বাঙালি ঔপনিবেশিকতা চারিয়ে যায়। সারা ভারত একদিকে, আর বাংলা একদিকে এমন একটা মনোভাব গড়ে ওঠে। ভদ্রলোক-ছোটোলোক ব্যবধান প্রকট হয়। এবং, শিশু-কিশোর সাহিত্যে ন্যারেটিভ স্তরে বিরোধিতার চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক লেখক ইওরোপ-কেন্দ্রিকতা ঝেড়ে ফেলতে পারেন না। বিশ্বমানব আর সাহেবি দুনিয়ার বাসিন্দা তাঁদের কাছে এক হয়ে যায়। তাই, অপর কোনও কলোনির কাহিনি লিখতে গেলে, সেই কলোনির প্রজাদের সঙ্গে নয়, তাঁরা একাত্মতা বোধ করেন, কলোনির প্রভুদের সঙ্গেই। এই সব ক’টি লক্ষণ, বাংলা কিশোর সাহিত্যজগতের একদা মুকুটহীন সম্রাট হেমেন্দ্রকুমার রায়ের মধ্যেও মাঝে মধ্যে দেখা গেছে। 

কলোনি, হেমেন্দ্রকুমার, ড্রাকুলা – আমি কী বলতে চাইছি? বলতে চাইছি, ‘ড্রাকুলা’ উপন্যাস পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়, অনূদিত ও অনুসৃত হয়েছে। আমাদের মাতৃভাষায় তার বঙ্গীকরণ করেছেন হেমেন্দ্রকুমার। এবং রূপ দিয়েছেন কিশোরসাহিত্যের। ‘বিশালগড়ের দুঃশাসন’ নামে সেই রূপান্তর আর মূল আখ্যান এবার পাশাপাশি রেখে পড়ব আমরা। আর পড়ার জন্য, এতক্ষণ ধরে যা যা বললাম, সব মাথায় রাখতে হবে।   

হেমেন্দ্রকুমার তাঁর রূপান্তর করেন ১৯৪৯ সালে। সময়টা খেয়াল করার মতো। দু’বছর হলো দেশ স্বাধীন হয়েছে। এই সময়, ঔপনিবেশিক বয়ানের এক জটিল আখ্যান, বঙ্গরূপ ধরছে। এবং ঝেড়ে ফেলছে, সাহেবি অনুষঙ্গ ছাড়াও আরও অনেক কিছু। রূপান্তরের মুখবন্ধে হেমেন্দ্রকুমার বলছেন :

“মূল ‘ড্রাকুলা’ হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্কদের পাঠ্য। কিন্তু আমাকে রচনা করতে হয়েছে ছোটোদের মুখ তাকিয়ে। মূল গ্রন্থের কয়েকটি চরিত্র ও ঘটনা একেবারেই বর্জন করেছি।”

শিশু-কিশোর সাহিত্যের সর্বজনমান্য বিধান : এখানে আদিরস স্পষ্টভাবে আখ্যায়িত হয় না। সুতরাং, রূপান্তরের পূর্বার্ধে যেখানে হেমেন্দ্রকুমার মোটামুটিভাবে ব্রাম স্টোকারকে অনুসরণই করেছেন, সেখানে একেবারেই বাদ পড়েছে বিনয়ের (যে জোনাথন হার্কারের বাঙালি অবতার) কোনও বাগদত্তা নারীর উল্লেখ। মানে, মিনা মারী হার্কার, যাকে আমরা মূল উপন্যাসে একটা অতি গুরূত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে দেখেছি, বাংলা রূপান্তরে তার কোনও স্থান নেই। উত্তরার্ধে, একই ভাবে মুছে গেছে লন্ডনে ড্রাকুলার প্রথম শিকার, মিনার প্রিয় বান্ধবী, আর্থার হোমউডের প্রেমিকা, লাস্যময়ী, লুসি ওয়েস্টেনরা। এই বর্জন প্রক্রিয়া, আসলে, মুছে ফেলেছে, ড্রাকুলা কাহিনির, ধনতান্ত্রিকতা আর ভ্যাম্পয়ারিজম্‌ এর একীকরণ, বিজ্ঞানের গথিক রূপ ধরে অশুভের বিরূদ্ধে লড়াই, আর আগ্রাসী ক্ষিদে-তেষ্টার, প্রলুব্ধকারী, রতিরঞ্জিত রূপটি। কাহিনি অনেক সরল হয়েছে।  

