বার্থডে-বয়
সে ছিল এক আশ্চর্য সময়। অহেতুক একা হয়ে যাওয়ার বয়ঃসন্ধিকাল। বদলের সঙ্গে মিলতে না পারা, মেলাতে না পারার কিঞ্চিৎ দিশেহারা টাইমলাইন। তারপর তেলেনাপোতা আবিষ্কার। নিতান্তই ঘটনার ফেরে। এক-আধটা নয়, সাত-সাতটা সিরিজের বই, তাও লাফে লাফে ক্রমবর্ধমান যাদের আয়তন, গিলে ফেলা গোগ্রাসে। ইংরাজি-ভিতু বাংলা-মিডিয়ামের ভুলে যাওয়া বিজাতীয় ভাষায় অপটুতা। সর্বোপরি, খুঁজে পাওয়া সেই লুকনো স্যাংচুয়ারি, সেই জোরালো শিল্ড চার্ম যাতে ধাক্কা লেগে ঠিকরে পড়ে বহিরাগত যাবতীয় আঘাতের রেখা।
এই ইতিহাসের সঙ্গে যাঁরা একটু আধটুও মেলাতে পারছেন নিজেদের, তাঁদের প্রায় সকলেরই জানা আছে আজকের দিনটির মহিমা। পৃথিবীজুড়ে তাবৎ পটার-ফ্যানদের মনে আজ আলো ছড়াচ্ছে হাজারখানেক খুশির টুনিবাতি। লকডাউনের মরশুম না থাকলে ভিড়াক্রান্ত বাসেও হয়তো দেখা যেত, ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখে দ্রুত হাতে হোয়াটসঅ্যাপ স্টেটাস টাইপরত কোনও তরুণী, তার আঙুলের শৈল্পিক চলনে উঠে আসছে অক্ষরমালা – “Happy Birthday Harry! Happy Birthday J.K Rowling!” প্রিয় নায়ক আর প্রফেট-লেখিকার যুগ্ম জন্মদিনে অনুরাগীদের এ হেন উন্মাদনা তো অতি স্বাভাবিক। কিন্তু যে পাঠক কিছুটা সরে থাকতে চায় প্রদর্শন থেকে, সোশ্যাল মিডিয়া বা বিগ-বাজেট ফিল্মের প্রাচুর্যের চেয়ে ঢের বেশি স্বস্তিবোধ করে বইয়ের পাতার নিভৃতিতে, রন ছেড়ে যাওয়ার পর তাঁবুর ভেতর ড্যানিয়েল আর এমার আধা-রোমান্টিক আধা-প্লেটোনিক নাচের দৃশ্য সেভাবে বিদ্ধ করে না যার আবেগী মর্মমূল, তার মনে পড়ার কথা -- আজ, এই ৩১ জুলাই জন্মদিন আরও একজনের। রাওলিং-এর গড়া কল্পদুনিয়ায় সে জনপ্রিয় হলেও, ‘তত বিখ্যাত নয়’। প্রতি জুলাইয়ের অন্তিম দিনটিতে হ্যারি এবং তার স্রষ্টা কেড়ে নেয় সমস্ত স্পটলাইট। আত্মসাৎ করে সিংহভাগ জৌলুশ। অথচ উপচ্ছায়ার ধূসরে ঢাকা পড়ে আরেক বার্থডে-বয়। নেভিল লংবটম। পটার-দুনিয়ার হলেও-হতে-পারত নায়ক।
‘হলেও-হতে-পারত’। কারণ, যেসব দৈব-সম্ভাবনা মুখচোরা মানুষকে আলোকিত মঞ্চে ঠেলে দেয়, তার সবকটাই রাওলিং বুনে রেখেছিলেন তারও প্রতিবেশে। “The one with the power to vanquish the Dark Lord approaches…born to those who have thrice defied him, born as the seventh month dies” – প্রফেসির এই অংশ হুবহু মিলে যায় হ্যারির মতো, নেভিলের সঙ্গেও। তফাৎ একটাই। সে হ্যারির মতো ‘Chosen one’ নয়। কোনও অজ্ঞাত কারণে জন্মমুহূর্তে তাকে ছেড়ে হ্যারিকেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলে লর্ড ভোলডেমর্ট। নইলে নিতান্ত সাধারণ কিশোর থেকে বাধ্যত নায়ক হয়ে ওঠার জীবন হয়তো তাকেই বহন করতে হতো। হ্যারিকে নয়।
