কলকাতায় জোড়া বাঘ পুষেছিলেন বাঙালি রাজামশাই : সাক্ষী ‘বাঘ-বাড়ি’
বনের বাঘ, যে ছুঁলে নাকি আঠেরো ঘা, সে কখনও পোষ মানে? হ্যাঁ, 'গোঁসাইবাগানের ভূত' পোষা হাবু ডাকাত তার পোষা বাঘের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াত বলে শীর্ষেন্দু জানিয়েছিলেন বটে, তবে সে ছিল মন্ত্রতন্ত্র জানা লোক। কিন্তু এমনি কোনও লোকের পক্ষে কি এমন কাজ করা সম্ভব? বাংলার বাঘের দেখা মিললেও, বাঙালির হাতে বাঘের দেখা মিলতে পারে কি?
আজ্ঞে হ্যাঁ, কালেভদ্রে তেমনটাও মেলে বটে। যেমন দেখা গিয়েছিল খৈরি বাঘের বেলায়। ওড়িশার সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানের প্রতিষ্ঠাতা সরোজ রাজ চৌধুরীর পোষা বাঘ ছিল খৈরি। তবে তারও প্রায় বছর পনেরো আগে খোদ কলকাতা শহরের বুকেই ঘটেছিল এমন কাণ্ড। কলকাতা শহরে বাঘ দেখা অবশ্য নতুন কিছু নয়। কেবল সুন্দরবন কেন, খোদ কলকাতা শহরের বুকেও বাঘের আনাগোনা চলত এককালে। উঁহু, একটু ভুল হল, সে কলকাতা তখনও শহরের পোশাক গায়ে চাপায়নি। সাগরপারের দেশ থেকে ইংরেজরা এদেশে এসে জাঁকিয়ে বসছে সবে। আজকে যেসব জায়গা সাহেবপাড়া বলেই পরিচিত, যেমন ধরুন চৌরঙ্গী কিংবা পার্ক স্ট্রিট, সেসব এলাকায় বাঘের দেখা মেলা মোটেও অসম্ভব ছিল না সেকালে। কিন্তু সে তো বেশ আগের কথা। তারপর গ্রাম থেকে শহর হল, আর শহরকে জায়গা দিতে গিয়ে ক্রমশ পিছিয়ে গেল বনজঙ্গল। সেখানে ১৯৫০-এর দশকে ঝকঝকে দক্ষিণ কলকাতায় বাঘ? তাও কি সম্ভব?
আজ্ঞে হ্যাঁ, সম্ভব হয়েছিল বইকি। তাও একটি নয়, দু-দুটি বাঘ বাস করত দক্ষিণ কলকাতার এক বাড়িতে। তাদের নাম স্যামসন আর ডিলাইলা। সে বাড়ির আদি নাম ছিল 'নদীয়া হাউজ', কিন্তু বাঘ বাবাজিদের হাঁকডাকের চোটে এলাকার লোক তাকে ডাকতে শুরু করল বাঘ-বাড়ি নামে। 'নদীয়া হাউজ' আসলে ছিল কৃষ্ণনগরের রাজাদের কলকাতার বাসভবন। এই বাড়িতে এককালে থাকতেন মহারাজা সৌরীশচন্দ্র। তাঁর নেশা ছিল দুটো। ইতিহাস আর শিকার। প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ভাল ছাত্রটি বন্দুক হাতে নিলেই হয়ে যেতেন অন্য মানুষ। ভারত জুড়ে ছিল তাঁর শিকারের খ্যাতি। আর সেই সূত্রেই একবার মধ্যপ্রদেশ সরকারের থেকে বাঘ শিকারের ডাক পান তিনি। সেটা ১৯৫৮ সাল। মধ্যপ্রদেশে উপদ্রব শুরু করেছে একটি নরখাদক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। পনেরো দিন ধরে সেই বাঘের পিছনে ঘুরে অবশেষে তাকে কবজা করা গেল। কিন্তু নিশ্চিন্ত হওয়া তো দূর, দুঃখে বিহ্বল হয়ে পড়লেন খোদ শিকারি। কেন? আসলে সন্তানসম্ভবা পশু, বা যার ছোট সন্তান রয়েছে তেমন মা-পশুকে কোনও বড় শিকারিই সাধারণত মারেন না। সৌরীশচন্দ্রও এই নিয়ম মেনে চলতেন। কিন্তু এবার শিকার করার পর তিনি দেখলেন, তিনি মেরে ফেলেছেন একটি বাঘিনিকেই। খোঁজ পাওয়া গেল দুটি সন্তানও রয়েছে তার। হয়তো অনুশোচনা থেকেই সেই দুটি বাঘের বাচ্চার দায়িত্ব নিতে চাইলেন তিনি নিজে। সুতরাং রাজা সৌরীশচন্দ্রের সঙ্গে বাঘের ছানারাও পাড়ি দিল কলকাতায়। নামকরণ হল তাদের। যত্নে আদরে দিব্যি বেড়ে উঠল তারা, হ্যাঁ, শহর কলকাতাতেই।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য আইনি জটিলতায় পালক পিতার কাছেও থাকা হয়নি তাদের। কিন্তু তাদের স্মৃতি রয়ে গেছে এই পুরনো বাড়ির আনাচেকানাচে, আজও কলকাতা যাকে 'বাঘ-বাড়ি' বলেই মনে রেখেছে।
#বাঘ বাড়ি #পোষ্য #ফিচার #সিলি পয়েন্ট #তোড়ি #সেন