ভানুসিংহ, নিশিকান্ত ও একটি গবেষণা-সন্দর্ভ বিতর্ক
১৯১২ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ‘জীবনস্মৃতি’র পাতায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘ভানুসিংহ যখন ভারতীতে বাহির হইতেছিল ডাক্তার নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় মহাশয় তখন জর্মনিতে ছিলেন। তিনি য়ুরোপীয় সাহিত্যের সহিত তুলনা করিয়া আমাদের দেশের গীতিকাব্য সম্বন্ধে একখানি চটি-বই লিখিয়াছিলেন। তাহাতে ভানুসিংহকে তিনি প্রাচীন পদকর্তারূপে যে প্রচুর সম্মান দিয়াছিলেন কোনো আধুনিক কবির ভাগ্যে তাহা সহজে জোটে না। এই গ্রন্থখানি লিখিয়া তিনি ডাক্তার উপাধি লাভ করিয়াছিলেন।’
‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ সালে, তখন রবীন্দ্রনাথ তেইশ বছরের যুবক। পদগুলি অবশ্য বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই লেখা। ছোট থেকেই বৈষ্ণব পদাবলিতে মুগ্ধ (যার মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার ‘প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ’ নামে একটি বইয়ের মৈথিলি ভাষার কিছু পদ) রবীন্দ্রনাথ মাত্র ষোল বছর বয়সে সেরকমই একটি পদ এক বৃষ্টির দিনে খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে স্লেটের ওপর লিখে ফেললেন— ‘গহন কুসুম কুঞ্জ-মাঝে...’। এরকম কয়েকটা লেখা তৈরি হলে তিনি এক বন্ধুকে জানালেন ব্রাহ্মসমাজের গ্রন্থাগারে পাওয়া গেছে প্রাচীন এক পুঁথি, যা থেকে তিনি পেয়েছেন এই পদগুলি। বন্ধুটি এই লেখাগুলির উচ্চ-প্রশংসা করলেও তিনি পরে তাঁকে সত্যিটা জানিয়ে ছিলেন।
সৃষ্টি সুখের উল্লাসে সেই পদগুলি অবশ্য বেশি দিন তিনি নিজের কাছে চেপে রাখতে পারেননি, ১২৮৪ বঙ্গাব্দের (১৮৭৭ সাল) আশ্বিন মাস থেকে পরপর এক এক করে মধ্যযুগীয় ব্রজবুলি ভাষায় লেখা সেই পদগুলি প্রকাশিত হতে লাগল পারিবারিক ‘ভারতী’ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায়। ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ এরকমই বাইশটি পদের একত্রিত সংগ্রহ। বইটি প্রকাশের মাস কয়েক পরে আবার তিনি নিজেই কিঞ্চিৎ কৌতুক করে ‘নবজীবন’ পত্রিকায় লিখলেন একটি গদ্য— ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের জীবনী’, যেখানে এই প্রাচীন কবির কাল্পনিক একটি জীবনী খাড়া করার পাশাপাশি তাঁর নানারকম সম্ভাব্য জন্মসাল উল্লেখ করবার ফাঁকে নিজের জন্মসালকেও ভানুসিংহের বলে একবার জানিয়ে দিলেন।
পরে নিজের এই পদগুলি থেকে অধিকাংশই বাদ দিয়ে তিনি মাত্র দুটিকে রেখেছিলেন ‘সঞ্চয়িতা’য়। বাকিগুলি তাঁর নিজস্ব কষ্টিপাথরে হয়ে গিয়েছিল অনুত্তীর্ণ। কিন্তু এই অবধি ঠিক আছে। ছদ্মনামে অন্য ধরনের ভাষাভঙ্গিমা প্রয়োগ করে সাহিত্যসৃষ্টির নজির বিশ্বসাহিত্যে আরও আছে, এতে অন্যায়ের কিছু নেই।
কিন্তু আসল অন্যায়টা তিনি করলেন তাঁর ওই ‘জীবনস্মৃতি’তে, লেখার শুরুর ওই পংক্তিগুলোর মধ্যে। সুইৎজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলার জনপ্রিয় একটি বিনোদনমাধ্যম যাত্রা নিয়ে গবেষণা করে বাঙালি গবেষক নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় ১৮৮২ সালে ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন। তাঁর ওই গবেষণাপত্রে (‘Yatras: or, the Popular Dramas of Bengal’) ভানুসিংহ ঠাকুরের নামও উল্লিখিত ছিল না, অথচ রবীন্দ্রনাথ এই ত্রুটিপূর্ণ বাক্যটি তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে রেখেই দিলেন, পরে ইংরেজি অনুবাদেও তা যথারীতি বাহিত হল। যদিও পরবর্তীকালে ‘জীবনস্মৃতি’র পরিশিষ্টে সম্পাদক পুলিনবিহারী সেন নিশিকান্তর গবেষণাপত্রের নাম ও সে সম্বন্ধে সামান্য তথ্য দিয়েছিলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় এই ভ্রমনিরশনের কোনও ব্যবস্থা করেননি। রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অবশ্য লিখেছিলেন ‘... সে গ্রন্থ আমরা দেখিয়াছি, তাহাতে ভানুসিংহের কোন কথা নাই। ... সুতরাং রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি ভ্রমশূন্য নহে।’ (রবীন্দ্র-জীবনী, প্রথম খণ্ড, ৬৩-৬৪ পৃ। বিশ্বভারতী)