নায়কোচিত উপাদান থেকে হ্যারির চরিত্রকেও সচেতনভাবে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন রাওলিং। পড়াশোনায় সে ধারেকাছেও যায় না হারমাইওনির। কাছের বন্ধুটির মতো তুখোড় মেধা কিংবা স্মৃতিশক্তি - কোনটাই তার নেই। শিয়রে শমন এলে সেই বন্ধুরই পড়তে বলার নিরন্তর তাগাদায় আর তার যত্নে তৈরি নোটের পাহাড়ের কিয়দংশ উগরে সে উতরে যায় পরীক্ষা-বৈতরণী। স্মার্টনেসও তেমন নেই তার। যেটুকু আছে তাও ঘেঁটে ‘ঘ’ হয় প্রেম-টেমের মতো জটিল ব্যাপারের কিনারে এলে। কিন্তু তারপরেও, নেভিলের ছড়িয়ে-ফেলা হ্যারির চেয়ে হাজারগুণ বেশি। প্রথমদিকে এমনই চড়া রঙে আঁকা তার অক্ষমতা-অপারগতা যে ঠাহর হয় এ চরিত্র বুঝি নিতান্তই কমিক-রিলিফ। হগওয়ার্টস এক্সপ্রেসে প্রথম সফরের দিনেই নিজের পোষ্য ব্যাং ট্রেভরকে হারিয়ে ফেলা থেকে ব্রুমস্টিকের নিয়ন্ত্রণ হারানো, যখন তখন জরুরি কাজ ভুলে ঠাকুমার দেওয়া রিমেমব্রলের রং বদলে ফেলা, পোশন তৈরির সময় প্রোফেসর স্নেপের ভয়ে সহপাঠীর কড়াই গলিয়ে ফেলে গোটা ক্লাসকে পোশনময় করে তোলা অথবা কুইডিচ চলাকালীন বন্ধুর পতন-আশঙ্কায় কেঁদেকেটে হ্যাগ্রিডের জ্যাকেট ভিজিয়ে ফেলা – বলা বাহুল্য, এর কোনোটার মধ্যেই নায়কত্বের ছিটেফোঁটারও হদিশ পাওয়া যায় না।
কিন্তু অন্য এক নেভিলকে বোধহয় প্রথম চিনিয়ে দেন অ্যালবাস ডাম্বলডোর। বন্ধু ভুল করছে মনে করলে নিজের অজস্র অপারগতা নিয়ে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, এমনকি বন্ধুর ছুঁড়ে দেওয়া কার্সে চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে থাকতেও যে সাহসের দরকার, এই সত্যি কথাটা জানিয়ে দেন তিনি। গ্রিনডেওয়াল্ডের মুখোমুখি একদা দাঁড়াতে হয়েছিল বলেই ডাম্বলডোর জানতেন – “It takes a great deal of bravery to stand up to our enemies, but just as much to stand up to our friends.” তাই নেভিলের পাওয়া মাত্র দশ পয়েন্টই শেষপর্যন্ত হয়ে ওঠে গ্রিফিনডোরের জেতার চাবিকাঠি। বস্তুত, এভাবে, প্রথম বছরেই নির্ধারিত হয়ে যায় নেভিলের গন্তব্য। গোটা সিরিজ জুড়ে ঘটনার কেন্দ্রে না থেকেও সে অর্জন করবে বিকল্প-নায়কত্ব। ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসবে ফোরগ্রাউন্ডে। এর প্রথম আভাস পাওয়া যায় থার্ড ইয়ারে, প্রোফেসর লুপিনের ক্লাসে। তাঁর উৎসাহে ক্লাসের মধ্যে সেই-ই প্রথম মুখোমুখি দাঁড়ায় বোগার্টের। ফিরে আসতে থাকে ঠাকুমার অতিপ্রত্যাশা আর বাবা-মায়ের ট্যালেন্টের সঙ্গে তুলনার চাপে গুঁড়িয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস। ক্লাসে সবকিছু গড়বড় করে ফেলা ছেলেটা নিজের জায়গা খুঁজে পায় ডাম্বলডোর্স আর্মিতে। সবাইকে বিস্মিত করে আস্তে আস্তে ম্যাজিক-প্রয়োগে সে হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। হ্যারি-রনদের মতো বন্ধুকে পাশে পেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চালিয়ে যায় অভ্যেস। যে অন্ধকার বিনাদোষে