হেমেন্দ্রকুমারের ভাষায়, ‘অনেক জায়গাতেই মূল গ্রন্থের সঙ্গে আমার রচনার কোনই সম্পর্ক [থাকে নি] – সে-সব স্থলে আমি হয়েছি মৌলিক কাহিনির লেখক।’ এই মৌলিকত্ব সবচেয়ে প্রকট কাহিনির নামকরণের মধ্যে। 

ড্রাকুলার বঙ্গীয় রূপ, শরীরী প্রেত, মহারাজ রুদ্রপ্রতাপকে বিশালগড়ের ‘দুঃশাসন’ বলার পেছনে আছে মহভারতের অনুষঙ্গ। দুঃশাসনের বক্ষরক্তপানের ইঙ্গিত। মানে, ভ্যাম্পায়ারের রক্ততৃষার মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে, আমাদের মহাকাব্য, যেখানে অশুভ, অশুচির রক্তপানের উল্লেখ আছে। এ বস্তু সাহেবদের অজানা। আর, এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে উপনিবেশবাদ বিরোধিতা। 

১৩২৯ বঙ্গাব্দের ১০ কার্তিক,শুক্রবার, ১ম বর্ষের, ১৭শ সংখ্যক ‘ধূমকেতু’-তে নজরুল লেখেন, ‘দুঃশাসনের রক্তপান’ কবিতাটি। সাম্রাজ্যবাদের বিরূদ্ধে সংগ্রামের ডাক। 


বল রে বন্য হিংস্র বীর,

দুঃশাসনের চাই রুধির।

চাই রুধির রক্ত চাই,

ঘোষো দিকে দিকে এই কথাই

দুঃশাসনের রক্ত চাই!

দুঃশাসনের রক্ত চাই!!


অত্যাচারী সে দুঃশাসন

চাই খুন তার চাই শাসন,

হাঁটু গেড়ে তার বুকে বসি


ঘাড় ভেঙে তার খুন শোষি।

আয় ভীম আয় হিংস্র বীর,

কর অ-কণ্ঠ পান রুধির।


ড্রাকুলার রূপান্তরের সময়, নামকরণকালে, হেমেন্দ্রকুমারের মনে, সাতাশ বছর আগে লেখা নজরুলের কবিতার স্মৃতিরেশ কাজ করেছিল কিনা, তা জোর দিয়ে বলতে যদি নাও পারি, এটা নিশ্চয়ই বলা যায়, যে আখ্যান অবচেতনে তার লুকিয়ে থাকার  সম্ভাবনা একটা ছিল। মোটকথা, মহাভারত-নজরুল মিলিয়ে বইয়ের নামটা পড়লে বোঝা যায়, রক্তপায়ীর রক্তপানের ইঙ্গিতে একটা ‘কাউন্টার ভ্যাম্পায়ারিজম’ বা রক্ততৃষা তথা সাম্রাজ্যবাদ অথবা বস্তুগ্রাসের বিরোধাভাস উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।

নামের কথাই যখন উঠল, তখন দেখা যাক, বঙ্গীয় ড্রাকুলার মওড়া নিচ্ছে কারা। মূল বইতে ড্রাকুলার প্রতিস্পর্ধী  Crew of Light বা আলোক-জোট দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ছয় – ডাঃ ভ্যান হেলসিং, জোনাথান হার্কার ও, প্রথমে তার বাগদত্তা ও পরে তার স্ত্রী, মিনা, লুসির হবু-স্বামী আর্থার হোমউড, এবং লুসির দুই ব্যর্থ প্রেমিক, ভ্যান হেলসিং-এর পরিচিত ডাঃ সিওয়ার্ড, আর মার্কিনি মরিস কুইন্সি।  হেমেন্দ্রকুমারে রক্তপিপাসু রুদ্রপ্রতাপের বিরূদ্ধে দাঁড়িয়েছে মাত্র দু’জন : অবিনাশবাবু আর বিনয়ভূষণ ভৌমিক – প্রথমজন প্রৌঢ়, দ্বিতীয়জন যুবক। নামগুলো লক্ষ্য করার মতো নয় কি? প্রতাপের বিরোধিতা করছে, বিনয়, এবং অবিনাশ এক শক্তি। কিসের শক্তি? আঁধারের বিপরীতে দাঁড়ানোর আলোর। 