আজকের দিনে নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের নাম বাঙালি ভুলেই গিয়েছে। ‘দেশ’ পত্রিকার ২০০৪ সালের (অর্থাৎ ১৪১১ বঙ্গাব্দের) শারদীয় সংখ্যায় সোমনাথ রায় একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন ‘কবির অভিঘাত’ নামে, যেখানে এই বিষয়টি সম্বন্ধে যথেষ্ট বিস্তারিত আলোচনা ও নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের জীবন ও কর্মের বেশ কিছু তথ্য-সম্ভার রয়েছে। এ ছাড়া ইন্টারনেট খুঁজলে কিছু পুরনো খবর বা ছোট লেখা কয়েকটি পাওয়া যায়, ব্যস ওইটুকুই। আমার এই লেখাটিতে ব্যবহৃত তথ্যাদি প্রায় সবই এই লেখাগুলি থেকেই নেওয়া।
সিপাহি বিদ্রোহের বছর পাঁচেক আগে ১৮৫২ সালের ২২ জুলাই ঢাকা জেলার পশ্চিমপাড়া গ্রামে নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবা কাশীকান্ত চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ঢাকা জজ আদালতের উকিল এবং বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক, মা ব্রহ্মময়ী। নিশিকান্তরা ছিলেন চার ভাই ও দুই বোন। বাবার মৃত্যুর পর নিশিকান্তরা তিন ভাই পরপর নববিধান ব্রাহ্ম সমাজে দীক্ষা নেন। পরে অবশ্য তাঁরা সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দিয়েছিলেন। এই কারণে বড় ভাই বাকি তিন ভাইকে (অর্থাৎ যাঁরা ব্রাহ্ম হয়েছিলেন) সম্পত্তি থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত করেন।
নিশিকান্তরা ছিলেন বাল্যবিবাহের বিরোধী ও বিধবাবিবাহের সমর্থক ও প্রচারক। তাঁদের এইসব কর্মকাণ্ডে অবশ্যই ঠাকুরবাড়ির সমর্থন প্রায় ছিলই না। নিশিকান্তরা যখন পূর্ববঙ্গে নানাভাবে নিপীড়িত বিধবাদের বিবাহ দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন ঠাকুরবাড়ি সে ধরনের কাজে এগিয়ে এসেছে, এমন নজির একেবারেই নেই। রবীন্দ্রনাথের থেকে নিশিকান্তদের মতো নব্যব্রাহ্মদের মানসিক দূরত্ব তৈরি হওয়ার এটাও একটা কারণ।
প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছু কাল পড়বার পর ১৮৭৩ সালে নিশিকান্ত পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ডে। প্রথমে চিকিৎসক হওয়ার জন্য এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, কিন্তু সে কোর্স শেষ না করে পরের বছর চলে যান জার্মানিতে। সেখানে সাহিত্য, ভাষাতত্ত্ব, দর্শন, ইতিহাস ইত্যাদি পড়েন বছর তিনেক, শেখেন বেশ কয়েকটি ভাষাও। জার্মানি আর পাশের দেশ সুইৎজারল্যান্ড— এই দুই জায়গাতেই তিনি বিভিন্ন সময়ে শিক্ষালাভ করেন। জুরিখ থেকে তিনি পিএইচডি সম্পূর্ণ করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয়, যিনি ইউরোপের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি পেলেন। গবেষণা শুরু করার আগে নিশিকান্ত বছর দুয়েক (১৮৭৮-৮০) রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন। এই দেশে তিনিই প্রথম ভারতীয় অধ্যাপক।
১৮৮৩ সালে দেশে ফেরেন নিশিকান্ত। কলকাতায় এবং ঢাকা শহরে তিনি বেশ ভালোভাবেই সংবর্ধিত হয়েছিলেন। হায়দ্রাবাদ শহরে কলেজের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয় তাঁর। পরে তিনি আরও কয়েকটি রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, এবং শেষে হায়দ্রাবাদ শহরে তাঁর শেষ জীবন কাটে। এই শহরে তিনি এক মুসলিম মহিলার প্রেমে পড়েন আর তাঁর জন্যই নিজে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেন। গ্রামে যদিও তাঁর স্ত্রী হেমন্তকুমারী তখনও বর্তমান।