ছিনিয়ে নিয়েছে তার শৈশব, তার বাবা-মাকে… যে পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা কেড়ে নিয়েছে তাঁদের মানসিক স্থিতি, সেন্ট মাঙ্গোসের কেবিনে অসহায় দিন-গুজরানে বাধ্য করেছে… জীবিত হয়েও যে কারণে তাঁরা মৃতের বাড়া… তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সঙ্কল্প দৃঢ় হয় মনে মনে। মিনিস্ট্রি অভিযানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে লড়ে হ্যারির সঙ্গে। ভয়ের কাছে মাথা নোয়ায় না মোটেই। সেভেন্থ ইয়ারে হ্যারিদের অনুপস্থিতিতে হগওয়ার্টসে সে-ই তুলে নিয়েছিল নেতৃত্বের ভার। যুদ্ধের ক্রান্তিকালে হ্যারির মৃত্যুর কথা জেনেও নির্ভীক পায়ে এগিয়ে আসে সে। ভোলডেমর্টের অত্যাচারকে তার মনোবলের সামনে নিছক দুর্বল মনে হয়। নাগিনীকে শেষ করার যে দায়িত্ব হ্যারি তাকে দিয়েছিল, তা সে পালন করে অনায়াস সহজতায়, সর্টিং হ্যাটের ভেতর থেকে বের করে আনে গ্রিফিনডোরের তলোয়ার। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আরও একবার চিনিয়ে দেয় গ্রিফিনডোর হাউসে তার অবস্থানের ধক এবং হক।
আর কী কী মনে করায় গোলগাল মুখের ভুলোমনা ছেলেটা? লুনার ঘরের দেওয়ালে চার বন্ধুর পাশাপাশি তার ছবি, সোনালি কালিতে তাকে ঘিরে পৌনঃপুনিক ‘friends’ শব্দের মালা? পোশন-ক্লাসে সর্বদা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া দরদী সহপাঠিনীকে কৃতজ্ঞতার উচ্ছ্বাসে নাচের পার্টনার হতে নেমন্তন্ন করে ফেলা? ট্রমাটিক শৈশব? বাড়ির বড়দের জোর করে খুঁজতে চাওয়া ম্যাজিক-অনুষঙ্গ, যা আসলে মাগল বাবা-মায়ের নিজের খুদেকে অঙ্কে আইনস্টাইন, আঁকায় পিকাসো আর নাচে মমতাশঙ্কর করে তোলার হাস্যকর চেষ্টার চেয়ে আলাদা কিছু নয়! নাকি Mimbulus mimbletonia-র মতো আজগুবি নামের ক্যাকটাসের দিকে তার নরম চোখে চেয়ে থাকা, ঘরভর্তি গাম-র্যাপার জমে গেছে জেনেও উন্মাদ মায়ের কাছ থেকে পাওয়া মোড়ক পকেটে ঢুকিয়ে ফেলা সবার অগোচরে?
আসলে কী কী মনে পড়ে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। এটুকুই বলা চলে, রক্তেমাংসে বিলকুল না থেকেও, পাঠকের বন্ধু হয়ে ওঠে যেসব মানুষ, তাদের মধ্যে নেভিলও একজন। আর বন্ধুকে লিখতে গেলে স্বভাবতই আড়ষ্ট হয় কলম। হারিয়ে যায় নৈর্ব্যক্তিক নির্লিপ্তি। যার সঙ্গে, যাদের সঙ্গে, লগ্ন হয়ে থাকা শৈশব-কৈশোর-যৌবনবেলার অনেকখানি সময়, তাদের বিষয়ে আদতে কিছুই কি লেখা যায়? বহুবছর পাশে থাকার ফলে জানা হয়ে যায় অগণিত আলো-অন্ধকার। কিন্তু সে নিয়ে অজস্র কথা বলার পরেও মনে হয়, আসলে বলা হল না কিছুই। ছোঁয়া গেল না হিমশৈলের ডুবে থাকা নয়-দশমাংশকে। “The stories we love best do live in us forever.” এ আপ্তবাক্য নেভিলের গল্পের বেলায় খাটে কিনা তার জবাবে তাই ফিরিয়ে দেওয়ার থাকে একটিই শব্দ। “ALWAYS”।
ছবি : গুগল
#