বিশালগড় থেকে  কোনওমতে প্রাণ হাতে করে কলকাতা ফেরার পর বিনয় শরণাপন্ন হয় পঞ্চাশোর্ধ সখের প্রেততত্ত্ব-বিদ অবিনাশবাবুর। স্টোকারের ডাঃ ভ্যান-হেলসিং-এর রূপান্তর। ভ্যান হেলসিং একাধারে চিকিৎসক, দার্শনিক, এবং অধিবিদ্যাবিদ। তাঁর পুত্রের মৃত্যুর শোকে তাঁর স্ত্রী অপ্রকৃতস্থ। তা সত্বেও, মানবিক কারণে এবং তাঁর রোমান-ক্যাথলিক মূল্যবোধের জন্য ভ্যান হেলসিং স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটাননি। অর্থাৎ, এই চরিত্র অনেক বেশি রক্তমাংসের। অপরদিকে, অবিনাশবাবু, একেবারেই বিমল-কুমার-জয়ন্ত-মানিক-ফেলুদা ঘরানার চরিত্র। বাংলায় ছোটোদের জন্য লেখা বিশেষ জাতীয় থ্রিলারে নায়কদের অনেকদিন অব্দি, সংসার থাকা বা রোজগার করা মানা ছিল। অবিনাশবাবুও তাই, পৈতৃক উত্তরাধিকারসূত্রে অবস্থাপন্ন, এবং তার ওপর :

“সংসার ভাবনাকেও [তিনি] জলাঞ্জলি দিতে পেরেছেন, কারণ আজ পর্যন্ত তিনি সুদূরে পরিহার করে এসেছেন বিবাহ নামক সুপ্রসিদ্ধ উপদ্রবটা। বিয়ের পর রাঙাবউ আসা ব্যাপারটা নিতান্ত মন্দ নয়, তবে ওই পর্যন্ত। তারপর আসতে শুরু করে যখন ‘পুত্রকন্যার প্রবল বন্যা’, ব্যাপারটা তখন গুরুতর হয়ে ওঠবার উপক্রম করে। তারপর সেই সূত্রে যে আসে কতরকম বিপদ, বিভ্রাট ও বিভীষিকা এখানে তার তালিকা দাখিল করার দরকার নেই।”

এ হেন মানুষটি, অন্ধকারের শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করেন, কবচ, মন্ত্র, গণ্ডি- অর্থাৎ একান্ত ভাবেই বাংলার চেনা জানা অস্ত্র নিয়ে। বিনয়-অবিনাশ জুটিও আমাদের দেশের মাটির গন্ধ মাখা। কৃষ্ণ-অর্জুন, মহাপ্রভু-নিত্যানন্দ, সারমাদ-অভয়চন্দ্‌ -দের উত্তরসূরি। আবার, বিমল-কুমার, জয়ন্ত-মানিক, শার্লক হোমস্‌-ওয়াটসন, ব্যোমকেশ-অজিত –দের কথাও আমরা ভাবতে পারি। মোদ্দা কথা, এই ‘দুই’ বা ডাবল্‌-এর শক্তি আমাদের পরিচিত। আখ্যানে বা ইতিহাসে।

অবিনাশবাবুর কাছে বিনয় আসে কারণ তার মতে তিনি ‘বাংলা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেততত্ত্ববিদ’। এবং অচিরেই অবিনাশকে বিনয় গুরু পদে  বরণ করে। বিনীত ভাবে, প্রশ্ন ও সেবা দ্বারা (মনে মনে প্রণিপাত করেও হয়তো বা) অবিনাশী আলোকপথের সন্ধান পেতে চায় সে। 

তাই, এরপর পদে পদে পিশাচের বিরুদ্ধে যুদ্ধের রীতিনীতি সে শিখে নেয় গুরুর কাছ থেকে : বিশালগড়ের সরাইখানার বৃদ্ধার দেওয়া কবচ সবসময় পরে থাকা, যা দেখিয়ে অবিনাশবাবু বিনয়কে দিয়ে পরপর দু’বার রুদ্রপতাপকে প্রতিহত করেন; বিশালগড়ে পৌঁছে অবিনাশবাবু মন্ত্রপূত গণ্ডি টেনে নিজেকে ও বিনয়কে তার মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রেখে, পিশাচদের আক্রমণ রোখেন; এবং তিনিই কাহিনির শীর্ষবিন্দুতে তিন পিশাচিনী ও রুদ্রপ্রতাপের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আক্রমণে নেতৃত্ব দেন।

এই তিন পিশাচিনীকে হেমেন্দ্রকুমার বাদ দেননি। কিন্তু, মিনা আর লুসিকে বাদ দিয়েছেন। কেন? কারণ, যেহেতু, তিনি ‘ছোটোদের’ জন্য লিখছেন, তাই তাঁর একটা নীতিশিক্ষা দেওয়ার দায় থাকে! প্রলোভন জয় করার কথা বলতে হয়। কিন্তু, ব্যাপারটা, ঠিক তাই কি? 