১৯১০ সালে নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে তাঁর জীবনের এই শেষ অংশটি দুঃখজনক, এবং বিতর্কিতও বটে। সারা ভারতের বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রে তাঁর প্রয়াণ-সংবাদ প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর কখনও মুখোমুখি আলাপচারিতা না হলেও দু-জনে দু-জনকে চিনতেন, দু-জনেরই কাজের খোঁজখবর রাখতেন বলেই জানা যায়। রাশিয়ায় থাকবার সময় নিশিকান্ত ‘ভারতী’ পত্রিকায় রুশ সাহিত্য নিয়ে প্রবন্ধও লিখেছিলেন। তবু রবীন্দ্রনাথ কেন তাঁর বইয়ে অমন একটি ভুল তথ্য রেখে দিলেন শেষ অবধি, তা বুঝে ওঠা দুষ্কর। তাঁর বা ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে রাশিয়াবাসের পরে কিছু বিষয়ে মনান্তরই কি নিশিকান্তের প্রতি তাঁর এই অসূয়া বা বিদ্বেষ পোষণের পিছনে আসল কারণ? ঠাকুরবাড়ির আবহাওয়ায়, অন্তত যতদিন দেবেন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন, কেউ বিধবাবিবাহ করবার সাহস পাননি। মহর্ষি অবশ্য নিশিকান্তকে বিলক্ষণ চিনতেন, তাঁর দেশে ফেরার আগে এক হাজার টাকা ব্যয় হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। আর একটি কথা এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল ঠাকুরবাড়িও। নিশিকান্তর ওপরে ভিত্তি করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের বক্তা চরিত্রটিকে সৃষ্টি করেছিলেন, এমন মতও প্রচলিত আছে। তবে এই লেখায় সে প্রসঙ্গে আর যাওয়া যাচ্ছে না।
নিশিকান্তর প্রতি বিদ্বেষের অন্য একটি কারণ হিসেবে এটাও বলা যায় যে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের সময় ছিলেন প্রবলভাবে এই সিদ্ধান্তের বিরোধী। নানাভাবে তিনি তাঁর বিরোধিতাকে ব্যক্ত করেছেন সেই সময়ে। অন্যদিকে নিশিকান্ত ছিলেন এই সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকা একজন মানুষ। তাঁর মনে হয়েছিল এর ফলে পূর্ব বাংলার অবহেলিত প্রান্তিক এলাকাগুলির উন্নয়ন সম্ভব হবে। প্রয়াণের সময় অব্দি নিশিকান্ত ভঙ্গ বঙ্গই দেখে গেছেন, এ এক দিক থেকে তাঁর মানসিক শান্তি বটে। সব মিলিয়ে নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় উনিশ শতকের বঙ্গপ্রদেশের এক বিশিষ্ট বাঙালি, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তাঁকে আজও হতে হয়েছে বিস্মৃত ও অবহেলিত।
.....................১/ বাংলাদেশের ‘সমকাল’ পত্রিকায় ৮ আগস্ট ২০১৪ তারিখে প্রকাশিত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান-এর লেখা ‘কালের খেয়া ভানুসিংহ’ নামে একটি গদ্য। ২/ ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায় আবদুশ শাকুর লিখিত ‘রবীন্দ্রজীবনের অনুজ্জ্বল অঞ্চল’ নামে একটি গদ্য। তারিখ অনুল্লেখিত। [ইন্টারনেট সূত্রে প্রাপ্ত।] অবশ্য পরে সোমনাথ রায়ের গদ্যটি পড়ে দেখা গেল আবদুশ সাহেব তাঁর লেখা থেকেই সমস্ত তথ্য নিয়েছেন, এমনকি কোথাও একেবারে হুবহু টুকেও দিয়েছেন। ৩/ ‘কবির অভিঘাত’। সোমনাথ রায়। শারদীয় দেশ। ২০০৪।
[কভারের ছবিটি news18.com এর সৌজন্যে পাওয়া। এটি বিশ্বভারতীর কোনও এক ছাত্রের আঁকা পোস্টার। ব্যক্তিগত কারণে তাঁর নাম অন্তরালেই রয়েছে। তিনি একজন বাংলাদেশী নাগরিক, এর চেয়ে বেশি কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।]
#নিবন্ধ #নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় #রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর #গবেষণা #ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী