প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাঘের বাচ্চা চেয়েছিলেন জীববিজ্ঞানী রতনলাল ব্রহ্মচারী
এক বিরল শ্রেণির গবেষক বাঙালি জীববিজ্ঞানী ও সংরক্ষণবিদ রতনলাল ব্রহ্মচারী। ইংরেজিতে যাকে বলে কনজার্ভেশনিস্ট, তা-ই ছিলেন তিনি। প্রাণীদের শরীর থেকে নিঃসৃত গন্ধবাহী রাসায়নিক ফেরোমোন সম্পর্কে তাঁর কাজ এককথায় যুগান্তকারী। বিশেষত বাঘের ফেরোমেোন নিয়ে তাঁর গবেষণা সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছে। ‘বাঘ থেকে মুগডাল : একটি গবেষণার কাহিনী' নামের বইটি চমকে দিয়েছিল বাঙালি বিজ্ঞানী-মহলকে। অথচ এই মানুষটির নাম জানেন না অনেক বাঙালি।
১৯৩২ সালে ঢাকায় জন্ম হয় রতনলাল ব্রহ্মচারীর। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ায় তিনি বেছে নিয়েছিলেন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানকে। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাছে পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছিল। ঢাকা ছাড়া কলকাতা আর হামবুর্গেও পড়াশোনা করেন তিনি। ১৯৫৭ সালে যোগ দেন কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটে। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল এমব্রায়োলজি বা ভ্রূণতত্ত্ব। তবে মূল লক্ষ্যটা ঠিক রাখলেও কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে বা চেনা বৃত্তে আবদ্ধ থাকার মানুষ ছিলেন না রতনলাল। তাঁর খ্যাতিমান সহকর্মীদের স্মৃতিচারণ জানা যায় যে পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব এবং পরিসংখ্যানের মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছিল তাঁর গবেষণার আকর্ষণীয় ক্ষেত্র। মোট চোদ্দ বার আফ্রিকা সফর করেন তিনি। বেশিরভাগ সময়ে নিজের খরচাতেই। গবেষণার কাজেও রতনলাল ঘুরেছেন বহু জায়গায়, এসেছেন কিছু নামী বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে। অমেরুদন্ডী সামুদ্রিক প্রাণীদের নিয়ে কাজ করার জন্য তিনি গিয়েছেন ইতালিতে। কাজ করেছেন নেপলস আর পালেরমোর সামুদ্রিক গবেষণাগারে। খ্যাতিমান ভ্রূণতত্ত্ববিদ গিসেপ্পে রিভেরবেরির সঙ্গে তাঁর যৌথ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে।
উনবিংশ শতকের শেষের দিকে ফরাসী প্রকৃতিবিজ্ঞানী জাঁ অঁরি ফাবার ফেরোমোন গবেষণার সূত্রপাত করেন। তাঁর কাজ ছিল মথ নিয়ে। ১৯৬৪ সালে মার্কিন প্রাণীবিজ্ঞানী জর্জ শালার বাঘের ফেরোমোন নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন। যে বাঘেরা গন্ধ-রাসায়নিক ছড়িয়ে কোনো বার্তা রেখে যায় কিনা। এ-ব্যাপারে শুরু থেকেই শালারের দোসর হন রতনলাল। ওই বছরেই দুজনে চলে যান মধ্যপ্রদেশে। কান্হার জঙ্গলে দুজনে প্রায় দশ দিন থেকে টানা পর্যবেক্ষণ চালান।
দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিল রতনলালের বাঘতত্ত্বের তালাশ। কীভাবে বাঘ থেকে বেড়াল এই রাসায়নিক ছিটিয়ে নিজের এলাকা চিহ্ণিত করে, কত দিন পর সেই রাসায়নিক উবে যায়, কেমন সেই রাসায়নিকের গঠন – এ সবই রতনলাল খোঁজ করে বের করেছেন তাঁর সহযোগীদের নিয়ে। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বর মাসে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটের সুবর্ণ জয়ন্তী সমারোহে আসেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি নিজেও বন্যপ্রাণ বাঁচানোর ব্যাপারে আগ্রহী। সেই প্রসঙ্গেই কথা হচ্ছিল রতনলাল ব্রহ্মচারীর সঙ্গে। তখনই গবেষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাঘের বাচ্চা চান রতনলাল। শুনে হেসেই ফেলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু চট করে বাঘের মত বন্যপ্রাণকে তুলে আনা কঠিন, বিশেষ করে যেখানে তাদের সংরক্ষণের জন্য ১৯৭৩ সালে প্রজেক্ট টাইগার শুরু করা হয়েছে। কিন্তু অর্থসাহায্য তো এমন আইনের জাঁতাকলে আটকে নেই। সে সাহায্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন রতনলাল।ওড়িশার যশীপুরে খৈরি নামে এক যুবতী বাঘিনী ছিল। তাকেও নিরীক্ষণ করেছিলেন রতনলাল। দেখতে গিয়ে কান্হা অরণ্যে যা দেখেছিলেন তারই সমর্থন পেয়েছিলেন। দেখলেন একাধিকবার তরল ছেটানোর অভ্যাস রয়েছে খৈরির। এক দিন তো বাহান্ন বার অমনভাবে তরল ছেটাল সেই বাঘিনী। পলাশ পাতায় সেই তরলের ঘ্রাণ নিলেন রতনলাল। বেরিয়ে এল নতুন তথ্য। বাঘের ছেটানো পদার্থ থেকে মূল রাসায়নিক অণু আলাদা করার কাজে দু’জনের সহযোগিতা পেয়েছিলেন রতনলাল। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় দত্ত এবং গবেষক মৌসুমী পোদ্দার সরকার। দেখা যায়, ওই একই অণুর অস্তিত্ব রয়েছে মহুয়া ফুল, অন্নপূর্ণা পাতা ও বাসমতি চালেও।
১৯৯২ সালে অবসর নেওয়ার সময় রতনলাল ছিলেন ভ্রূণতত্ত্ব বিভাগের প্রধান। এর পরেও তাঁর যোগ ছিল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ইনস্টিটিউট তাঁকে সম্মানিত করে ডি-এস-সি দিয়ে। অবসর নেওয়ার পরে কাজ করেছেন রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের কেমিক্যাল টেকনোলজি বিভাগে। দেশ-বিদেশের নানা জার্নালে ছাপা হয়েছে তাঁর গবেষণাপত্র। কারেন্ট সায়েন্সে ২০১৫ সালে প্রকাশিত লেখাটি ফেরোমোন নিয়ে তাঁর গবেষণার একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। শিরোনাম ছিল ‘ফিফটি ইয়ারস অফ টাইগার ফেরোমোন রিসার্চ’। ২০১৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
............
কৃতজ্ঞতা : মানসপ্রতিম দাস
#Ratan Lal Brahmachary #Biochemist # tiger pheromone