মূল বইতে ড্রাকুলার বুকের রক্তে মিনা ঠোঁট ভেজাতে গেলেও, তার মধ্যে ভয় মেশানো, ঘেন্না দেখে ভ্যান হেলসিং আশ্বস্ত হন যে, সে ভ্যাম্পায়ার হয়নি। তীব্র, অসংযত রিরংসা না জিতে, গেরস্থ, ‘সংযত’ কাম বিজয়ী হওয়ায় স্বস্তি পায়, ভিক্টোরীয় পাঠকমনন। আর, রূপান্তরের সময়, তাঁর অপ্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের যে প্রলোভনের থেকে সাবধান করছেন হেমেন্দ্রকুমার, তা স্পষ্ট মৈথুনগন্ধী। 

চাঁদের আলোয় ধোয়া প্রান্তর, সমুজ্জ্বল নদীরেখা, পুঞ্জীভূত জ্যোৎস্না এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। রতিময়ি প্রকৃতি।

এই দৃশ্যে বিনয় তার মানসিক অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছে এই ভাষায় : 

“আমার বোধশক্তি যেন ক্রমেই কেমন আচ্ছন্ন হয়ে আসতে লাগল … আমার মনের মধ্যে যেন নূপুর বাজাচ্ছে কী এক অজানিত আনন্দের ছন্দ। যেন এই আনন্দকে লাভ করতে পারলে আমি অনায়াসেই পরিত্যাগ করতে [পারি] যে—কোনও সাম্রাজ্যের সিংহাসন!

... অবশেষে পাশে পাশে আত্মপ্রকাশ করল তিন-তিনটে মূর্তি! মূর্তিগুলো যেন পরিচিত …

পাশাপাশি তিনটি তরুণীর সঞ্চারিণী লতার মতন তনু। এমন সব পরমা সুন্দরী আমার চক্ষু জীবনে আর কখনও দেখে নি। রূপকথার রাজকন্যারাও তুচ্ছ তাদের কাছে। বকপক্ষশুভ্র তাদের দেহ …

আমি দাঁড়িয়ে উঠলুম মাতালের মতন টলতে টলতে … নিজের অজ্ঞাতসারেই আমি গলা থেকে কবচখানা টেনে বার করলুম, তারপর অবিনাশবাবুর রেখা-মণ্ডলের বাইরে যাবার জন্যে পা বাড়ালুম –

কিন্তু পর-মুহূর্তেই প্রচণ্ড এক হাতের টানে আছাড় খেয়ে মাটির উপরে পড়লুম পিছন দিকে।” 

মত্ততা, ভ্রান্তি, ও প্রাণঘাতী সম্মোহ – এ সব লেখক যুক্ত করেছেন কামের আকর্ষণের সঙ্গে। আর, তার কাছে আত্মসমর্পণ করা থেকে বিনয়কে রক্ষা করছেন অবিনাশবাবু। বিনয় যদি কামদষ্ট হয়, তবে তার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। এরপর, অবিনাশবাবুর কাছে তিরস্কৃত হয়ে অনুতপ্ত বিনয় বলে, “আর কোনও দিন আমি পদচ্যুত হব না।” ‘পদচ্যুত হওয়া’, ‘পদস্খলন’- এজাতীয় শব্দবন্ধ নৈতিক ভ্রষ্টতা, বিশেষ করে যৌননীতি সংক্রান্ত ভ্রষ্টতা বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 

আরও পড়ুন : বাস্তুছায়া : হানাবাড়ি ও ইঙ্গ-মার্কিন সাহিত্য / চয়ন সমাদ্দার 

এবার প্রশ্ন, কিশোর পাঠ্য উপন্যাস, যেখানে বউ-মা-মেয়ে-বোন কারওরই প্রবেশাধিকার নেই, সেখানে এই পিশাচীরা কী করছে? এদের বাদ দিয়েও, শরীরী প্রেতের বিরূদ্ধে অভিযানের গল্প অক্লেশে বলা চলত। পূর্বার্ধেও, উত্তরার্ধেও। কিন্তু, হেমেন্দ্রকুমার নিশ্চিত ভেবেছিলেন, ‘খারাপ মেয়েদের’ প্রলোভনের কথা তাঁর পাঠকদের জানানো উচিত। ভুললে চলবে না, ১৯২৩ সালে, মেঘনাদ গুপ্ত ছদ্মনামে লেখা, ‘রাতের কলকাতা’ বইতে ‘অবিদ্যা’দের প্রভাব নিয়ে তিনি লিখেছেন। কিন্তু, কথা সেটা নয়। কথা হলো, এই অবিদ্যাদের দেহ সৌন্দর্য আর ছলাকলার বর্ণনার মধ্যে, ভাষাস্তরে, একটা মুগ্ধতার ছাপও পরিষ্কার চোখে পড়ে। তার মানে, আখ্যানের মধ্যে মেয়েদের নিয়ে বেশ একটা অ্যাংজাইটির ছাপ আছে। এটাও নতুন কিছু নয়। কিশোরদের জন্য লিখতে গিয়ে, মেয়েদের প্রসঙ্গ এলেই, (সে মেয়ে যদি মা-বোন-মাসি-পিসি না হয়) এই জাতীয় আকর্ষণ-বিকর্ষণের টানাটানি আমরা এখনকার সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখাতেও পাই। 

এইবারে শেষ কথা বলার সময় হলো। সবরকম অর্থে সাবালক পাঠ্য ও বহুস্তরী ইংরিজি ‘ড্রাকুলা’ উপন্যাসকে বাংলায় কিশোরপাঠ্য উপন্যাসের রূপ দিতে গিয়ে, হেমেন্দ্রকুমার রায়, মোটেই একমেটে, সোজা-সরল কোনও কাহিনি রচনা করেননি। তিনি তাঁর ন্যারেটিভের মধ্যে রেখেছেন পশ্চিমি যন্ত্রসভ্যতার বিরূদ্ধে রেজিসটেন্স, আমাদের মহাকাব্য, স্বদেশচেতনার ছায়া, এবং এক ধরণের যৌনতা বিষয়ক অ্যামবিগুইটি। 

আরও পড়ুন : এক যে আছে কন্যা / চয়ন সমাদ্দার

তাহলে? তাহলে, এর আগে, বিভিন্ন লেখায়, অনেকবার যা বলেছি, আবার তাই বলব। সাহিত্য ক্ষেত্রে ছোটো/বড়ো বাইনারিটা নেহাৎই একটা আরোপিত জিনিস। সদর্থে শক্তিশালী কিশোর সাহিত্যে, প্রাপ্তবয়স্ক ও পরিণতমনস্ক লেখকের কিছু অভিজ্ঞান থাকবেই। ‘বিশালগড়ের দুঃশাসন’-এও আছে। আসলে, ‘ড্রাকুলা মিথ’ এতই শক্তিশালী এক উপজীব্য, যে তাকে রূপান্তরিত করতে গিয়ে, বোধহয় নিজের অগোচরেই, হেমেন্দ্রকুমার তার ছোঁয়ায় এমন এক কাহিনি লিখে ফেলেছেন, যা শুধু ‘ড্রাকুলা’-র আতঙ্কের আবহকেই নবীকৃত করেনি, তার জটিলতাকেও এক ভিন্নতর রূপে উপস্থাপিত করেছে। 

‘বিশালগড়ের দুঃশাসন’ হেমেন্দ্রকুমারের সব সাহিত্যকর্মের থেকে আলাদা। আর, এর জন্য পূর্ণ কৃতিত্ব দাবী করতে পারে ‘ড্রাকুলা’-র সম্মোহনী মিথিক গুণ, যা লেখকের অবচেতনে চারিয়ে গিয়ে তাঁকে দিয়ে এমন একটা বই লিখিয়ে নেয়, যেমনটি তিনি এর আগে বা পরে লেখেননি। 


ঋণস্বীকার – ১) রজার লাকহার্স্ট

                 ২) নিক গ্রুম

                 ৩) স্যু চ্যাপলিন

........................... 

[ছবি : ইন্টারনেট] 

#Dracula #Bram Stoker #gothic horror #vampire #ড্রাকুলা #হেমেন্দ্রকুমার রায় #চয়ন সমাদ্দার #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #Portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

214980